উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতা: ইসি’র প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

গত ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল চতুর্থ দফা উপজেলা নির্বাচন (চতুর্থ উপজেলা নির্বাচন-২০১৪)। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মোট চার দফায় মোট ৩৮৯টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলে বেশ কয়েকটি উপজেলায় নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। নির্বাচন হওয়া উপজেলাগুলোর মধ্যে প্রাপ্ত ৩৭৭টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিএনপি ১৪৪টিতে, আওয়ামী লীগ ১৬৮টিতে, জামায়াতে ইসলামী ৩৩টিতে, জাতীয় পার্টি ৩টিতে, স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দলের সমর্থিত প্রার্থীরা ২৯টিতে জয়ী হয়েছেন (প্রথম আলো, ২৪ মার্চ ২০১৪)।

আর প্রাপ্ত ৩৭৪টি উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিএনপি ১০১টিতে, আওয়ামী লীগ ১২২টিতে, জামায়াত ১০০টিতে, জাতীয় পার্টি ৬টিতে, স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দলের সমর্থিত প্রার্থীরা ৩৮টি এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রাপ্ত ৩৭৬টি উপজেলায় বিএনপি ১৭০টিতে, আওয়ামী লীগ ১৩৩টিতে, জামায়াত ২৯টিতে, জাতীয় পার্টি ৩টিতে, স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দলের সমর্থিত প্রার্থীরা ৩৯টিতে জয়ী হয়েছেন (ফলাফলগুলো প্রথম আলোর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যোগ করে পাওয়া)।

চার দফা নির্বাচন শেষে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে এবং বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ভাইস চেয়ারম্যান পদে অধিক সংখ্যক উপজেলায় জয়ী হয়েছেন। এছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামায়াত প্রার্থীদের বিপুল সংখ্যক উপজেলায় জয়ী হওয়া অনেককেই অবাক করেছে।

প্রথম দু দফায় ৯৭টি উপজেলায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জয়ী হন, যেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ৮০টি আসনে জয় পান। এ দু দফায় বড় ধরনের কোন সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু তৃতীয় দফায় ফলাফল পাল্টে যেতে থাকে। এ ধাপের ৮১টি উপজেলার নির্বাচনে (৩টি স্থগিত) আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা ৩৭ উপজেলায় আর বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ২৬ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জয় পান। একই সঙ্গে নির্বাচনী অঙ্গনে ফিরে আসে সহিংসতা। সহিংসতায় মারা যায় তিনজন। কেন্দ্র দখলের চেষ্টা, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও জাল ভোট Ñ এসব অনিয়মের ঘটনা ঘটে ১৭৫টি কেন্দ্রে (কালের কণ্ঠ, ২৫ মার্চ ২০১৪)। কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, হামলাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে কমপক্ষে আটটি উপজেলায় বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা ভোট বর্জন করেন।

২৩ মার্চ চতুর্থ দফা উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পায়। কালেরকণ্ঠের (২৫ মার্চ ২০১৪) প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ দফায় ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেওয়া, জাল ভোটের ‘উৎসব’সহ রীতিমতো ‘ভোট ডাকাতি’র ঘটনা ঘটে। পাশাপাশি হামলা, সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, প্রিসাইডিং ও পোলিং এজেন্টদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে ২২০টি কেন্দ্রে। এদিন সহিংসতায় নিহত হয় চারজন। অনিয়মের অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেন ২০ জন প্রার্থী (যুগান্তর, ২৩ মার্চ, ২০১৪)। এ দফায় আওয়ামী লীগ ৫৩ এবং বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ৩৭ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়।

উপরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সহিংসতা যত বেড়েছে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের জয় পাওয়ার হার তত বেড়েছে। তাই চার দফা নির্বাচন শেষে আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকলেও অনেকে মনে করছেন নৈতিকভাবে পরাজয় হয়েছে দলটির। কারণ আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার সঙ্গে সহিংসতার সম্পর্ক স্পষ্ট।

অন্যদিকে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে না পারা এবং সহিংসতা রোধে ব্যবস্থা না নেওয়া প্রশ্ন উঠছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে। সংঘাত-সহিংসতার পেছনে কমিশনের উদাসীনতাকেই প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ তথা গ্রহণযোগ্য জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে আমাদের সংবিধান কমিশনকে একটি ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কমিশন যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সে লক্ষ্যে ২০০৮ সালে জারি করা এক অধ্যাদেশ-এর মাধ্যমে কমিশনের সচিবালয়কে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে বিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম মামলার (ডিএলআর ৪৫, ১৯৯৩) রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেছেন, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করা করণীয়, তার সবই করতে পারবে, এমনকি আইন ও বিধি-বিধানের সংযোজনও করতে পারবে। আফজাল হোসেন বনাম প্রধান নির্বাচন কমিশনার-এর (ডিএলআর ৪৫, ১৯৯৩) মামলার রায়েও সুপ্রিম কোর্ট একই মত দিয়েছেন।
সহিংসতা বন্ধে নির্বাচন কমিশন কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। নির্বাচনে আগের দিন ও ভোটের দিন কেন্দ্রে কেন্দ্রে সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও বিজিবির টহলও সহিংসতা রোধে কোন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ইসি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিতেই পারে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্বাচনে প্রচুর পরিমাণে আচরণবিধি লঙ্ঘন তথা ব্যালট ছিনতাই, কেন্দ্র দখল ও জালভোটসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটে পুলিশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সামনেই। এসব ঘটনাই কমিশন তেমন কোনো শক্ত পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে সাফাই গাইছে। কমিশন যদি নিজেই সাফাই গায় যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, তাহলে আর বলার কিছু থাকে না। একই সঙ্গে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া না হওয়া আল্লাহর ওপর নির্ভর করে দাবি করে নিজেদের দায়বদ্ধতাও এড়িয়ে গিয়েছে কমিশন। এছাড়া কোন বিশেষ কারণ ছাড়া উপজেলা নির্বাচনের এ গুরুত্বপুর্ণ সময়ে সিইসির অনুপস্থিতি নাগরিক হিসেবে অনেকের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে।

প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর থেকে (সর্বশেষ দশম জাতীয় নির্বাচন ছাড়া) গত বছরের শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কয়েক হাজার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একজন ব্যক্তিরও প্রাণহানি ঘটেনি। তাই নাগরিক হিসেবে আমাদের মনে আশা জেগেছিল যে, নির্বাচনী সহিংসতা ও অনিয়মের অভিশাপ থেকে বোধহয় আমরা মুক্ত হয়েছি। কিন্তু চার দফা উপজেলা নির্বাচনের পর এখন মনে হচ্ছে সে আশায় গুড়েবালি।

উপজেলা নির্বাচনে ক্রমবর্ধমান কারচুপি ও সহিংসতা নাগরিক হিসেবে আমাদের শঙ্কিত করছে। নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি ও সহিংসতা অব্যাহত থাকলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। অর্থ ও পেশিশক্তিই তখন নির্বাচনে জেতার মূল নিয়ামক হয়ে দাঁড়াবে। বস্তুত, চলমান সহিংসতার কারণে দেশে নারকীয় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও ভেঙে পড়তে পারে। তাই আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সকল প্রকার বিতর্ক ও সহিংসতামুক্ত করতে সরকার, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা সময়ের দাবি।

অনলাইন বাংলা, ২৫ মার্চ ২০১৪

Leave a Reply

Your email address will not be published.