বাংলাদেশে নারীদের এগিয়ে চলা: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

একটা সময় ছিল যখন বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ চিহ্নিত ছিল একটি পশ্চাদপদ দেশ হিসেবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনেকটাই নেতিবাচক। কিন্তু বর্তমানে সে অবস্থা আর নেই। বাংলাদেশ আজ মাথায় অনেক সাফল্যের মুকুট পরে ওঠে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন কূটনীতিবীদ হেনরি কিসিঞ্জারের সেই উক্তির ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বাংলাদেশ আজ বিশ্বব্যাংক কর্তৃক ‘এশিয়ার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র’ (বিশ্বব্যাংকের জেন্ডার উন্নয়ন সিরিজ, ২০০৮) হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আর বাংলাদেশের এ রূপান্তরের অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করেছে নারীদের অনন্য ভূমিকা।

সব সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে বাংলাদেশের নারীরা আজ ঘরে-বাইরে, দেশে-বিদেশে উন্নয়নের অংশীদার। এরফলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মনোভাবের মধ্যেও এসেছে পরিবর্তন। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে যে উন্নয়ন সম্ভব নয়, এ ধারণা যেমন সরকার অনুধাবন করতে পেরেছে, তেমনি উপলব্ধি করতে পেরেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত আছেন দু জন নারী। নবম জাতীয় নির্বাচনে সরাসরি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ১৯ জন এবং সংরক্ষিত আসনে সদস্য আছেন ৫০ জন। এ থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে নারী সংসদ সদস্যদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি বিষয়ে স্পষ্ট একটি ধারণা পাওয়া যায়। একই সঙ্গে সংসদের কার্যক্রমে তাদের অংশীদারিত্ব ও উপস্থিতিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। নবম জাতীয় সংসদের ৪৮টি কমিটির মধ্যে ৪২টিতে অর্থাৎ ৮৭.৫% কমিটিতে নারী সংসদ সদস্য প্রতিনিধিত্ব করছেন। মন্ত্রিপরিষদে প্রতিনিধিত্ব করছেন ১৬.৩৬% নারী। এছাড়া সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বিপুলসংখ্যক নারী নির্বাচিত হয়েছেন, যারা অবদান রাখছেন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, যা বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রমাণই বহন করে।

‘ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন’-এর ২০১২ সালের এক গবেষণা মতে, রাজনীতিতে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের চেয়ে বেশি। সংসদে নারীর উপস্থিতির ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান যেখানে ১০৫, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৫তম।

বাংলাদেশের নারীরা নিজ মেধা আর যোগ্যতার বলে আসীন আছেন প্রশাসনের উচ্চ পদে। খাদ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মুশফেকা ইকফাত। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের মহাপরিচালক পদে আছেন ফাহিমা খাতুন। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক হিসেবে আছেন শামসুন নাহার। পুলিশ প্রশাসনে ডিআইজি পদে ফাতেমা বেগম ও রওশন আরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন নিজ মেধা ও কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে।

বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষিত হয়ে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠছে এবং অন্য নারীদেরও সচেতন করে তুলছে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি স্তরে নারীদের শিক্ষার হার পুরুষের শিক্ষার হারকে ছাড়িয়ে গেছে। শিক্ষকতা পেশায়ও বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ।

বাংলাদেশে নারী শিক্ষার অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন। নারী শিক্ষায় ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে এবং প্রতিবেশী দেশ (বাংলাদেশ) থেকে অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষা নেয়ার আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গত ৫ জানুয়ারি (২০১৩) কোলকাতার শান্তি নিকেতনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশে নারী শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অর্মত্য সেন দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নকেই চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বেশি নারী শিক্ষক রয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা অনেক। এমনকি বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও ইউনিয়নের মধ্যেও নারীদের আধিক্য রয়েছে। মানব উন্নয়ন সূচকের সব ক্ষেত্রেই মূলত এ নারীরাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছেন বলেও মন্তব্য করেন অমর্ত্য সেন।

অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের সত্যতাও আমরা দেখতে পাই। যেমন, ২০১০ সাল নাগাদ দেশে প্রতি এক লাখ জীবিত শিশু জন্মে মাতৃমৃত্যুর হার ১৯৪-তে নেমে এসেছে। জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে মাতৃমৃত্যুর হার ১৪৩-এ নামিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কাছাকাছি স্থানে অবস্থান করছে। এছাড়া শিক্ষায় লিঙ্গ বা জেন্ডার সাম্য অর্জন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, টিকাদান কর্মসূচি, বিশ্বে মাতৃদুগ্ধ পানের প্রবণতার দিক থেকে বিশ্বের ৫১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ স্থানে নিয়ে যাওয়া, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সূচক অর্জনেও নারীর অবদান রয়েছে।

স্বাধীনতার ৪২ বছরে বাংলাদেশের অন্যতম অর্জন হলো- নারীরা শুধুমাত্র ঘরের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে কর্মমুখী হয়েছে। তারা উদ্যোগী হয়ে কাজ শিখছে এবং এর মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠছে। তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশে অন্যতম নিয়ামক শক্তির ভূমিকায় রয়েছেন আমাদের নারীরা। এ শিল্পের মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশই নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, কৃষি, শিল্প, অফিস আদালতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী নিযুক্ত আছেন। ১৯৭৪ সালে যেখানে সমগ্র কর্মশক্তির মাত্র ৪ দশমিক ১ শতাংশ ছিল নারী, ২০১০ সালে সেটি বেড়ে হয়েছে ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মোটাদাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২০ শতাংশে রয়েছে নারীর অবদান।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ২০ থেকে ৩০ হাজার নারীকর্মী বিদেশে যাচ্ছেন। শ্রমকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মোট অভিবাসী শ্রমিকের ১৩.৯ শতাংশ নারী, যারা তাদের আয়ের প্রায় ৭২ শতাংশই দেশে পাঠিয়ে থাকেন। তবে প্রতিবছর তারা ঠিক কী পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়ে থাকেন তার একটি পরিসংখ্যান থাকলে এ খাতে নারীর অবদান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠবে।

বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্য নির্ভরতা কমিয়ে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রেও মজুরিবিহীন পারিবারিক কৃষি শ্রমিক হিসেবে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। এর পাশাপাশি নারীরা বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করছে। এর মাধ্যমে নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠছে এবং সমাজের অবহেলিত নারীরা কাজের সুযোগ পাচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশের প্রায় ৫ হাজার ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় প্রায় আড়াই কোটি, যার ৯০ শতাংশই গ্রাহকই নারী।

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের নারীরা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন-এর তথ্যমতে, দেশের মোট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের ৩৫ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বাংলাদেশের বিবি রাসেল এ দেশের তাঁত শিল্পকে নিয়ে গেছেন বিশ্ব দরবারে, দেশকে পরিচিত করেছেন বিশ্ব বাজারে।

স্থাপত্য শিল্পেও নারীর অর্জন কম নয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে তাদের নকশায় তৈরি স্থাপত্য শিল্পের নান্দনিকতা ও উপযোগিতা যথেষ্ট প্রশংসনীয়। এ শিল্পে অবদান রাখছেন রাজধানীর গুলিস্তানে অবস্থিত নগর ভবনের স্থপতি লাইলুন নাহারসহ বেশ কিছু নারী। স্থাপত্যের পাশাপাশি ভাস্কর্য নির্মাণেও নারীরা অসামান্য অবদান রাখছেন। বাংলাদেশে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্করের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে শামীম শিকদার ও আইভি জামান উৎসাহ যোগাচ্ছেন অন্য নারীদের।

বাংলাদেশের উন্নয়নে নারী সমাজের ভূমিকা অগ্রগণ্য হয়ে উঠেছে। নারীরা বর্তমানে তাদের যোগ্যতা দিয়ে উচ্চ আদালতে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও নারীরা পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশে প্রথম টেস্টটিউব বেবির (শিশু) জন্মের সাফল্য লাভকারী চিকিৎসক একজন নারী পারভীন ফাতিমা। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ও পরিশ্রম দিয়ে তিনি নিয়ে এসেছেন এ সফলতা।

গণমাধ্যম তথা সাংবাদিকতায়ও রয়েছে আমাদের নারীদের সরব পদচারণা। নারী তার মেধা, পরিশ্রম আর সৌন্দর্য দিয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও উপস্থাপনায় পারদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে। দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নারীরা অবদান রেখে চলেছে। সঙ্গীতে একজন রুনা লায়লা কিংবা একজন সাবিনা ইয়াসমিন দেশকে দিয়েছেন অনেক কিছু। সাহিত্য অঙ্গনে পুরুষের পাশাপাশি আজ উচ্চারিত হয় রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন ও নাসরিন জাহানের নাম। তাহমিনা আনাম তাঁর ‘গোল্ডেন এজ’ এর মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন বিশ্ব সাহিত্যে।

চলচ্চিত্র নির্মাণেও এগিয়ে আসছেন আমাদের নারীরা। তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা সারা আফরীন নির্মিত ‘শুনতে কি পাও’ নন্দিত হয়েছে বিশ্ব দরবারে। বার্লিন ট্যালেন্ট ক্যাম্পাসের সম্পাদনা ল্যাবে মাত্র নয়টি ছবির মধ্যে আমন্ত্রিত হয় তার নির্মিত ‘শুনতে কি পাও’। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের কোনো অংশে এটিই ছিলো কোনো বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের প্রথম অংশগ্রহণ।

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনেও নারীদের সাফল্য কম নয়। শুটিং, দাবা, সাতার ও ব্যাডমিন্টনে দেশের নারী ক্রীড়াবিদরা সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। টেবিল টেনিস তারকা জোবেরা রহমান লিনু হয়েছেন গিনেস রেকর্ডধারী। একজন কৃতি খেলোয়াড় সালমার নেতৃত্বে ক্রিকেট খেলায়ও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নারীরা।

দৃঢ় মনোবল নিয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করে সফলতার তালিকায় নাম লিখিয়েছেন বাংলাদেশের অকুতোভয় নারী নিশাত মজুমদার এবং ওয়াসফিয়া নাজরীন। সব প্রতিকূলতাকে পেছনে ঠেলে ও বিপদসংকূল পরিবেশকে জয় করে এভারেস্ট শৃঙ্গে উড়িয়েছেন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।

নিজ গুণে বাংলাদেশের নারীরা দেশে-বিদেশে অর্জন করেছেন নানান পুরস্কার ও স্বীকৃতি। এশিয়ার নোবেল নামে খ্যাত ফিলিপাইনের র‌্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন তহরুন্নেসা আব্দুল্লা ও অ্যাঞ্জেলা গোমেজ। সর্বশেষ এ পুরস্কারটি জয় করেছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বিধি বহির্ভূতভাবে জাহাজ ভাঙার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ায় সংগ্রামী এ নারীকে দেয়া হয়েছে ‘গোল্ডম্যান এনভায়রন মেন্টাল অ্যাওয়ার্ড।’ সম্প্রতি দেশের দক্ষিণের জেলা নোয়াখালীতে গান্ধী আশ্রম পরিচালনা ও সমাজ সেবায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতের অন্যতম বেসামরিক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘পদ্মশ্রী’-তে ভূষিত হয়েছেন বাংলাদেশি নারী ঝর্ণাধারা চৌধুরী।

বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে নারীরা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে উপরোক্ত পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। সাফল্যের এ তালিকা তুলে ধরার কারণ হলো, আমরা যেন কখনো না বলি, ‘আমরা কিছুই পারি না এবং কিছুই করা হয়নি এই দেশে।’ সাফল্যের এ তালিকা দেখলে আমাদের নারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্মাবে। মনের ভেতর এ ভাবনা জাগ্রত হবে- ‘আমরা নিজেরা উন্নতি সাধন করতে পারি, উন্নয়নে অবদান রাখতে পারি।’

তবে নারী নির্যাতন বন্ধ করা, নারীর প্রতি বৈষম্য কমানোসহ কিছু ক্ষেত্রে নজর দেওয়া গেলে বাংলাদেশে নারীদের অগ্রগতির মাত্রা আরও বাড়বে। বাংলাদেশ সরকারও এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছে। নারী নির্যাতন রোধ ও নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিগত দুই দশকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ও পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী আইনসহ বেশকিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই যেন থামছে না নারী নির্যাতন।

জাতীয় মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, বছরে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে নারী নির্যাতন। এ ছাড়া পথে-ঘাটে মেয়েদের হয়রানি, যৌতুকের দাবি এবং জোরপূর্বক বিয়ে ইত্যাদি কারণে আত্মহত্যাকারী নারীর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৬৫ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিন হাজার ৪৩৭ জন নারী। এর মধ্যে ২০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম ২০ দিনেই ধর্ষণের চেষ্টা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৫টি।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৩ উপলক্ষে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’ প্রকাশিত বার্ষিক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ নভেম্বর মাস পর্যন্ত নারীর প্রতি সহিসংতা যেমন, অ্যাসিড সহিসংতা, ধর্ষণ এবং যৌতুকের জন্য সহিসংতা যথাক্রমে বার্ষিক ২.৫৬ শতাংশ, ১৬.৮৫ শতাংশ এবং ৪৬.৬৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সামাজিক লোকলজ্জার কথা চিন্তা করে নির্যাতনের শিকার হওয়া বেশিরভাগ নারীই আইনের আশ্রয় নেয় না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর আইনের আশ্রয় নেয়া নারীর সংখ্যা মাত্র ২ শতাংশ। যে কারণে গত এক দশকে ১ লাখ ৮২ হাজার নারী নির্যাতনের শিকার হলেও অপরাধী ধরা পড়েছে মাত্র ১৪ শতাংশ।

এ অবস্থায় নারীরা যাতে সহজেই আইনের আশ্রয় নিতে পারে সে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এক্ষেত্রে প্রতিটি থানায় নারী নির্যাতন বিষয়ক অভিযোগ গ্রহণের জন্য বিশেষ সেল গঠন করা দরকার, যে সেলের দায়িত্বে থাকবেন নারী পুলিশ কর্মকর্তা। একইসঙ্গে কোন ধরনের তদবিরকে আমলে না নিয়ে দ্রুততম সময়ে বিচার শেষ করতে হবে, যাতে অপরাধীরা উপযুক্ত শাস্তি পায়।

এছাড়া নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা দরকার, যাতে সামাজিকভাবে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমে আসে। তবে, নারীদের অবস্থার পরিবর্তনে সবার আগে তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সমাজের অন্যান্য নারীদেরকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে এসব বিষয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার কাছ থেকে সাহায্য নেয়া যেতে পারে। নারী নির্যাতন রোধে পুরুষদের দায়িত্বও কম নয়। নারীদের প্রতি প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে তাদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে পুরুষরা রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

নারীদের চলাফেরা ও জীবন-যাপনে নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে এবং বিকশিত হওয়ার পূর্ণ সুযোগ পেলে তারা সমাজের উন্নয়নে আরও বেশি পরিমাণে ভূমিকা পালন করতে পারবে। আমাদের জাতীয় জীবনে আসবে একের পর এক সাফল্য, আমরা পাবো স্বপ্নের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, পাবো ইতিবাচক এক বাংলাদেশ।

কন্যাশিশু বার্তা , ১৫ এপ্রিল ২০১৩

Leave a Reply

Your email address will not be published.