নির্বাচন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা: একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা

সংজ্ঞা: নির্বাচনের বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে: ‘নির্বাচন কোনো প্রতিষ্ঠান বা দপ্তরের কোনো পদে প্রার্থীদের মধ্য থেকে এক বা একাধিক প্রার্থীকে বাছাই প্রক্রিয়া; যেমন সরকার, আইনসভা এবং বিধিবদ্ধ সংস্থাগুলিতে নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক প্রকাশ্য বা গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা হয়।’ অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে নির্বাচনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে: ‘A formal and organized choice by vote of a person for a political office or other position’। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতে বলা হয়েছে: ‘Election, the formal process of selecting a person for public office or of accepting or rejecting a political proposition by voting’।
তবে সহজভাবে বলতে গেলে নির্বাচন হলো সিদ্ধান্ত— গ্রহণের এমন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণ সমাজ-সমিতি-রাষ্ট্র পরিচালনা ও প্রশাসনিক কাজের জন্য একজন প্রতিনিধিকে বেছে নেয়।

নির্বাচন কেন দরকার
নাগরিকদের কাছ থেকে তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট এবং একটি নির্বাচিত ব্যক্তির কাছ থেকে তার উত্তরসূরির হাতে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করতে নির্বাচন সহায়তা করে থাকে। অন্যভাবে বললে– নির্বাচন নাগরিকদেরকে সরকারের ব্যাপারে মৌলিকভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ দেয়–কে সরকার পরিচালনা করবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়।

গণতন্ত্র ও নির্বাচন
গণতন্ত্রের একটি মৌলিক বিষয় হলো নির্বাচন। নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চিন্তা করা যায় না। কারণ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন স্তরে জনপ্রতিনিধি বাছাই করা হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও ভোটদানের মাধ্যমেই জনগণ তার এই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে। আর আমরা জানি, আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।

আমরা দেখি, প্রাচীনকাল থেকেই গ্রীস ও রোমে নির্বাচনের ব্যবহার হয়ে আসছে এবং গোটা মধ্যযুগে রোমান সম্রাট ও পোপের মত শাসক বাছাই করতেও নির্বাচনের ব্যবহার হতো। প্রাচীন ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজারা বাছাই করতেন রাজাদের। তবে আধুনিক যুগে ‘নির্বাচন’ হলো জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচন।

তবে সবসময় নির্বাচন করেই কাউকে নিয়োগ দিতে হবে এমনটা মানা হয় না। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্র্র্রের মতো একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রেও কিছু পদ নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করা হয় না। বিশেষত যেগুলোর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু যোগ্যতার প্রয়োজন আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা রক্ষার স্বার্থে নির্বাচনের পরিবর্তে সচরাচর সরাসরি তাদের নিয়োগ করা হয়।

নির্বাচনের ধরনসমূহ: আমরা বিভিন্ন ধরনের নির্বাচন দেখি। যেমন, ১. রাষ্ট্র্র্রপতি নির্বাচন, ২. সাধারণ নির্বাচন, ৩. প্রাথমিক নির্বাচন, ৪. উপ-নির্বাচন, ৫. স্থানীয় নির্বাচন ও ৬. কো-অপশান।

নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য:
১. ভোটাধিকার: কারা ভোট দিতে পারবে সেই প্রশ্নটাই হলো নির্বাচনের মূল বিষয়।
২. মনোনয়ন: সাধারণত, নির্বাচনের পূর্বে দল বা সংগঠন থেকে কাউকে নির্বাচনের পূর্বে মনোনয়ন দিতে হয়, যাতে তিনি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বা মতের লোকদের ভোট পেয়ে বিজয়ী হতে পারেন। কখনো কখনো এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া।
৩. নির্বাচনী ব্যবস্থাসমূহ: যে কোনো নির্বাচনেই পূর্ব থেকেই সাংবিধানিকভাবে বা লিখিতভাবে একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকে। মানে এই নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে, কীভাবে সম্পন্ন করা হবে।
৪. ভোটের সময়সূচি নির্ধারণ: ভোট গ্রহণের জন্য দিন ও কত বছর পরপর নির্বাচন হবে তা নির্ধারণ করা।
৫. নির্বাচনী প্রচারসমূহ: যখন নির্বাচন হয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ও তাদের সমর্থকরা ভোটারদের কাছে সরাসরি আবেদনের মাধ্যমে তাদের নীতি তুলে ধরে প্রভাব বিস্তারের চেষ্ট্রা করে, একেই বলা হয় নির্বাচনী প্রচার।

নির্বাচন প্রক্রিয়ার সমস্যা/দুর্বলতাসমূহ: যেসব দেশে আইনের শাসন দুর্বল, একইসঙ্গে প্রশাসনিক দুর্বলতা দৃশ্যমান সেসব দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের ‘সুষ্ঠু ও অবাধ’ নির্বাচন করাটা দুরুহ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা সেসব দেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় থাকা সরকার অনাধিকার হস্তক্ষেপ তথা প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে।

এছাড়া নির্বাচনী ব্যবস্থার অন্য দুর্বলতাগুলো হলো– কীভাবে ভোট দিতে হবে সে সম্পর্কে ভোটারদের বিভ্রান্ত করা, গোপন ব্যালট ব্যবস্থায় আগে থেকে ব্যালট পুরে রাখা, ভোট যন্ত্রে গরমিল করা, বৈধ ভোটকে নষ্ট করা, মারধর করে ভোটারদের ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখা অর্থাৎ ভোটকেন্দ্রে পেশিশক্তির ব্যবহার এবং ফলাফল প্রকাশে জালিয়াতি করা। এ গরমিলের কারণে অনেক সময় অবাঞ্চিত ব্যক্তিরাও নির্বাচিত হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এটা একটা দুর্বলতা যে, অনেক সময় অনাকাক্সিক্ষত ব্যক্তিরাও নির্বাচিত হয়ে যায়। তবুও স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকলে পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ ঐ ব্যক্তির বদলে যোগ্য লোককেই নির্বাচিত করে।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মানদণ্ড:
একটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হয়েছে কিনা সে সিদ্ধাতে উপনীত হওয়ার জন্য কতগুলো মানদণ্ড ব্যবহার করা প্রয়োজন। আমাদের আইনে কিংবা আদালতের রায়ে কোনো মানদণ্ড দেওয়া নেই। তবে আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তিতে — যেমন, ‘সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল কভেনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস’– ‘জেন্ইুন’ নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে এবং এর কিছু মানদণ্ডও দেওয়া আছে। যেমন: (১) ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ প্রক্রিয়ায়যাঁরা ভোটার হওয়ার যোগ্য ছিলেন তাঁরা ভোটার হতে পেরেছেন; (২) যাঁরা প্রার্থী হতে চেয়েছেন তাঁরা প্রার্থী হতে পেরেছেন; (৩) ভোটারদের সামনে বিকল্প প্রার্থী ছিল; (৪) যাঁরা ভোট দিতে চেয়েছেন তাঁরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পেরেছেন; এবং (৫) ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া ছিল স্বচ্ছ, কারসাজিমুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য।

———————————-

প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published.