বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের কাঁটাগুলো

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্ব-অংশকে বিভক্ত করে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে ভারত তার নিকটতম প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের কাছ থেকে মৌলিক রণকৌশলগত স্বার্থ অর্জন করতে সক্ষম হয়। এতে ভারতের বিরাট স্বার্থ হাসিল হয়েছে এটি যেমন সত্য, একইসঙ্গে এটিও সত্য যে, ভারত যদি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা না করত তাহলে মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন করা হয়তো অসম্ভব হয়ে পড়তো। দেশটি সে সময় বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরনার্থীকে নিজ দেশে আশ্রয় দেয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করে দেয়। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বহির্বিশ্বের সমর্থন আদায়ের জন্য তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন, যা বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে, বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। তবে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর রাজনৈতিক যে পটপরিবর্তন হয়, তাতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের দিকও পরিবর্তন হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন গতি লাভ করে। যদিও অনেকেই মনে করেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সব সময়ই অধীনতামূলক। অর্থাৎ এ সম্পর্ক সবসময়ই ভারতের স্বার্থের দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। যেহেতু সম্পর্ক অধীনতামূলক, তাই সময়ের ধারাবাহিকতায় দু দেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় হওয়ার পরিবর্তে তৈরি হয়েছে কতগুলো কাঁটা। যে কাঁটাগুলো তৈরি হওয়ার পেছনে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা যতটা না দায়ী, তারচেয়ে বেশি দায়ী ভারতের বড় ভাই সুলভ আচরণ ও ছাড় না দেয়ার মানসিকতা।

দুই.
ভৌগোলিক বাস্তব অবস্থার কারণে বাংলাদেশ তিন দিক দিয়ে ভারত দ্বারা বেষ্টিত। বাংলাদেশ তার তিন দিকে ভারতের সঙ্গে ৪,০৯৫ কিলোমিটার যৌথ ভূমি সীমানা দ্বারা বেষ্টিত এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ পার্শ্বে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। দক্ষিণ দিক অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরে ভারত তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিশালী ও আধুনিক নৌবাহিনী গড়ে তুলেছে, যার কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ হতে সড়ক পথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ, মধ্য এশিয়ায় যাবার জন্য মিয়ানমারের ছোট্ট একটু পথ ছাড়া ভারতের ওপর নির্ভর করতে হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ সীমান্তরেখা থাকার কারণে দু দেশের মধ্য অবৈধ অভিবাসন, সীমান্ত পারাপারে সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক কার্যাবলী পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও দুটি দেশের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের বণ্টন নিয়েও সমস্যা বিদ্যমান। বাংলাদেশ নিম্ন নদী তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত হওয়ার কারণে নিয়মিত পানি প্রবাহের জন্য ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত ৫৪টি নদীর ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল, যেই নদীগুলো হতে আসা পানির ওপর বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনীতি ও পরিবেশগত ভারসাম্য নির্ভর করে।

পানির অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে সুদূর অুীতকাল থেকেই বাংলাদেশের প্রতি বৈষম্য অব্যাহত রেখেছে। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার গঙ্গা নদীর উপর বাঁধ তৈরি করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের গঙ্গা নদীর উপর এ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। তারপরও ভারত সরকার গঙ্গা বাঁধ প্রকল্প অব্যাহত রাখে। ভারতীয় সরকার গঙ্গা নদীর পানিকে ফেডার খালের মাধ্যমে হুগলি ও ভাগিরথী নদীতে প্রবাহের ব্যবস্থা করে, যা কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে ভারতীয় সরকার গঙ্গা বাঁধকে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে। ভারত সরকার গঙ্গা বাঁধ উন্মুক্ত করার পরে ১৯৭০ থেকে ৯০’র দশকে প্রতিবেশী দুটি দেশ অনেকবার আলোচনা চালিয়ে যায়। কিন্তু এ সমস্যার সমাধানে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশ গঙ্গা নদীর পানি সুষ্ঠুভাবে বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপন করলেও ভারত তাতে কোন ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর গঙ্গা নদীর পানি বন্টন নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখন দু দেশের সরকার পানি নিয়ে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নেয়ার কারণে সুনাম অর্জন করলেও বর্তমানে তার কোন বাস্তব প্রয়োগ নেই। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার বিদ্যমান বাকি ৫৩টি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করতে চাইলেও ভারত সরকার তা বারবার প্রত্যাখ্যান করছে।

এছাড়া ভারত সরকার সে দেশের পূর্বাঞ্চল হতে পশ্চিমের মরুপ্রবণ অঞ্চলে পানি সরবরাহ করার জন্য নদী সংযুক্তি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করলে প্রতিবেশী দু দেশের মধ্যে পানি নিয়ে বিভেদ আরও জটিল হয়ে পড়ে। ভারত সরকার মনে করে, গ্রীষ্মকালে হিমালয়ের যে পানি ভাটি অঞ্চলে প্রবাহিত হয় সে পানি অপচয় না করে নদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে যদি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে প্রবাহিত করা যায় তাহলে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে মরূপ্রবণতা কমবে এবং ভারতের জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে। ভারত সরকারের সাম্প্রতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০টি আন্তর্জাতিক নদী একত্রীকরণের মাধ্যমে ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল হতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানি সরবরাহ করা হবে। একইসঙ্গে এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো ৩৪ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ৭০-২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হবে। এটি হবে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও বৃহৎ পানি পরিকল্পনা। এই নদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ৩১টি সংযুক্তির মাধ্যমে ৩৬টি নদীকে যুক্ত করা হবে, যেখানে ৬০০টি খালের জন্য ৩,০০০ বর্গমাইল ভূমি খনন করা হবে, যার কারণে কমপক্ষে ৩০ লাখ লোক স্থানচ্যুত হবে ধারণা করা হচ্ছে।

ভারতীয় সরকার এই পানি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন ও অর্থায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই পানি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এই নদী সংযোগ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে ভারত জানায় যে, এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং এটি একটি পরিকল্পনাধীন প্রকল্প। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ভারত যদি এই নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তাহলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে যে পানি প্রবাহ আছে তার ১০-২০ ভাগ কমে যাবে, যার ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ ভূখণ্ড মরুভূমিতে পরিণত হবে এবং বাংলাদেশে সুপেয় পানির পরিমাণ কমে যাবে।

তিন.
বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে সীমানা সংক্রান্ত সমস্যা। মূলত ১৯৪৭ সালে যখন ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয় তখন থেকেই দুটি দেশের মধ্যে সীমানা সংক্রান্ত সমস্যার সৃষ্টি। এর কারণ হলো স্যার রেডক্লিফ মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে ভারত উপমহাদেশের মত একটি বৃহৎ এলাকার সীমানা চিহ্নিত করেন। এই সীমানা চিহ্নিতকরণ নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে যতটানা উত্তেজনা কাজ করে তারচেয়ে বেশি উত্তেজনার কারণ হলো দু দেশের মধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় অবৈধ অভিবাসন, পণ্য চোরাচালান এবং সীমান্তবর্তী অপরাধমূলক কর্মতৎপরতা।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান ছিটমহলগুলো উভয় দেশের মধ্যে সীমানাগত সমস্যার অন্যতম কারণ। দু দেশের সম্মত তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিটমহল ১১১টি এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলের সংখ্যা ৩২টি। ভারতের ছিটমহলগুলোর জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৫৮.৩ একর। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর জমির পরিমাণ ৭ হাজার ১১০.২ একর।

প্রসঙ্গত, ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ৩ বিঘা করিডোরের সার্বভৌমত্ব বাংলাদেশের কাছে এবং দক্ষিণ বেরুবাড়ির সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর ফলে দহগ্রাম এবং আঙ্গরপোতা ছিটমহলে বাংলাদেশিদের এবং দক্ষিণ বেরুবাড়িতে ভারতীয়দের যাতায়াতের পথ খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী শেখ মুজিবের আমলে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রস্তাবটি পাস করে ভারতকে দক্ষিণ বেরুবাড়ি হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু ভারত সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত এবং আইনগত প্রশ্ন তুলে তিন বিঘা করিডোর হস্তান্তরে অস্বীকার করে ভারত। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জনমত ভারতীয় সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে ভারত তিন বিঘা করিডোর ১২ ঘণ্টার জন্য খুলে দিতে রাজি হয়। ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ভারত তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে দিতে রাজি হয়। স্বাধীনতার ৪৩ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু দ্রুততম সময়ের মধ্যে বেরুবাড়ি ভারতকে প্রদান করলেও বাংলাদেশ আজও পায়নি দহগ্রাম আঙ্গরপোতা এবং তিনবিঘা করিডোর। কবে পাবে তাও অনিশ্চিত।

এরমধ্যে ২০০১ সালের ১২ এপ্রিল ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) দু দেশের সীমান্ত নীতিমালা লঙ্ঘন করে কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়িতে শূণ্য রেখার ৩০ গজ ভেতরে একটি পাকা সড়ক নির্মাণ করে। যদিও ১৫০ গজের মধ্যে কোন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না বলে সীমানা নীতিমালার উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশ বিডিআর বিএসএফ-এর সড়ক নির্মাণ কাজের প্রতিবাদ জানায় এবং অবিলম্বে সড়ক ভেঙে ফেলার অনুরোধ জানায়। পরপর তিন দিন প্রতিবাদ জানালেও বিএসএফ সড়কটি ভাঙার কোন উদ্যোগ নেয়নি। পরে ১৫ এপ্রিল বিডিআর বিএসএফ-এর পাদুয়া ক্যাম্পে হামলা করে। পাদুয়া হামলার প্রতিশোধ হিসেবে বিএসএফ ১৮ এপ্রিল রাতে রৌমারি সীমান্তের বিডিআর ক্যাম্পে সশস্ত্র হামলা চালায়। বিডিআর পাল্টা আক্রমণ করে। এ সময় বিডিআর ও বিএসএফ-এর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষে ১৬ জন বিএসএফ এবং ৩ জন বিডিআর সদস্য নিহত হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার কারণে দু দেশের সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়।

চার.
ভারত সরকার সেদেশে বাংলাদেশের অনেক অধিবাসী অবৈধভাবে বসবাস করার অভিযোগ এনেছে বেশ কয়েকবার। ভারত এই অবৈধ অভিবাসনকে বাংলাদেশ কর্তৃক জন আগ্রাসন বলে আখ্যায়িত করে। ভারত সরকারের মতে, বাংলাদেশের জনগণের অবৈধ প্রবেশের কারণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যা এবং মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ছে। বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানীর মতে, তিন মিলিয়ন বাংলাদেশি অধিবাসী ভারতে অবৈধভাবে বসবাস করছে। বাংলাদেশ সরকার ভারতের এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে বলে আখ্যায়িত করে।

২০০৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ২১৩ জন বাংলাদেশিকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমান্ত এলাকায় এনে ছেড়ে দেয়, যাদের মধ্যে ৬৮ জন নারী ও ৮০ জন শিশু ছিল Ñ যারা ছয় দিন সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসের পর ঐ স্থান হতে হারিয়ে যায়। ভারত সরকারের ভাষ্য হলো, বাংলাদেশের মানুষ অর্থনৈতিক কারণে ভারতে প্রবেশ করে থাকে। কিন্ত বাংলাদেশ সরকারের দাবি, সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ। তাই বাংলাদেশের মানুষ অর্থনৈতিক কারণে ভারতে প্রবেশ করে এর পিছনে কোনো যুক্তি থাকার কথা নয়।

পাঁচ.
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আর একটি বিতর্কিত বিষয় হলো এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশকে সন্ত্রাসে মদদ দানের জন্য দোষারোপ করা। ভারতের অভিযোগ হলো, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন পরিচালনায় সাহায্য করছে। ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে উভয় দেশের কর্মকর্তারা এক দেশের বিরুদ্ধে অন্যদেশের সন্ত্রাসে মদদ দানের অভিযোগ তোলেন। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের ভেতরে ১৯৪টি সন্ত্রাসী ঘাঁটি রয়েছে, যাদের বাংলাদেশ মদদ দিচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ দাবি করে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে এই রকম ৩৯টি সন্ত্রাসী ঘাঁটি রয়েছে ভারতে। ভারত তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনো তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারলেও বাংলাদেশ ৩৯টি ঘাঁটির প্রত্যেকটি সম্পর্কে তথ্য প্রমাণ ভারতকে প্রদান করে। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে ভারত বাংলাদেশকে উভয় দেশের সীমান্ত এলাকায় যৌথ অভিযান পরিচালনার প্রস্তাব দিলে বাংলাদেশ তার স্বার্থের কথা চিন্তা করে তা প্রত্যাখ্যান করে। এতে ভারত আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়।

ভারত বাংলাদেশ হতে অবৈধ অভিবাসন ঠেকানোর জন্য ভারত ও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানায় বেড়া নির্মাণ করছে। ভারতের এই আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী কাজের জন্য বাংলাদেশ প্রথম থেকেই প্রতিবাদ জানালেও ভারত ১,৩৫৭ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে। এছাড়াও দ্বিতীয় পর্যায়ে ২,৪২৯.৫ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ পরিকল্পনাধীন রয়েছে ভারতের।

ছয়.
সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রায়ই তিক্ত পরিবেশ তৈরি করে। ভারত থেকে গরু আমদানিসহ বিভিন্ন কারণে সীমান্তের নিকটবর্তী হলে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ নিরীহ বাংলাদেশিদের পাখির মত গুলি করে হত্যা করে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধের জন্য বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও ভারত তা আমলে নেয়নি। বিভিন্ন দ্বি-পক্ষিক বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধে একাধিকবার প্রতিশ্র“তি দেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করেনি ভারত। বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে হত্যা বন্ধ না হওয়ায় বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের মনে ভারতবিরোধী মনোভাবের জন্ম নিচ্ছে।

সাত.
বাণিজ্যিক দিক থেকে ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অংশীদার হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে ভারতের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০০১-০২ অর্থবছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯৬ কোটি ৮৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে দু দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছাড়িয়ে যায় ২৯১ কোটি ডলার। এ সময় ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি হয় ৩০ কোটি ৪৬ লাখ ইউএস ডলারের। এর বিপরীতে ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে ৩২১ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের পণ্য। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক  লেনদেনের অনুপাত হচ্ছে ১১:১।

মূলত, ভারতের আরোপিত বিভিন্ন শর্তের কারণে বাংলাদেশ তার পণ্য সে দেশে রফতানি করতে পারছে না। বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় ভারতকে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানায়। কিন্তু ভারত তার নিজের সৃষ্ট বাণিজ্য ঘাটতি নিরসনের জন্য বাংলাদেকে উদ্যোগ নেয়ার কথা বলে। অথচ বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি বাড়িয়ে এবং পণ্যের ওপর ধার্যকৃত অশুল্ক বাধা তুলে দিয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকায় যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় অবৈধ পথে যে বাণিজ্য পরিচালিত হয় তাও বাংলাদেশের প্রতিকূলে।

আট.
ভারত দীর্ঘদিন ধরেই একতরফাভাবে বাংলাদেশের কাছে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট দাবি করে আসছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের সুবিধার্থে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে চায়। এই সুবিধাটি পাওয়ার আশায় ১৯৯৯ সালে জুন মাসে দেশটি বাংলাদেশের ২৫ ক্যাটাগরির পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার একতরফা ঘোষণা দেয়। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা না হলেও সম্প্রতি ১০ জুলাই ২০০৮ ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদের সঙ্গে দেখা করে বলেন, ‘আমরা ট্রানজিট চাই এবং চেয়ে যাব।’ ভারতের দাবি, ট্রানজিটের পিছনে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই বরং এটি একটি অর্থনৈতিক বিষয়। সত্য প্রকৃত সত্য হলো- ভারতকে ট্রানজিট প্রদান করলে বাংলাদেশ ভারতের একতরফা বাজারে পরিণত হতে পারে এবং ভারতের বিদ্রোহীরা বাংলাদেশকে তাদের প্রতিপক্ষ ভেবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে।

পরিশেষে, ভারত বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী। দু দেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় হলে উভয় দেশই লাভবান হতে পারে। তাই উপরোক্ত সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা জরুরি। তবে বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে এক্ষেত্রে ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা অবশ্যই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই, কিন্তু দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তাকে দুর্বল করে নয়। এজন্য নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য ও কৌশলকে কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আসবে সত্যিকারের ভারসাম্য।

সামহোয়ারইনব্লগ ডটকম, ৮ এপ্রিল ২০০৯

Leave a Reply

Your email address will not be published.