সবুজ পাহাড়ের আড়ালে কষ্টবন্দি পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত বাঙ্গালি

রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার অনেকগুলো গুচ্ছ গ্রামের মধ্যে দুটি গ্রাম রসুলপুর ও শান্তিনগর। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে এ গ্রাম দুটি অসম্ভব ঘিঞ্জি ও নোংরা, যেখানে ১৫০টি স্থায়ী ও ১০০টি অস্থায়ী পরিবার বাস করে। এ গ্রাম দুটির বাসিন্দাদের পরিচয় তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত বাঙ্গালি। সবুজ পাহাড়ের আড়ালে কষ্টবন্দি হয়ে তারা এখানে বসবাস করে। যাদেরকে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন রকম স্বপ্ন দেখিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের আমল থেকেই। পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার রাঙ্গামাটি, রামগড় ও বান্দরবানে অনেক বাঙ্গালিদের বসতি স্থাপন করে দেয়। ১৯৬৬ সনে আবার কয়েক হাজার বাঙ্গালিদের পুনর্বাসিত করে। বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পর পরই দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রায় ৫০ হাজার বাঙ্গালি পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করে। ১৯৭৪ সালে এম.এন. লারমা পাহাড়িদের পক্ষে আন্দোলনে নামলে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া স্থিমিত হয়ে যায়। ১৯৭৯ সালে সরকার গোপন সার্কুলারের মাধ্যমে পুনরায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালিদের বসতি স্থাপন প্রক্রিয়া আরম্ভ করে। ঐ বছরই সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বিধিমালার ৩৪নং বিধি সংশোধনের মাধ্যমে সেখানে পুনর্বাসনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূরীভূত করে। একই বছর সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০ হাজার ভূমিহীন বাঙ্গালি পরিবার পুনর্বাসিত হয়। এরপর ১৯৮০ সালের শেষের দিকে আরও ২৫ হাজার পরিবার পুনর্বাসিত হয়ে যায়। এভাবে ১৯৮৪ সালের মধ্যে ৪ লাখ বাঙ্গালি পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত হয়। বর্তমানে (২০০৬ সালের হিসাব অনুযায়ী) পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬ লাখ ৫০ হাজার বাঙ্গালি বসবাস করে, যা সেখানকার মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৮ ভাগ। মূলত পার্বত্য এলাকার ওপর পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের হস্তক্ষেপ খর্ব করা এবং সেখানে বাঙ্গালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করাই ছিল এই পুনর্বাসনের প্রধান উদ্দেশ্য।

পাহাড়িদের শান্তির কথা বিবেচনা করে সরকার ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করলেও চুক্তিতে ভাবা হয়নি পুনর্বাসিত বাঙ্গালিদের কথা। যে কারণে হাজারো সমস্যার মধ্যে দিনাতিপাত করছে তারা। বাইরের দুনিয়া থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দুর্গম পাহাড়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় বসবাস করছে এসব পুনবার্সিত বাঙ্গালিরা। তাদেরকে ৫ একর জমি ও এককালীন অর্থ দেওয়ার কথা বলে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। কিন্তু তারা কেউই এক থেকে দেড় এককের বেশি জমি পায়নি। যে জমি তারা পেয়েছে তার অধিকাংশই চাষযোগ্য নয়। উপজাতিদের কাছে হরহামেশা নির্যাতিত বাঙ্গালিরা এখানে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদাও পাচ্ছে না। এখানে শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাহাড়িরা বাঙ্গালিদের ওপর বিভিন্ন প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়। ১৯৮০-৯১ সালের মধ্যে শান্তিবাহিনীর আক্রমণে ৯৫২ জন বাঙ্গালি নিহত হয়। পাহাড়ি বাঙ্গালিরা দুর্গম পাহাড়ে টিকে থাকতে না পেরে গুচ্ছগ্রামে বাস করে। এসব গুচ্ছগ্রামগুলোতে একটা ঘরই তাদের সম্বল। গুচ্ছগ্রামের ছোট্ট ঘরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক পরিবার গরু-ছাগলের মতো গোয়ালঘরে বসবাস করছে। চিকিৎসা এবং স্যানিটেশন অবস্থাও ভাল নয়। এরপরও এক খণ্ড জমি তাদের ভাগ্যে জুটছে না। বাঙ্গালিদের জীবন-জীবিকা, শিক্ষা, চাকুরি, ব্যবসা-বসবাস সবকিছুর নিয়ন্ত্রক উপজাতি নেতারা। পার্বত্য এলাকায় বসবাস, ফসল লাগানো কিংবা বিক্রি করতে হলে জেএসএস ও ইউপিডিএফ-সহ উপজাতিদের বিভিন্ন সংগঠনকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। উপজাতিদের কথায় বাইরে গেলে দিতে হয় জীবন।

পার্বত্যাঞ্চলে সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৮০ ভাগ চাকুরির সুবিধা ভোগ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতিরা। বাকি ২০ ভাগ বাঙ্গালিদের জন্য। বাঙ্গালি পরিচয়ই যেন এখানকার সবচেয়ে বড় অভিশাপ। মারাত্বক অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে জীবন কাটে বাঙ্গালিদের। বার্ষিক বরাদ্দকৃত ৯৫ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্যের মধ্যে ২০ হাজার মেট্রিক টন বিশেষভাবে বরাদ্দ করা হয় উপজাতিদের জন্য। অবশিষ্ট অংশ বণ্টন করা হয় শরনার্থী, গুচ্ছগ্রাম ও উপজাতি অধূষ্যিত অঞ্চলের বিভিন্ন উন্নয়নে। এক্ষেত্রে বাঙ্গালিদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। যেখানে বাঙ্গালিরা বাস করে, সেখানে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় না। উন্নয়ন বরাদ্দের শতকরা ৯০ ভাগ উপজাতিদের জন্য ব্যয় করা হয়। শান্তিচুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতরের প্রধান কর্তারা উপজাতীয়। সে কারণেও দুটি সরকারি দফতর থেকে বাঙ্গালিরা কোনোরকম সুবিধাই পাচ্ছে না।

শান্তিচুক্তিতে পুনর্বাসিত বাঙ্গালিদের পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। বাঙ্গালিদেরকে সরকার যেসব জমি দেয়, পাহাড়িদের দাবি তা তাদের জমি। যদি তাই হয় তাহলে পুনর্বাসিত বাঙ্গালিরা যাবে কোথায়? পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিবাহিনীর সহায়তায় বাঙ্গালিদের জমি থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের ভাষায় পাহাড়ি অঞ্চলে বাঙ্গালি বসতি স্থাপনকারীদের কোন স্থান নেই।

শান্তিচুক্তি অনুযায়ী শান্তিবাহিনী কিছু ভাঙা ও বিকল অস্ত্র জমা দিয়েছিল, কিন্তু তাদের হাতে এখনও প্রচুর পরিমাণে মরণাস্ত্র আছে। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া হিসেবে ধীরে ধীরে সব সেনাবাহিনীর ক্যাম্প উঠিয়ে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে পুনর্বাসিত বাঙ্গালি বা মারাত্বক নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়বে বলে অনেকের আশঙ্কা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যাই হলো এখানকার মূল সমস্যা। দীর্ঘদিন যাবত “পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন” অকার্যকর রয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিনের স্পর্শকাতর ভূমি সমস্যা ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ভূমির মালিকানা ও দখল নিয়ে সামাজিক সংকট ও মামলা মোকদ্দমার পাহাড় গড়ে উঠছে। শান্তিচুক্তি অনুযায়ী উপজাতিরা পার্বত্যাঞ্চলে যে কোন জায়গায় জমি কিনতে পারবে। কিন্তু বাঙ্গালিদের জন্য জমি কেনার ক্ষেত্রে রয়েছে নানা জটিলতা। তাই তিন পার্বত্য জেলায় শান্তির কপোত উড়াতে চাইলে আগে ভূমি সমস্যার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান করতে হবে।

সংবাদপত্র তথা মিডিয়া সবাই আদিবাসীদের অধিকারের কথা তুলে ধরেন, কিন্তু ৬ লাখ ৫০ হাজার পুনর্বাসিত বাঙ্গালিদের দুঃখ ও কষ্টের কথা কেউ তুলে ধরে না। দেশের বুদ্ধিজীবি শ্রেণিও পুনর্বাসিত বাঙ্গালিদের কথা কোথাও তেমন উল্লেখ করে না।

পুনর্বাসিত বাঙ্গালিদের যেহেতু সমতল ভূমিতে আনা সম্ভব নয় ঘন জনবসতিপূর্ণ এই দেশে। তাই একটি শক্তিশালী ভূমি কমিশন গঠন করা আবশ্যক। এ ছাড়া একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে, যেটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সমস্যা নির্ণয় করবে এবং এর রিপোর্ট সরকারের কাছে দিবে। সেটির মাধ্যমে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান করবে।

যায় যায় দিন, ৫ নভেম্বর, ২০০৬

Leave a Reply

Your email address will not be published.