সহিংসতা রোধ এবং শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় বহুদলীয় উদ্যোগ জরুরি

উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ বজায় রাখা। এ জন্য প্রয়োজন বিবদমান সামাজিক গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সম্ভাব্য সংঘাত শান্তিপূর্ণভাবে নিরসন করে তাদের সহাবস্থান নিশ্চিত করা; ধর্মীয় সহিংসতা ও উগ্রবাদ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের জেরে সারাদেশে যে সহিংস পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা নতুন করে আমাদের শান্তি বজায় রাখার লক্ষ্যে সংলাপ ও সমঝোতার গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।  

অতীতে সংঘটিত বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অভাবে কেন্দ্রীভূত বা এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা, উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাব, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থার অভাব ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতময় পরিবেশ বিরাজ করছে। এ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক মঞ্চে এনে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা অনেকটা তেলে-জলে মেশানোর মতো কঠিন ব্যাপার। তবে চাইলে কার্যকর কর্মসূচি, বিশেষ করে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের যুক্ত করে বহুদলীয় উদ্যোগের মাধ্যমে তৃণমূল বা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় রাখা সম্ভব।

আশার কথা হলো, আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাব্রতী সংস্থা দি হাঙ্গার প্রজেক্ট তৃণমূলে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার লক্ষ্যে উপজেলা পর্যায়ে বেশ কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে রয়েছে– স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ (এসপিএল), মাল্টি-স্টেকহোল্ডার ইনিশিয়েটিভ ফর পিস অ্যান্ড স্ট্যাবিলিটি (এমআইপিএস), নাগরিক, ভোটার অ্যাওয়ারনেস অ্যান্ড অ্যাকটিভ সিটিজেনারি, ফ্রিডম অব রিলিজিওন অর বিলিফ অ্যান্ড সোশ্যাল হারমনি প্রকল্প ইত্যাদি। এসব প্রকল্পের কার্যক্রমের ফলে সারাদেশে গড়ে উঠেছে একদল শান্তির দূত (পিস অ্যাম্বাসাডর), যারা পিএফজি (পিস ফ্যাসিলিটেটর গ্রুপ) ও পিএডিএন (পিস অ্যাম্বাসাডর ডিস্ট্রিক্ট নেটওয়ার্ক), প্যান (পিস অ্যাম্বাসেডর নেটওয়ার্ক), ওয়াইএজি (ইয়ুথ অ্যাম্বাসাডর গ্রুপ) ইত্যাদি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছেন। তারা এককভাবে ও সংঘবদ্ধভাবে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানের মানসিকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছেন এবং শান্তি, সম্প্রীতি ও সহাবস্থান নিশ্চিত করার কাজে যুক্ত করছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতৃত্ব এবং তরুণ সমাজকে। ইতোমধ্যে অনেক উপজেলায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মিলে ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ বা আচরণবিধি স্বাক্ষর করেছেন; শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের মধ্যে বিরোধ নিরসন ও বহুত্ববাদের মানসিকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন এবং সম্ভাব্য স্থানীয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন সংঘাত নিরসনে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পিএফজির অসংখ্য সফলতার গল্প তৈরি ও লেখা হয়েছে, যা এই ক্ষুদ্র লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে পরিচিত। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, সহনশীলতা ও সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ এ দেশ। কিন্তু ক্রমবর্ধমান আন্তর্দলীয় বিভাজন, রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি এবং ধর্মীয় উগ্রবাদের বিস্তার ঘটার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং ঐক্যবদ্ধ চেতনা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে; যা কারও কাম্য হতে পারে না। এ অবস্থার উত্তরণে দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশে একতা, সহনশীলতা এবং গণতান্ত্রিক আদর্শ চর্চার লক্ষ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে।

২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতার ব্যাপকতা দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে। পরে আরও দুটি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় এ সংকট কাটেনি। 
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিরোধের মোকাবিলা বা শেষ পরিণতি হিসেবে সাধারণত সহিংসতার পথকেই বেছে নেওয়া হয়। সুশাসনের সংকট, অর্থনৈতিক স্থবিরতা, উগ্রপন্থা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা কমানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, এমন উপলব্ধি থেকেই ‘সংঘাত নয়, সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ি’– এ স্লোগান সামনে রেখে দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট সহিংসতা নিরসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করে।

ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেক্টোরাল সিস্টেমের (আইএফইএস) সহযোগিতায় দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট প্রথমে ২০১৫ সাল থেকে ‘পিপল অ্যাগেইনস্ট ভায়োলেন্স ইন ইলেকশন (পেইভ)’ কার্যক্রম শুরু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক সহিংসতা কমানো এবং কীভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সংঘাত প্রতিরোধ ও প্রশমন করা যায়, সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধারণা দেওয়া। পেইভ কর্মসূচিটি প্রধানত একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম; যা অংশগ্রহণকারীদের সহিংসতার অন্তর্নিহিত কারণ, বিশেষ করে নির্বাচনী ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বুঝতে সহায়তা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এটি সমাজে সংঘাত মোকাবিলায় দক্ষতার সঙ্গে মানুষকে প্রস্তুত করার লক্ষ্য নিয়ে তিনটি ধাপে কাজ করে; যা সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপায় হিসেবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করে। এটি বিবদমান বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংলাপ সহজতর করার চেষ্টা করে এবং নির্বাচনী সহিংসতা প্রশমনের জন্য এসব প্রচেষ্টাকে বাস্তব উদ্যোগের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এই প্রশিক্ষণের প্রধান লক্ষ্য হলো অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নাগরিক সম্পৃক্ততার গঠনমূলক পদ্ধতির বোঝাপড়া বৃদ্ধি, সহিংসতা পরিহার এবং এই জ্ঞান তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম করা। শেষ পর্যন্ত কর্মসূচিটি গঠনমূলক ও অহিংস পদ্ধতিতে সংঘাত নিরসনের উপায় প্রচার করে, যা ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে।

আমরা মনে করি, আমাদের মধ্যে নানা মত-পথ থাকতে পারে, আদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের পরিচয় হলো, আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। তাই আমাদের দায়িত্ব হলো, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে যে দেশটাকে স্বাধীন করে গেছে, তাকে নতুন করে গড়ে তোলা।

লেখক: নেসার আমিন: সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ।

তথ্যসূত্র: https://samakal.com/opinion/article/252818/%E0%A6%B8%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A7-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82-%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AC%E0%A6%B9%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A7%9F-%E0%A6%89%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%97-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BF

Leave a Reply

Your email address will not be published.