চাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন

গত ১০ জুন ২০১৮, কানাডার টরেন্টোতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংবর্ধনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কোনো দল নির্বাচনে না এলেও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় যথাসময়ে নির্বাচন হবে’ (ইত্তেফাক, ১২ জুন ২০১৮)। এর আগে চলতি বছরের মার্চ মাসে নির্বাচন কমিশনার জনাব মো. রফিকুল ইসলাম বলছিলেন, ‘কোনো দল যদি নির্বাচনে না আসে সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়। সংবিধান মোতাবেকই আগামী সংসদ নির্বাচন হবে’ (প্রথম আলো, ২৪ মার্চ ২০১৮)। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের এই বক্তব্যগুলো আমাদেরকে সত্যিই হতাশ করে। কারণ সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার ও নির্বাচন কমিশন যদি উদ্যোগী না হয় তাহলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো আমরা আরেকটি একতরফা নির্বাচন দেখতে পাবো।

অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখি যে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে নির্বাচনের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকে না, সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত হয় না, দেশে দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সর্বোপরি সেই নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। এক্ষেত্রে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি (ষষ্ঠ) ও ২০১৪ সালের ০৫ জানুয়ারির (দশম) একতরফা নির্বাচন। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জন করায় সেই নির্বাচনে ৪৯ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। মোট ভোট গৃহীত হয়েছিল মাত্র ২১ শতাংশ। নির্বাচনের পর ষষ্ঠ সংসদ মাত্র ১১ দিন স্থায়ী ছিল। ঐ সংসেদ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল ’৯৬ (সংবধিানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা) গৃহীত হয়। আর বিগত দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-সহ ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করায় ১৫৩ আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, ৯ কোটি ১৯ লাখ ভোটাররে মধ্যে ভোট দেয়ার সুযোগ পান অবশিষ্ট ৪ কোটি ৩৯ লাখ এবং প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ৪০ শতাংশ। এর বীপরীতে অর্থাৎ সব দলের অংশগ্রহণে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে সে নির্বাচনে সবাই ভোট দিতে পারেন, নির্বাচনটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং সেই নির্বাচন গণতন্ত্রকে সুসংহত করে।

আমাদের সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আর এ নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তথা মানসম্মত। সাম্প্রতিক সময়ে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়াকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি কমিশনেরও দায়িত্ব রয়েছে, যা কমিশন এড়াতে পারে না।

আমরা দেখেছি যে, মূলত আপসের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক বাতিল না হওয়ায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে, যে কারণে সকল দলেরে অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। কারণ বর্তমান সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যেই পরবর্তী মেয়াদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং তা বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই। এই বিধান বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সবার জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা যাবে না। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে প্রতিযোগিতামূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

আমরা দেখেছি, অতীতে যে কয়টি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে তার সবগুলোতেই ক্ষমতাসীন দল জয়লাভ করেছে। এ ব্যবস্থায় সরকার বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। আর যে কয়টি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সবগুলোতেই সর্বশেষ ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হয়েছে। তাই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হওয়া জরুরি, যাতে নির্বাচনী মাঠের সমতল ক্ষেত্র তৈরি হয়, অর্থাৎ একটি ‘উইন উইন সিচুয়েশন’ তৈরি হয়, যারফলে সকল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে।

কানাডায় দেয়া বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে বা সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজনে সরকারের কী করণীয় রয়েছে এধরনের কোনো নির্দেশনা দেননি। তিনি ‘গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায়’ যথাসময়ে নির্বাচনের কথা বলেছেন। আমাদের হয়তো অনেকেরই স্মরণে থাকতে পারে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও ২০০৬ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে এমন বক্তব্য রেখেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচন অনুষ্ঠতি হয়েছে তারও দু বছর পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে।

আমরা জানি, গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। আর সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত ও র্কাযকর করবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। আমরা মনে করি, একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে (অনুচ্ছদে ১১৮) নির্বাচন কমিশন সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে পদক্ষেপ নিবে এবং সরকার এক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে। আর কমিশন ও সরকার যদি সকল দলের অংশগ্রহণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশ আবারও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের দিকে ধাবিত হবে, ব্যাহত হবে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন, যা আমাদের কারো কাম্য হতে পারে না। আমরা আশা করি, কমশিন ও সরকার এক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিবে।

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০১৮

Leave a Reply

Your email address will not be published.