উপজেলা নির্বাচনে বিজয়ী চেয়ারম্যানের ৭৬ শতাংশই ব্যবসায়ী কেন?

৮ মে ২০২৪ থেকে ৯ জুন ২০২৪ পর্যন্ত মোট পাঁচটি ধাপে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ৪৭৯টি উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে কয়েকটি উপজেলার নির্বাচন স্থগিত করা হয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৪৬৯টি উপজেলায়। নির্বাচন কমিশন ও সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ১ হাজার ৮৮৯ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৬২ জন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে ছিল ১৩০ জন। ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৪৬৯ চেয়ারম্যানের মধ্যে ১৭ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। নারী নির্বাচিত হন ১০, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে বিজয়ী হন ৩১ জন।

বিদ্যমান আইনানুযায়ী উপজেলা পরিষদ নির্বাচন দলীয় প্রতীকের ভিত্তিতে হওয়ার কথা। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার জোটভুক্ত দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। তাই নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখানোর কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি, দেয়নি দলীয় প্রতীকের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন। অর্থাৎ দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণকে দলটি উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। ফলে বেশির ভাগ উপজেলায়ই আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের মধ্যে। তাই এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনেকাংশেই নির্দলীয় অবয়ব পেয়েছে এবং ফলও হয়েছে একতরফা। ৪৭০টির মধ্যে ৪১৯টি (৮৯ দশমিক ১৫ শতাংশ) উপজেলায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এছাড়া ১৯টিতে বিএনপির বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী, সাতটিতে জাতীয় প্রার্থী (চারটি উপজেলায় দলীয় প্রতীকে), ১৩টিতে নির্দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং ১২টি অন্যান্য দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।

ভোটারদের ভোট কেন্দ্রবিমুখতাকে এবারের উপজেলা নির্বাচনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পাঁচ ধাপে গড়ে ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ভোটারদের কেন্দ্রবিমুখতার মূল কারণ নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থাহীনতা। বিশেষ করে নির্বাচনে বিএনপি না থাকায় এবং আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ হওয়ায় ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যেতে উৎসাহবোধ করেননি। 

বিগত নির্বাচনগুলোর মতো উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী এবং সম্পদশালীদের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়েছে। পাঁচ ধাপে চেয়ারম্যান পদে মোট ১ হাজার ২৬৮ জন (৬৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ) ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুলনায় ব্যবসায়ীরা বেশি হারে নির্বাচিত হয়েছেন। সুজন সচিবালয়ের তথ্যানুযায়ী, ৪৭০ জন (বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদসহ) বিজয়ী চেয়ারম্যানের মধ্যে ৩৬০ জন (৭৬ দশমিক ৬০ শতাংশ) ব্যবসায়ী, ৪৮ জন (১০ দশমিক ২১ শতাংশ) কৃষিজীবী, সাতজন (১ দশমিক ৪৯ শতাংশ) চাকরিজীবী এবং ১৯ জন (৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ) আইনজীবী। এছাড়া একজন (শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ) গৃহিণী এবং ২৮ জন (৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ) অন্যান্য পেশার সঙ্গে জড়িত। সাতজন (১ দশমিক ৪৯ শতাংশ) পেশার ঘর পূরণ করেননি। অন্য পেশাজীবীদের মধ্যে ১৫ জন (৩ দশমিক ১৯ শতাংশ) রয়েছেন শিক্ষক। 

বিজয়ী ৪৭০ চেয়ারম্যানের মধ্যে ১১২ জনের (২৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ) সম্পদের পরিমাণ ২৫ লাখ টাকার কম। সম্পদের ঘর পূরণ না করা একজনকে যুক্ত করলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৩ জনে (২৪ দশমিক শূন্য ৪ শর্তাংশ)। অন্যদিকে কোটি টাকার অধিক সম্পদের অধিকারী চেয়ারম্যান রয়েছেন ২২৭ জন (৪৮ দশমিক ৩০ শতাংশ)। স্বল্প সম্পদের মালিক (২৫ লাখ টাকার কম) ৩৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন; নির্বাচিতদের মধ্যে এ হার ২৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। অন্যদিকে অধিক সম্পদের মালিক ৩২ দশমিক ৬০ শতাংশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। নির্বাচিতদের মধ্যে এ হার ৪৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। এর অর্থ হলো অন্যান্য পেশার তুলনায় ভোটাররা ব্যবসায়ী ও সম্পদশালীদের বেছে নিয়েছেন বেশি। এই প্রবণতা ব্যবসায়ীদের সরাসরি নির্বাচনী রাজনীতিতে অধিক হারে সম্পৃক্ত হওয়ার লক্ষণ। 

বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিজয়ীদের অধিকাংশের পেশাই ছিল ব্যবসা (৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বা ২০০ জন)। উল্লেখ্য, ১৯৫৪ সালে সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব মাত্র ৪ শতাংশ হলেও ১৯৭৩ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১৮ শতাংশে, ১৯৭৯ সালে ২৪, ১৯৯৬ সালে ৪৩, ২০০১ সালে ৫৮, ২০০৮ সালে ৫২, ২০১৪ সালে ৬২, ২০১৮ সালে ৬৫ দশমিক ৩৩ শতাংশে, যা ক্রমবর্ধমান বিরাজনীতিকরণ ও রাজনীতির ব্যবসায়িকীকরণেরই প্রতিফলন। আমরা মনে করি, রাজনীতির এমন ব্যবসায়ীকরণের ফলে চরম স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই মূলত রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। 

প্রশ্ন হলো, রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রবেশে কেন এমন ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি? এর অন্যতম কারণ, আমাদের দেশে রাজনীতিই ক্রমাগত ব্যবসায় পরিণত হয়ে গেছে এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো হয়ে পড়েছে বহুলাংশে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটে। সংসদ সদস্য হতে আগ্রহী ব্যক্তিরা কোটি কোটি টাকা ‘বিনিয়োগ’ করেন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর তার বহু গুণ কামাই করেন তাদের পদপদবি কাজে লাগিয়ে। আমাদের বর্তমান ও নিকট-অতীতের সংসদ সদস্যদের অনেককেই মাত্র পাঁচ বছরের মেয়াদকালেই বিরাট অর্থ-বিত্তের মালিক হতে দেখা গেছে। 

বস্তুত রাজনীতি আর এখন জনসেবা নয়, অনেকটাই ব্যক্তি-গোষ্ঠী-কোটারি সেবার উত্তম উপায় হয়ে গেছে। ‘গ্রেসামস ল’ আমাদের রাজনীতিতেও কাজ করছে, খারাপ রাজনীতিবিদরা ভালো রাজনীতিবিদদের ক্রমাগত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিতাড়িত করছেন। এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতি হয়ে পড়েছে বহুলাংশে নীতি-আদর্শবিবর্জিত একটি স্বার্থন্বেষী কার্যক্রম। 

রাজনীতি ক্রমাগত ব্যবসায় পরিণত হওয়ার এবং রাজনীতিতে অধিক হারে ব্যবসায়ীদের প্রবেশের কারণে আমাদের দেশে শুধু রাজনীতির ব্যবসায়ীকরণই হয়নি, ব্যবসারও রাজনীতিকরণ হয়েছে। ফলে রাজনীতি এবং ব্যবসা কোনোটাই সঠিকভাবে চলছে না। এই প্রক্রিয়ায় আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমাগত কলুষিত হয়েছে। একইভাবে আমাদের জাতীয় সংসদ হয়ে পড়েছে বহুলাংশে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। আমাদের নীতিনির্ধারণও হয়ে পড়েছে ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত, যার মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের এবং অন্যান্য অনেক শ্রেণীর স্বার্থহানি হয়।

রাজনীতিতে টাকার খেলা আমাদের কলুষিত রাজনীতিরই ফসল। বর্তমানে মনোনয়নবাণিজ্য আমাদের দেশে একটি বিরাট সমস্যা। শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও এখন মনোনয়ন বাণিজ্য অনুপ্রবেশ করেছে। আর টাকার খেলা সহিংসতার জন্ম দেয়, যা তরুণ ও নারীদের রাজনীতিবিমুখ করে। আর আমাদের আজ হয়ে পড়েছে ‘বেস্ট ডেমোক্রেসি মানি ক্যান বাই’ টাকা দিয়ে কেনা যায় এমন উন্নত গণতন্ত্র, যা কোনো গণতন্ত্রই নয়।

রাজনীতিতে কালো টাকার ব্যবহারের ফলে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার থাকলেও তারা প্রতিনিধিত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত। অর্থাৎ আমাদের সাধারণ নাগরিকরা জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচনে ভোট দিতে পারলেও, তাদের পক্ষে এখন সংসদ সদস্য হওয়ার পথ পরিপূর্ণভাবে রুদ্ধ। ফলে এখন গণতন্ত্রের সেই কালজয়ী সংজ্ঞা ‘গভর্মেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল এবং ফর দ্য পিপলে’র ‘জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য সরকার’-এর ধারণা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে। ‘সিটিজেন লেজিসলেটর’-এর নাগরিক প্রতিনিধি কথা আর আমরা কল্পনাও করতে পারি না।

আমরা মনে করি, ব্যবসায়ীদেরও রাজনীতিতে প্রবেশ ও সংসদ সদস্য হওয়ার অধিকার আছে। তবে সেই অধিকার প্রয়োগ হতে হবে ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির পরিবর্তে জনকল্যাণের লক্ষ্যে। আর জাতীয় সংসদ হতে হবে সমাজের সব ক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্বের সমন্বয়ে ‘শুধু ব্যবসায়ীদের নিয়ে নয়’ যাতে রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে সব নাগরিকের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।

আমরা রাজনীতিতে নতুনদের প্রবেশেরও বিপক্ষে নই। আমরা মনে করি, রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করার জন্য রাজনীতির শিরা-উপশিরায় নতুন রক্ত সঞ্চালন করা দরকার। আর নতুনদের প্রবেশাধিকারের মাধ্যমেই তা নিশ্চিত করা যাবে।      

নেসার আমিন: লেখক ও সহযোগী সমন্বয়কারী, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)

তথ্যসূত্র: https://bonikbarta.net/home/news_description/391759/www.combank.net.bd

Leave a Reply

Your email address will not be published.