বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়ন: বাধা যেখানে

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ  নিরীহ বাঙালি জনগণের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ, তারপর ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বুকে এক স্বাধীন-সার্বভৌম হিসেবে জন্ম নেয় স্বাধীনতা। কিন্তু দীর্ঘদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়নি পাকিস্তান।  এর বীপরীতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রাখে দেশটি। তবে সময়ের ধারাবাহিকতায় কমে আসে সে তিক্ততা। তৈরি হয় দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক।

রাষ্ট্র আকারে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম সম্পর্ক তৈরি হয় ১৯৭৪ সালে। এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি দেশটি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এ সময় (২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪) লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সফরে যান। সেই সময় দু দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে শেখ মুজিব ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টোর মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। একই বছরের ২৭ জুন জুলফিকার আলী ভূট্টো তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আসেন। মূলত তখন থেকেই দু দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয়।

১৯৭১ সালে নিরীহ বাঙালি জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা বাংলাদেশ কোনো দিন ভুলবে না। যে কারণে দু দেশের সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এ তিক্ত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আরও কিছু বিতর্কিত ও অমিমাংসীত বিষয় রয়েছে যেগুলো দু দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে বাধা হিসেবে কাজ করছে। বড় আকারে বলতে গেলে চারটি বিষয় সামনে চলে আসে। প্রথমটি হলো- ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া, দ্বিতীয়টি- বাংলাদেশ অবস্থানরত বিহারীদের ফিরিয়ে নেয়ার সমস্যা, তৃতীয়টি- পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পদ বণ্টন এবং চতুর্থটি হলো- দু দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক অসমতা।

১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে যে গণহত্যা চালানো হয় তার জন্য পাকিস্তান সরকার দুঃখ বা অনুতাপ প্রকাশ করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ঢাকা সফর করেন। এ সফরকালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ১৯৭১ সালের গণহত্যার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে তোলা হয়। কিন্তু নওয়াজ শরীফ এটিকে তৎকালীন সময়ের একটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীল ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেন। ২০০২ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পারভেজ মোশাররফ ঢাকায় এসে ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। পারভেজ মোশাররফের দুঃখ প্রকাশকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সন্তোষজনক হিসেবে গ্রহণ করে। তবে পারভেজ মোশাররফ ঢাকা ত্যাগের পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলে যে, আমরা পাকিস্তানের সরকারের কাছে গণহত্যার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলেছিলাম তাদেরকে দুঃখ প্রকাশ করতে বলা হয়নি। তবে পাকিস্তানের সরকার ক্ষমা না চাইলেও ২০০২ সালে পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের ৫১টি সংগঠন ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জনগণের নিকট ক্ষমা চায়। সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ঘটনার বিষয়ে তারা অবগত ছিলেন না এবং এ বিষয়টির জন্য পাকিস্তান সরকারের বাংলাদেশের কাছে পূর্বেই ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল। ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের ভাষ্য হলো, ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ বাংলাদেশি হত্যা ও দু লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়নি। এ পরিসংখ্যানটি বাস্তবে আরও অনেক কম। তাদের মতে, বাংলাদেশ সরকার যদি হত্যা ও ধর্ষণের প্রকৃত তালিকা দেয় এবং জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব ব্যাপকভাবে প্রচার না করে- তাহলে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি তারা বিবেচনা করে দেখবে।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্ক উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে কাজ করছে সেটা হলো বিহারীদের ফিরিয়ে না নেয়া। ১৯৭১ সালে যে সকল বিহারী ভারত থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আসে এবং সে সকল বিহারী বাংলাদেশে অবস্থান করছিলো তার সংখ্যা হলো ৫ লাখ ৪০ হাজার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তারা কেউই এ দেশের মূলধারার সঙ্গে মিশতে পারেনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিহারীরা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। স্বাধীনতার পর তারা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেনি এবং প্রায় সকলেই পাকিস্তানে ফিরে যেতে চেয়েছে। ১৯৭২ সালের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ত্রি-পক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে বসবাসরত পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ এ বিশাল সংখ্যক জনগণকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার মতো অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত অবস্থা পাকিস্তানের ছিলো না। ১৯৮২ সালে ১ লাখ ২৭ হাজার বিহারীকে পাকিস্তান ফিরিয়ে নেয়। ১৯৮৫ সালে সৌদিভিত্তিক ‘রাবিতা আল-আলম আল্-ইসলামী’ নামক একটি সংগঠনের সহায়তায় বাংলাদেশে বসবাসরত পাকিস্তানিদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বাংলাদেশে বসবাসরত পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এর কারণ হলো নওয়াজ শরীফের পর বেনজীর ভূট্টো ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনাটি পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেয়। ১৯৯৮ সালে নওয়াজ শরীফ পুনরায় রাবিতা’র সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। কিন্তু পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধুর জনগণ বিহারীদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেবার ব্যাপারে বিরোধিতা করে। বেলুচিস্তান বিহারীদের নিজ দেশে বসবাসের সুযোগ দেয়ার কথা বললেও প্রয়োজনীয় আর্থিক সংকটের কারণে তা বিহারীদের ফিরিয়ে নেয়া হয়নি।

২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে লাহোর হাইকোর্ট এক ঘোষণায় বলে, বাংলাদেশে যে সকল পাকিস্তানি বসবাস করছে তারা বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশে বসবাসরত পাকিস্তানিদের নিজ দেশে পুনর্বাসন করার জন্য নওয়াজ শরীফের সরকার একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করেছিলো, যেখানে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের আটটি জেলায় ১০ মিলিয়ন রুপি ব্যয়ে ৫,০০০ ইউনিটের একটি আবাসন প্রকল্প তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সবগুলো সরকারই পুরোপুরি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে না আসায় এ সমস্যার সমাধান হয়নি।

সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার যে ব্যাংক মূলধন ও গতিশীল সম্পদ প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈষম্য করেছে তার পরিমাণ হলো ৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার। পাকিস্তানের এই সম্পদ সঞ্চয় করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। বাংলাদেশ সরকার মনে করে, কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ভিত্তির ওপর করে এই সম্পদ বণ্টন করা উচিত। এই উপাদানগুলো হলোÑ (ক) জনসংখ্যা: জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে মোট সম্পদের অর্ধেক বাংলাদেশকে প্রদান করা; (খ) সম্পদের বণ্টনের ভিত্তিতে: তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানের মোট যে সম্পদ ছিলো তা দু ভাগে বিভক্ত করে অর্ধেক বাংলাদেশকে প্রদান করা; (গ) বৈদেশিক মুদ্রার ভিত্তিতে: ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে তার অর্ধেক পূর্ব পাকিস্তানকে দেয়া; অথবা (ঘ) সম্পদের অনুপাতে: ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যে সকল সম্পদ অর্জিত হয়েছে তার অর্ধেক পূর্ব পাকিস্তানকে দেয়া। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের যে সকল হস্তান্তরযোগ্য সম্পদ বা স্থাপনা নির্মিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে যেগুলো হস্তান্তরযোগ্য সেগুলো শুধু বাংলাদেশ পাবে। আর যেগুলো হস্তান্তরযোগ্য নয় সেগুলো বাংলাদেশ পাবে না।

বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইকবাল আহমেদ খানকে সম্পত্তি বণ্টনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘দু দেশের সম্পত্তি ভাগ-বণ্টন ও দেনা-পাওনার সম্পর্কে পাকিস্তান সরকার আলোচনা করতে চাইলেও বাংলাদেশ শুধু সম্পত্তির বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী। দু দেশ যখন একত্রিত ছিলো তখনতো শুধু সম্পত্তি ছিলো না, দেনাও ছিলো। সম্পত্তির বিষয়ে আলোচনা হলে দেনা নিয়ে কেন আলোচনা হবে না।’ দু দেশ এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারার কারণে দীর্ঘদিন পরও এ বিষয়টির সমাধান হচ্ছে না।

বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেকটা প্রতিকূল। বাংলাদেশ যেখানে প্রতি বছর ৩০.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য পাকিস্তানে রফতানি করে (২০০১-২০০২ সালের হিসাব অনুযায়ী), সেখানে পাকিস্তান বছরে ৯০.৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বাণিজ্য ঘাটতি এতো বেশি হবার কারণ হলো, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে যে দ্বি-পাক্ষিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তার অধিকাংশ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। যদি দুটি দেশ দক্ষতার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নে নীতিনির্ধারণ করতে পারে তাহলে বাণিজ্য ঘাটতি অনেকটা কমানো সম্ভব হবে।

উপরোক্ত চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের সমাধান করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে বাধা অনেকটাই দূরীভূত হবে। আর সমস্যার সমাধান তখনই করা সম্ভব হবে যখন দুটি পারস্পরিক সহমর্মিতা ও আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবে। এটা অনুধাবন করতে হবে যে, সম্পর্ক উন্নয়ন হলে দু দেশই অথনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারবে।

সামহোয়ারইনব্লগ ডটকম, ২৬ জুন ২০০৮

Leave a Reply

Your email address will not be published.