বাংলা নববর্ষ: বাঙালির আপন সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবোধের পরিচয়বাহী

আদিম যুগ থেকে শুরু করে আপন সংস্কৃতি মানুষের জীবনে নদীর বহমান ধারার মতো প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। বাঙালি জনগণের জীবনেও এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায় না, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ। হালখাত, কৃষি আর রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে যে বাংলা সনের সূচনা হয়েছিলো সম্রাট আকবরের সময়ে তাই এখন পরিণত হয়েছে বাঙালির প্রাণের উৎসবে। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ এলেই বাঙালি জনগণ নতুন করে তার হাজার বছরের ঐতিহ্যের প্রতি টান অনুভব করে। এর পেছনে যে শক্তি কাজ করে তা হলো বাঙালির জাতীয়তাবোধ।

বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে বাংলা নববর্ষের। একটি সচেতন জাতির পরিচয় প্রকাশিত হয় বিচিত্র সাংস্কৃতিক রূপের মধ্য দিয়ে। নববর্ষ বাঙালির সেই পরিচয়বাহী। বাঙালির এই নববর্ষ পালন অনেকাংশে প্রতিকী চেতনার রূপ। এই প্রতিক সৃষ্টি হয়েছে দেশ জাতি আর নিজের প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধেয় মনোভাবের সম্মিলনে। দেশের বিশিষ্ট লোক বিজ্ঞানী ড. আশরাফ সিদ্দিকীর মতে, নববর্ষে চৈত্রের বিভিন্ন উৎসব ও মেলার ধর্মীয় দিক ছাড়াও আবহমান সাম্প্রদায়িক বাংলার খাঁটি রূপ পাওয়া যায়। বাঙালির নববর্ষের প্রধান বৈশিষ্ট্য এটি মুসলমান হিন্দু বা বৌদ্ধদের একক কোনো উৎসব নয়। এর চরিত্র সার্বজনীন। ধর্মভিত্তিক নয় কিন্তু সার্বজনীন Ñ নববর্ষের মতো এমন উৎসব পৃথিবীতে বিরল। এ উৎসব সবার। কৃষকের যেমন- ধনী জোতদারেরও তেমন, মুসলমানের যেমন হিন্দুদেরও তেমন। খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মানুযায়ীদের কাছে একইভাবে বিশেষ এই একদিন। এ দেশের পাহাড়ি, উপজাতি, সমতলের আধিবাসীরাও পহেলা বৈশাখকে ঘিরে উৎসবে মেতে উঠে।

ষাটের দশকে ছায়ানট নামের সাংস্কৃতিক সংগঠন রমনা বটমূলে বর্ষবরণের যে অনুষ্ঠানের সূচনা করেছিল তা আজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। রমনার বটমূলে গানে, কবিতায় ও যন্ত্রসংগীতের মূর্চনায় প্রতিবছর ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান বাঙালির সংস্কৃতির প্রধান অংশ হয়ে গেছে। লাখো লাখো মানুষ ভিড় করে রমনার চত্বরে। নববর্ষে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে সেজেগুঁজে তরুণীরা আর পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ছেলেরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। পরিণত হয় এক মহামিলন মেলায়।

নববর্ষ আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গণমুখী সার্বজনীন উৎসব। সকল পেশার মানুষ মিলিত হয় অতি আপন ঐতিহ্যের ছোঁয়ায়। বাংলার হাটে-মাঠে-ঘাটে, শহরে বন্দরে মেতে ওঠে সবাই মহা আনন্দে। নগর জীবনে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার ভাব কাজ করে। পহেলা বৈশাখ ও বৈশাখী মেলা তাদের মাঝে নিয়ে আসে বিচ্ছিন্নতার বিপরীতে আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্য।

পহেলা বৈশাখের এ উৎসব বাংলার লোকজ সংস্কৃতির উৎসব। নববর্ষের দিন বসে গ্রামীণ মেলা। কত না বিচিত্র হাতের তৈরি দ্রব্যসম্ভার সে সব মেলায় বিক্রি হয়। সে সকল জিনিস দেখলে বাংলার মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনধারার একটি স্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে। গ্রামের এ মেলা যেন গ্রাম বাংলার মানুষের প্রতিচ্ছবি। তালপাতার পাখা, মাটির পুতুল, পাটের শিকা, শোলার পাখি, বাঁশের বাশি, ঝিনুকের ঝড়, পুতির মালা, কত না অদ্ভূত জিনিসের সমাবেশ ঘটে সে মেলায়। নববর্ষের এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকে গ্রামের কৃষক আর কৃষক বধূ। রঙ্গিন ফিতে জড়ায়ে খোঁপাতে আর কাঁচের চুড়ি পরে হাতে কৃষকের বধূ আলতা দিয়ে স্বামী আর সন্তানদের হাত ধরে রওনা হয় গ্রামের মেলায়। নাগর দোলায় চড়ে শিশুরা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। পুতুল নাচ দেখে সবাই চমৎকৃত হয়। ছোট ছোট চায়ের দোকানে বসে আড্ডা। মেলা থেকে বাড়ি ফেরার সময় কিনে নেয় পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এক তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় এক হাজার ৫০টির মত মেলা অনুষ্ঠিত হয় সারাদেশে, যার অধিকাংশই অনুষ্ঠিত হয বৈশাখ মাসে। এসব মেলাতে বসে যাত্রাগান, কবিগান, জারিগান ও বাউল গানের আসর।

বৃটিশ আমলে বাঙালি জীবনে নববর্ষের উপস্থিতি অধিকাংশ সময়েই ধরা পড়েছে হালখাতা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে হালখাতা অনুষ্ঠানকে নববর্ষের একটি সার্বজনীন আচরণীয় উৎসব বলা যেতে পারে। জীবনের শীর্ণ খাতাকে বদলে একটি নতুন খাতা খোলাই হালখাতার মূল উদ্দেশ্য। ড. এনামূল হকের মতে, জমিদারী আমলে পূন্যাহ অনুষ্ঠানে প্রজারা আসতো, মিষ্টিমুখ হত এবং প্রজারা খুশিমনে বকেয়া খাজনা দিয়ে যেত। আর এই পূন্যাহ অনুষ্ঠানের সার্বজনীন রূপ হলো হালখাতা।

রাজধানী ঢাকায় নববর্ষের প্রধান আকর্ষণ রমনা পার্ক। লাখো লাখো মানুষ সারিবদ্ধভাবে হাটছে, গাইছে আর আনন্দ করছে। এরকম দৃশ্য নববর্ষ ছাড়া আর অন্য কোনো সময় চোখে পড়ে না। বিগত কয়েক বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করার কারণে এটিও অন্যতম আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চলে সাত সকালে পান্তা খাওয়ার প্রতিযোগিতা। নববর্ষ উদ্যাপনে পান্তা খেয়ে দিন শুরুটা এখন প্রয়োজনের না হলেও ঐতিহ্যের কারণে আদৃত।

আমাদের সাহিত্যে বৈশাখ একটি বিশেষ জায়গা জুড়ে রয়েছে। নববর্ষের প্রতিকী মূল্য শিল্প-সাহিত্যে দীর্ঘদিন থেকে নির্ধারিত হচ্ছে। বৈশাখ বহু কবি সাহিত্যিককে প্রেরণা জুগিয়েছে। বসন্তের বিদায় আর বৈশাখের আগমন বাংলা সাহিত্যে তাই দেখা দিয়েছে এক অপরিহার্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র নিয়ে।

মূলত নববর্ষ মানুষের জীবনের এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উত্তরণের সঙ্গেই জড়িত। এটি একান্তভাবে বাংলাদেশের মানুষের নিজস্বতার আমেজে ভরপুর। নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দের সঙ্গে নববর্ষকে বৈশাখী মেলার আনন্দে পালন করার এই সংস্কৃতি আমাদের একান্তই নিজস্ব।

পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়, আত্মনুসন্ধান আর আত্মআবিষ্কারের দিন। এ দিন শুধু জাতীয় জীবনে নয়, সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনে আবির্ভূত হয় নতুনের স্পর্শ নিয়ে। এদিন নিয়ে আসে অনাবিল আনন্দ ও নির্মল হাসির সুবাতাস।

১৪ এপ্রিল ২০০৭

Leave a Reply

Your email address will not be published.