অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ও বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি

আমরা জানি, যে কোনো রাষ্ট্রের দুটি অংশ আছে। একটি হলো সরকার, আর আরেকটি জনগণ বা সিভিল। এই সিভিল এবং রাষ্ট্রের সার্বিক দেখভাল করার প্রতিনিধিরাই হলেন ‘সিভিল সোসাইটি’। আর সরকার যেহেতু জনগণের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়, সেহেতু সরকার জনগণের প্রতি তার অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে কিনা তা তদারকি করার জন্য একটি সত্যিকার ‘সিভিল সোসাইটি’ প্রয়োজন, যে সিভিল সোসাইটি হবে দলনিরপেক্ষ ও দেশপ্রেমিক। একইসঙ্গে নাগরিকদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণে যাঁরা থাকবেন সদা নিষ্ঠাবান। যেহেতু নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদেরকে নাগরিকদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলতে হয়, সেহেতু কখনো কখনো তারা সরকারের রক্তচক্ষুর কবলে পড়েন। কিন্তু নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষায় যাঁরা কাজ করেন তাঁরা এ রক্তচক্ষুকে ভয় পান না। কারণ তাঁদের ওপর থাকে জনগণের বিপুল আস্থা ও সমর্থন।

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন এমনই একজন সিভিল সোসাইটির নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি। মানুষের জন্য কথা বলার কারণে যিনি অনেক সময়ই সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। কিন্তু এসব উপেক্ষা করেই সমাজের প্রয়োজনে ছুটে গেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। মানুষের কল্যাণে সভা-সমিতি, এমনকি রাজপথের আন্দোলনে যেতেও দ্বিধাবোধ করেননি তিনি। অর্থাৎ তিনি কখনো কারও শর্তে চলেননি, বরং চলেছেন নিজের বিবেকের শর্তের দ্বারা তাড়িত হয়ে।

বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি আজ অনেকটাই বিভক্ত। রাজনৈতিক বিশ্বাস আর দেনা-পাওনার ভিত্তিতেই এ বিভাজন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। অথচ সিভিল সোসাইটি যদি নিরপেক্ষভাবে কোনো বিশেষ মত বা দলের সমর্থক না হয়ে কাজ করতে পারতো, তাহলে অতীতের বিভিন্ন সময়ের মত আজও তা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতো। এ রকম একটি সময়ে আমরা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ-এর গুরুত্ব আমরা অনুভব করছি। যিনি প্রকৃত অর্থেই ছিলেন বাংলাদেশে দলনিরপেক্ষ সিভিল সোসাইটি গড়ে তোলার প্রাণপুরুষ।

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের জন্ম ভারতের কলকাতায়, ২৭ মার্চ ১৯৩৬। বাবার চাকরির সুবাদে তাঁর শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স এবং ১৯৫৬ সালে মাস্টার্স পাশ করেন। এরপর নোবেল বিজয়ী তৈরির কারখানা খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি নোবেল বিজয়ী মার্টিন মিলার ও বব লুকাস ছাড়াও মিল্টন ফ্রিডম্যান, বাকার এবং জনসন প্রমুখ খ্যাতিমান পণ্ডিতের সংস্পর্শে আসেন।

পিএইচডি করতে যাওয়ার আগেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। পিএইচডি শেষ করে পুনরায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। সে সময় পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব-মোনায়েমের তাঁবেদাররা অর্থনীতি বিভাগের জনপ্রিয় শিক্ষক আবু মোহাম্মদের ওপর হামলা চালায়। একজন সম্মানিত শিক্ষকের ওপর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে অধ্যাপক মোজাফ্ফর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদ ছেড়ে দেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে তিনি জীবন-জীবিকার উৎস বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করেননি। যৌবনে তাঁর এই যে প্রতিবাদী রূপ সেটা আমৃত্যু বজায় ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন তিনি এবং তাঁরা অতি দ্রুত প্রথম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৪ সালে পরিকল্পনা কমিশন ছেড়ে দেয়ার পর অধ্যাপক মোজাফফর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ) যোগদান করেন অধ্যাপক হিসেবে। দীর্ঘ ৩০ বছর এখানে অধ্যাপনা করে ২০০৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। মাঝে কিছুদিন মন্ত্রী মর্যাদায় জিয়াউর রহমান সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন তিনি।

অধ্যাপক মোজাফ্ফর তাঁর কর্মজীবনে যেখানেই কাজ করেছেন সেখানেই সততা, যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা এবং সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন থেকে শুরু করে তাঁর দীর্ঘ পথচলায় যেমন অনেক সংগঠন তৈরি করেছেন, তেমনি অনেক প্রতিষ্ঠানকে পৌঁছে দিয়েছেন উন্নতির শেখরে। যেখানেই তিনি কাজ করতেন সেখানেই তাঁর লক্ষ্য ছিল দেশের জন্য কিছু একটা করা।

ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি সচেতন হওয়া সত্ত্বেও তিনি সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর ভাষায়, “সক্রিয় রাজনীতির জন্য একটা ভিন্ন রকমের চরিত্রের দরকার যা আমার ছিল না, ছিল দেশকে জানার প্রতি আকর্ষণ।” তবে তিনি পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলনে সহমর্মিতার সাথে যুক্ত থেকেছেন। বিশেষ করে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করে নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী নাগরিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। তিনি নিজে রাজনীতি না করলেও রাজনীতিকে দেখেছেন, বুঝেছেন এবং রাজনীতির মান ও সংস্কৃতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন।

বার্ধ্যকে পৌঁছে যাওয়ার পর তিনি নিজেকে আড়াল করে নেননি। সুজন, বাপা ও টিআইবির সাথে যুক্ত থেকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, পরিবেশ রক্ষা ও দুর্নীতি রোধে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন।

অধ্যাপক মোজাফ্ফর ছাত্রজীবন থেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মাচরণ করতেন। তিনি যে একটি ন্যায়পরায়ণ সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেন, তার প্রথম প্রেরণা আসে তার গভীর ধর্মবিশ্বাস থেকে। আর ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন কঠিন ও কোমলে মেশানো একজন মানুষ।

গত ২২ মে ছিল অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ-এর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। কৃর্তিমান এই মানুষটি প্রতি অসামান্য শ্রদ্ধা জানিয়ে এখানেই শেষ করছি। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।


তারিখ: ২০ মে ২০১৬

Leave a Reply

Your email address will not be published.