আটকে গেল ঢাকা উত্তর সিটির নির্বাচন: দায় কার?

আইনি জটিলতায় পিছিয়ে গেল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপ-নির্বাচন ও সম্প্রসারিত অংশের কাউন্সিলর নির্বাচন। এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে আজ ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তিন মাসের জন্য স্থগিত করে দেয় উক্ত নির্বাচন। একইসঙ্গে ওই নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন গত ০৯ জানুয়ারি ২০১৭ যে তফসিল ঘোষণা করেছিল তাও কেন ‘আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত’ ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে মাননীয় আদালত রুল জারি করেছেন।

প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপ-নির্বাচন এবং নতুন সংযোজিত ১৮টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। একইসঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নতুন সংযোজিত ১৮টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচন। এছাড়াও একই সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার ছিল দুই করপোরেশনের ছয়টি করে ১২টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচন। কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ১৮ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ২৬ ফেব্র“য়ারি ২০১৮ তারিখে।

প্রশ্ন হচ্ছে, তফসিল ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরও কেন নির্বাচনটি স্থগিত ঘোষিত হলো? এর দায় কে নেবে?

আমরা দেখেছি, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন মহল থেকেই বলা হচ্ছিল যে, নির্বাচন কমিশন ও সরকার আইনের কিছু বিষয় ¯পষ্ট না করেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। যেমন, নির্বাচনী তফসিল ষোষণার সময় নির্বাচন কমিশন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নব-নির্বাচিত কাউন্সিলরদের মেয়াদ বিদ্যমান সিটি করপোরেশনের অবশিষ্ট মেয়াদের সম-পরিমাণ হবে বলে ঘোষণা দেয়। এক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্তের পেছনে যৌক্তিকতা থাকলেও এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। কারণ সিটি করপোরেশনের সম্প্রসারণের ফলে সম্প্রসারিত এলাকায় কাউন্সিলর পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, নব-নির্বাচিত কাউন্সিলরদের মেয়াদ কতদিন হবে তা আইনে স্পষ্ট করা নেই। এই অস্পষ্টতার সুযোগে স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং সংক্ষুব্ধ কেউ আদালতের শরণাপন্ন হলে নির্বাচনটি স্থগিত হয়ে যেতে পারে বলে আগে থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল।

এছাড়া স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ৫ (৩) উপধারায় বলা হয়েছে, “মেয়রের পদসহ করপোরেশনের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইলে এবং নির্বাচিত কাউন্সিলরগণের নাম সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হইলে, করপোরেশন, এই আইনের অন্যান্য বিধান সাপেক্ষে, যথাযথভাবে গঠিত হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।”

কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, উত্তর সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টির ওয়ার্ড ধরলে কাউন্সিলরের সংখ্যা পঁচাত্তর শতাংশ হয় না। কারণ নতুন ১৮টিতে নির্বাচনই হয়নি। সে হিসাবে মেয়র পদই গঠিত হয় না।

অনেকেই মনে করেন, সরকার এবং নির্বাচন কমিশন আইনের এসব স্পষ্টতা সম্পর্কে অবগত থাকলেও তা নিষ্পত্তি না করেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে।

০৯ জানুয়ারি ২০১৭ তফসিল ঘোষণা উপলক্ষে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকরা আইনি জটিলতার বিষয়টি নজরে আনলে মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেছিলেন, ‘ইসির কাজ নির্বাচন করা। নির্বাচনের পরে ‘হয়তো’ স্থানীয় সরকার বিভাগ মেয়াদ নির্ধারণ করবে। আর মামলা হলে ইসির কিছু করার নেই (প্রথম আলো, ১২ জানুয়ারি ২০১৮)।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সমন্বয়কারী ফারুক খানের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। এটা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (প্রথম আলো, ১০ জানুয়ারি ২০১৮)।’

প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান তাঁর এক নিবন্ধে (প্রথম আলো, ১২ জানুয়ারি ২০১৮) লিখেছেন যে, বিষয়টি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে সম্ভাব্য কোনো জটিলতা এড়াতে স্থানীয় সরকারকে অবহিত করেছি।’

কিন্তু আমরা নাগরিকরা এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। আইনি জটিলতার কারণে নির্বাচনটি স্থগিত হয়ে যেতে পারে এমনটা আশঙ্কা করে মিজানুর রহমান খান তাঁর নিবন্ধের শেষভাবে লিখেন, ‘আইনি জটিলতায় আসন্ন নির্বাচন আটকে গেলে ইসিকে দায়িত্বহীনতার একটা দায় নিতে হবে বলেই প্রতীয়মান হয়।’

সুজন–সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার গত ১৪ জানুয়ারি প্রথম আলোতে ‘আইনি জটিলতা দূর হবে কীভাবে’ শিরোনামে এক নিবন্ধ লিখেন। তিনিও তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আমরা আশ্চার্যন্বিত যে, আইনি…জটিলতা দূর না করে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছে। আমি নিজে এবং অন্যরাও এ আইনি জটিলতার কথা বেশ কিছু দিন ধরেই বলে আসছি। কেন নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার আগে সরকারকে নতুন ওয়ার্ড কমিশনারদের মেয়াদের বিষয়টি স্পষ্ট করতে বললো না তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। আরও বোধগম্য নয় কেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নির্বাচন করার সুপারিশ কমিশনে প্রেরণের আগে আইনি এই জটিলতাটি দূর করলো না। তাই ঢাকা সিটি করপোরেশনের, বিশেষত উত্তরের মেয়র পদে উপ-নির্বাচন যথাসময়ে করার ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা অযৌক্তিক হবে না, যা নিয়ে চারদিকে অনেকদিন থেকেই অনেক জল্পনা-কল্পনা চলে আসছে।’
উপরোক্ত ভাষ্য থেকে এটা নিঃসন্দেহে প্রতীয়মান হয়ে যে, তফসিল ঘোষণার আগে-পরে সবাই জানতেন যে, স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং সংক্ষুব্ধ কেউ আদালতের শরণাপন্ন হলে নির্বাচনটি স্থগিত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তারপরও কেন আইনি জটিলতার নিষ্পত্তি না করেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো? এর দায় কার উপর বর্তায়, পাঠক নিশ্চয়ই সহজেই অনুধাবন করতে পারছেন।
নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা হওয়ার তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘স্থগিত হলেও আমাদের কিন্তু কোনো অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে না। সিটি কপোরেশনের মেয়র মারা যাওয়ার প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল, সিটি করপোরেশন ভালোভাবেই চলছে, ওখানে প্যানেল মেয়র মহোদয় আছেন, উনি উনার কমিশনারদের নিয়ে ভালোই চালাচ্ছেন (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮)। ’
আমরা মাননীয় মন্ত্রীর উক্ত বক্তব্যের সাথে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করি। কারণ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বদলে প্যানেল মেয়র দিয়ে সিটি করপোরেশন চালানোর প্রচেষ্টা আমাদের সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘আইনুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ অর্থাৎ দেশের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের বা স্তরের শাসনকার্য পারিচালনার দায়িত্বে থাকবে সেখানকার আইনানুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের ওপর।
আমরা মনে করি, নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় নগরবাসী তথা ভোটাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আশা করি, আইনি জটিলতাগুলো কাটিয়ে মাননীয় আদালত, সরকার ও নির্বাচন কমিশন দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপ-নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হবেন।

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০১৮

Leave a Reply

Your email address will not be published.