বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট: ধরন ও উত্তরণের উপায়

সারা বিশ্বব্যাপী এখন লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে জ্বালানির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। একটু রয়েসয়ে এই বিষয়কে ঘিরে ক্রমাগত তীব্রতর হওয়া সংঘাতের প্রকৃতিকে আবছা রেখে যাকে সাধারণত জ্বালানি নিরাপত্তা বলে হরহামেশা উল্লেখ করা হয়। রাজনৈতিক, সামরিক বা অর্থনৈতিক যে দিক থেকেই দেখি না কেন, আজকের দুনিয়ায় যে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ বা কৌশল প্রণয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে প্রত্যেকের পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রকাশ্যে অবতীর্ণ হচ্ছে স্বভাবতই সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পরাক্রমশালী দেশসমূহ। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিতটি আগের চাইতে এখন অনেকটাই ভিন্ন। পুরাতন পরাশক্তির সঙ্গে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

গত এক দশকে যে কয়টি যুগান্তকারী মোড় বদলের সূচনা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে সামনের সারির অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে এশিয়া ও ল্যাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের আবির্ভাব পাকাপোক্ত হয়ে যাওয়া। বিশেষত, চীন ভারত ব্রাজিলের মতো দেশসমূহের ক্রমবর্ধমান বিপুলায়তনের অর্থনীতি বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থার পুরানো চেহারাই পাল্টে দিচ্ছে। সেখানে তৈরি হচ্ছে নতুন সম্পর্ক ও সমীকরণ। শক্তির ভারসাম্য। আর এর প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে জ্বালানি নির্ভর অর্থনৈতিক উন্নয়ন মডেল। এখন পর্যন্ত সীমিত প্রাকৃৃতিক উৎস থেকে আহরিত অনবায়নযোগ্য জ্বালানিই এক্ষেত্রে এখনও প্রধান নির্ভরতা। ফলে, এর ওপর কর্তৃত্ব ও দখল কায়েমের নির্বিকল্প অনিবার্যতা অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলের চিরাচরিত প্রতিযোগিতামূলক রসদ প্রাপ্তির গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। যে কারণে জ্বালানি এখন খোলাখুলি জাতীয় নিরাপত্তা তথা প্রতিরক্ষা নীতির অংশীভূত।

এই বিরূপ বাস্তবতা, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ বা উঠতি অর্থনীতির জন্য যা আরও মারাত্মক প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। একদিকে চলমান শিল্পায়ন এবং উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সচল রাখার জন্য বর্তমান চাহিদার পরিপূরণে ত্বরিত ব্যবস্থা; অন্যদিকে আগামী দিনের সম্ভাব্য চাহিদা নিরূপণ করে সদূরপ্রসারী লক্ষ্যের আলোকে বিচক্ষণ পরিকল্পনা প্রণয়ন – উভয় ক্ষেত্রে আমরা – বাংলাদেশ অনেকদূর পিছিয়ে। নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ও সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য একটি সুসমন্বিত জাতীয় জ্বালানি নীতিমালা দরকার। একই সঙ্গে থাকা দরকার জাতীয়-সক্ষমতা বৃদ্ধির দিক-নির্দেশনা ও আগামী দিনের কঠিন প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কর্মপরিকল্পনা।

বিপদের মধ্যে সেই কাজটি তো পড়েই আছে, পরন্তু, অবকাঠামো উন্নয়নের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিই অপরিকল্পিত, এলোমেলো এবং সকীর্ণ ও কায়েমী স্বার্থের পাঁকচক্রে বারবার আটকা পড়েছে; এখন রীতিমতো বেহাল দশায় উপনিত করেছে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতকে। এক বিপর্যস্ত ও বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা।

বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্রমাগত কমছে: সর্বকালের তীব্র সংকট আসন্ন
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে জ্বালানি চাহিদা বেড়েছে। উৎপাদনশীল খাতের পাশাপাশি আর্থিক খাতে গতি সঞ্চার ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা সচল রাখতে দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে গড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট। অথচ সেখানে গড় উৎপাদন ৪ হাজার মেগাওয়াট। কাজেই মোট গড় ঘাটতির পরিমাণ ১ হাজার মেগাওয়াট। যে কারণে শিল্প খাতে বা গৃহস্থালি খাতে লোডশেডিং অনিবার্য হয়ে আছে। এবং উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বহু বছরের পুরানো হওয়ার কারণে এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা অনেক কমেছে, কমছে। এসব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে প্রায় সময় কোনো না কোনো ধরনের যান্ত্রিক ত্র“টি লেগেই থাকে। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পায়, এমনকি কোনো কোনো কেন্দ্রে উৎপাদন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। তখন লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও বেড়ে যায় এবং শিল্প উৎপাদন, বাণিজ্যিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে, জনজীবনে অসহনীয় বিপর্যয় নেমে আসে। বিদ্যুতের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল দেশের বিকাশমান শিল্পখাত ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামনির্ভর জনজীবনের এই সময়ে এমনতরো বিদ্যুৎ সংকটের চেয়ে জরুরি জাতীয় ইস্যু আর কী থাকতে পারে। তার ওপর, ক্রমাগত এই সংকট তীব্র হচ্ছে। পুরানো উৎপাদন কেন্দ্রগুলো ক্রমাগত অক্ষম হয়ে যাওয়া এবং নতুন কেন্দ্র স্থাপিত না হওয়ার যোগফলে।

ঝুঁকিতে বিনিয়োগ ও অর্থনীতি
বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থমকে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে যে সম্ভাবনা আছে, সেটি অর্জিত হচ্ছে না। নতুন বিনিয়োগও হচ্ছে না। যেসব শিল্প-প্রতিষ্ঠান চালু আছে সেগুলোও তার পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। অপ্রতুল জ্বালানি সরবরাহের কারণে শিল্প-কারখানাগুলোর উৎপাদন প্রায় ৫০ ভাগ কমে গেছে। বিনিয়োগের চিত্র খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক-এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে নভেম্বরে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে আগের বছরের তুলনায় ৪৮ শতাংশ। সমস্যার সমাধান না হলে বিনিয়োগ নিঃসন্দেহে আরও কমবে। শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে অনেক নতুন কারখানা চালু করা যাচ্ছে না। ঢাকা বা দেশের অন্যান্য স্থানের আরও খারাপ অবস্থা। বিনিয়োগ বোর্ড এবং বাংলাদেশ ব্যাংক-এর হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ৫০ কোটি ২০ লাখ ইউএস ডলার। এ বছর তা নেমে এসেছে ২৫ কোটি ৯০ লাখ ডলারে।

বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে জিডিপি’র প্রায় ২ শতাংশের মতো ক্ষতি হচ্ছে। এটি এখনও প্রযোজ্য। অর্থাৎ চলতি জিডিপি’র হিসাবে এটি প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার মতো। বর্তমানে বাংলাদেশ ৬ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের সমস্যা না থাকলে এটি ৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। বিদ্যুৎ ও গ্যাস ঘাটতির জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দেশের ক্ষতি হচ্ছে ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য উৎপাদনে ক্ষতি বছরে ৩ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা। আর গ্যাসের জন্য এ ক্ষতির পরিমাণ ৩ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। মোট প্রত্যক্ষ ক্ষতি ৬ হাজার ৯শ’ কোটি টাকা। এর বাইরে পরোক্ষ ক্ষতি হচ্ছে প্রত্যক্ষ ক্ষতির প্রায় আড়াই গুণ। এ হিসাবে এ অঙ্ক দাঁড়ায় ১৭ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও অন্য সরকারি সংস্থাগুলো থেকে জানা যায়, শিল্প-কারখানা খাতে বিদ্যুতের মোট চাহিদা প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু বাসাবাড়ি ও শিল্প-কারখানাসহ সব ধরনের গ্রাহককে সরবরাহ দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৭শ’ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বেশিরভাগ শিল্প-কারখানাই প্রতিদিন বেশ কয়েক ঘণ্টার লোডশেডিংয়ে পড়ছে। অন্যদিকে পেট্রোবাংলার সূত্রমতে, বর্তমানে শিল্প খাতে (ক্যাপটিভ পাওয়ারসহ) গ্যাসের সরবরাহ দৈনিক ১শ’ কোটি ঘনফুটের মতো। অথচ শিল্প-কারখানাগুলোতে গ্যাসের চাহিদা এর চেয়ে অনেক বেশি।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতের চিত্র
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর বড় কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে গত পাঁচ বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালন খাতে। বিতরণ ও সঞ্চালনের ওই পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল অপ্রয়োজনীয় ও পরিকল্পনার বাইরে। অপ্রয়োজনীয় খাতটি তৈরি করে খরচ দেখানো হয়েছিল। একটি মাত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেটি টঙ্গিতে স্থাপন করা হয়েছিল সেই ৮০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্র স্থাপনেও বিপুল পরিমাণ টাকা লুটপাট হয়েছে। নিম্নমানের কাজ ও দুর্বল মেশিনপত্রের কারণে কেন্দ্রটি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনের মাত্র ছয় ঘণ্টা পর বন্ধ হয়ে যায়। কেন্দ্রটি গত এক বছরে ৮১ বার বন্ধ হয়েছে এবং এখনও বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পুরো জোট আমলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মানোন্নয়ন ও মেরামত বাবদ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। মূলত কাজের কাজ কিছুই করা হয়নি। খুলনা শিকলবাহা কেন্দ্রটি মেরামতের নামে কয়েক বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত খুলনা ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তিন কিস্তিতে ৪৪৭ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। খুলনা ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৩শ’ কোটি টাকার মেরামত কাজ হয়েছে। শিকলবাহা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২৪ কোটি টাকা খরচ করে দু দফা মানোন্নয়ন করা হলেও উৎপাদন এক মেগাওয়াটও বাড়েনি। বরং ১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হয়ে জোট সরকার গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে অতিরিক্ত ১ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে। রাজধানীতে ডেসার বিদ্যুৎ উপসঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার সংস্কার প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, কনডাক্টর, সাবস্টেশন, খুটিসহ সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ ও পুনর্বাসনের জন্য ২৪০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেও এই খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৫৯ কোটি ৩৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। শুধু একটি খাতে অননুমোদিত অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে ২৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। অন্য একটি খাতে ৪৮ কোটি টাকার কাজে ব্যয় দেখানো হয় ৭৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৩৫০টি ট্রান্সফরমার ক্রয়ের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল রিসপনসিভ ও সর্বনিম্ন দরদাতাসহ দরপত্রে অংশগ্রহণকারী সব সরবরাহকারীর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের অনুমোদনক্রমে ১ হাজার ৩৫০টি ট্রান্সফরমার সরবরাহের কার্যাদেশ বণ্টন করা হয়, যা প্রতিযোগিতামূলক দর প্রাপ্তির জন্য সহায়ক ছিল না। ট্রান্সফরমার সংরক্ষণ খাতে ৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকার স্থলে ৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা খরচ করা হয়। দুর্নীতির কারণে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতাধীন কাপাই ঘাটের ইজারা বাবদ ১ কোটি ৩২ লাখ টাকার রাজস্ব হারিয়েছে পিডিবি। এছাড়া পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ডের ১২টি প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে প্রায় ২৭৩ কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের ৮৮টি উপজেলায় এই প্রকল্পের কাজ ছিল। রাজশাহী, রংপুর, যশোর, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও খুলনা অঞ্চলে প্রকল্পটির অধীনে বিদ্যুতের লাইন নির্মাণ, লাইন নবায়ন, বিদ্যুতের খুটি, ট্রান্সফরমার স্থাপন, অফিস ভবন ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক ভবন নির্মাণে এই টাকা লোপাট করা হয়েছে। পিডিবি’র আওতায় ১ হাজার ৩১১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রায় ১শ’ কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যন্ত্রপাতি ক্রয়, প্রশাসনিক ব্যয় ও ভৌত অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে বেআইনিভাবে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে এই দুর্নীতি করা হয়। নির্মিত প্রকল্পটির প্রাথমিক প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৫৪৮ কোটি টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে ওই প্রকল্প সম্প্রসারণ করে ১ হাজার ৩১১ কোটি টাকার ব্যয় পুননির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পে ৪৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫ হাজার ৫৬৪ মেট্রিক টন যন্ত্রপাতি ও মালামাল আমদানির অনুমতি থাকলেও বিদ্যুৎ বিভাগ ৪৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬ হাজার ৩২১ মেট্রিক টন যন্ত্রপাতি আমদানি করে। বাড়তি ৭৫৭ মেট্রিক টন যন্ত্রপাতি আমদানির কোনো অনুমতি ছিল না। ফেঞ্চুগঞ্জ ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পে দরপত্র মূল্যায়নে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সিরাজগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সর্বনিম্ন দরদাতাকে না দিয়ে বেশি দাম দিয়ে একটি বিদেশি কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। বাঘাবাড়ি ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পটি টেনে বড় করে লুটপাট করার অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্বে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া এই প্রকল্পটির সিংহভাগ কাজ ২০০১ সালে শেষ হয়ে গিয়েছিল। অক্টোবরে ক্ষমতায় এসে চারদলীয় জোট সরকার প্রকল্পটি টেনে বড় করে। এর মাধ্যমে কমপক্ষে ৭০ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯৯ সালে ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নেয়া প্রকল্পের সিংহভাগ কাজ শেষ হয়ে যায় ২০০১ সালে। জোট সরকার ক্ষমতায় এসে বুস্টার (গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র) নির্মাণের নামে প্রকল্প সংশোধন করে সরকারি কোষাগার থেকে আরও ১০০ কোটি টাকা বেশি তোলা হয়। গ্যাস বুস্টার নির্মাণে খরচ করা হয় মাত্র ৩২ কোটি টাকা। বিদ্যুতের গ্রাহক বিল আদায়ে ডেসার ২ হাজার কোটি টাকার কোনো হিসাব নেই। জোট সরকারের শেষ দিকে বিদ্যুৎ বিতরণ প্রকল্পের জন্য ২ হাজার কোটি টাকাসহ মোট ১৬টি প্রকল্পের জন্য ২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা খরচের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ১০ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ৩৩৫ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিতরণ কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য ১ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এছাড়া ৪৩৫ কোটি টাকা ব্যয় সংবলিত ডেভেলপমেন্ট অব নিউ ১৩২/৩৩ কেভি অ্যান্ড ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশন আন্ডার ডেসা প্রকল্প। ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন সঞ্চালন লাইন প্রকল্প, ২৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনা ঘাট/আমিনবাজার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্প, ৪০০ কোটি টাকার প্ল্যানিং অ্যান্ড এক্সপান্ডিং ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম ইন গুলশান প্রকল্প অন্যতম।

জোট সরকার বিদ্যুতের মোট উৎপাদন বাড়াতে কেন ব্যর্থ হলো? Ñ এমন প্রশ্নের জবাবে সে সময়কার বিদ্যুৎ সচিব আ.ন.হ আখতার হোসেন বলেন, ‘প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবেই তখন বিদ্যুতের মোট উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়নি। তবে জোট সরকারের আমলে টেন্ডার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে চুক্তি স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ভাড়া ও ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে গত এক বছরে জাতীয় গ্রিডে নতুন চার শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে। তাছাড়া জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পূর্বে যেসব প্রকল্পগুলো আর্থিকভাবে চুড়ান্ত করে গেছে তার বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পরবর্তীতে চালিয়ে নেয়া হয়নি।’

বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রথম বছর: কোনো কাজই হয়নি
যদিও বিগত সরকারের মতোই কেন্দ্রগুলোর মানোন্নয়ন ও মেরামত খাতে খরচের কমতি ছিল না কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথে কোনো ধরনের অগ্রগতি ছাড়া কেটে গেলো বর্তমান সরকারের প্রথম বছরটি। গত নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়মিতভাবে ৫,০০০ মেগাওয়াটে, ২০১৩ সালের মধ্যে ৭,০০০ মেগাওয়াটে ও ২০২১ সালের মধ্যে ২০,০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করবে। এ লক্ষ্যে মেয়াদের শুরুর দিকে এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার কথা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিল সরকার। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রাথমিক উদ্যোগেরও কোনো আলামত নেই। ওদিকে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ৫ দিন আগে অর্থাৎ ২০০৮ সালের শেষদিন ৩১ ডিসেম্বর সান্ধ্য পিক আওয়ারে বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ৩,৮৮২ মেগাওয়াট। আর এক বছরের ব্যবধানে ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে সান্ধ্যকালীন পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদন নেমেছে ৩,৬৯০ মেগাওয়াটে। মহাজোট সরকারের বছরপূর্তির দিন গত ৫ জানুয়ারি পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩,৫৬৩ মেগাওয়াট। এ চিত্র পাওয়া গেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিদ্যুৎ উৎপাদন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে। অর্থাৎ দায়িত্ব নেয়ার পর কাগুজে পরিকল্পনা এবং কিছু দরপত্র আহ্বান করতেই সরকারের একবছর লেগেছে।

হাস্যকর বিষয় হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এই অধোগতির চিত্র নিয়েও সরকার এ খাতে সাফল্য দাবি করছে। বলা হচ্ছে, এক বছরে জাতীয় গ্রিডে নতুন বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে ৪শ’ মেগাওয়াট। প্রকৃত চিত্র হচ্ছে, বিগত সরকার আমলে গৃহীত দরপত্র এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে চুক্তি স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ভাড়া ও ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে এক বছরে জাতীয় গ্রিডে ৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে। বিগত সরকার দুটোর কাজের ওই ফসলটুকু-সহই বর্তমানে উৎপাদন নেমে এসেছে গড়ে ৩৬শ’ থেকে ৩৭শ’ মেগাওয়াটে। অর্থাৎ এক বছর আগের তুলনায় প্রকৃত উৎপাদন কমেছে ৫শ’ থেকে ৬শ’ মেগাওয়াট।

সবমিলিয়ে এক বছরে পরিকল্পনা ও মহাপরিকল্পনার ফুলঝুরি ছড়ালেও বিদ্যুৎ খাতে বাস্তব অগ্রগতি শূন্য। আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে দেশকে লোডশেডিংমুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে ব্যয়বহুল তেলচালিত আটটি ভাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং আটটি পিকিং প্লান্টের দরপত্র আহ্বান করা হয়। ৫৩০ মেগাওয়াটের ৮টি তেলচালিত ভাড়া কেন্দ্রের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের শেষ তারিখ ছিল ২৯ নভেম্বর। এর ৫টি মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন পেলেও চুক্তি হয়নি এখনও। কবে চুক্তি হবে তাও সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছেন না। ১০টি পিকিং প্লান্ট স্থাপনের দরপত্র প্রক্রিয়ার অগ্রগতিও মন্থর। ফলে আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ সঙ্কট সর্বকালের ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সিস্টেম লস
বিদ্যুৎ সংকট আজ থেকে পাঁচ কিংবা দশ বছর আগে যে মাত্রায় ছিল, তা ক্রমশ বাড়ছে। কারণ সবমিলিয়ে উৎপাদন ক্রমশ কমছে। যেই হারে চাহিদা বেড়েছে, উৎপাদন সেই হারে বাড়ানো যায়ই নাই, বরং চাহিদা ও যোগানের মধ্যে দ্বিতীয়টি ক্রমশ নীচের দিকে নামছে। এতো গেলো উৎপাদনের ক্ষেত্রে সংকটের চেহারা, সংকট আছে বিতরণের ক্ষেত্রেও। চাহিদার তুলনায় অনেক কম উৎপাদন হচ্ছে, সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে এ বিষয়েও আমরা নিঃসন্দেহ যে, উৎপাদিত বিদ্যুতের যে পরিমাণ বিতরণ-মূল্য রাষ্ট্রের অর্থভাণ্ডারে আসার কথা, তার চেয়ে অনেক কম মূল্য রাষ্ট্র পাচ্ছে। অর্থাৎ কম উৎপাদনই শুধু নয়, রাষ্ট্রের হাতে যথাযথ রাজস্ব আয় তুলে অক্ষম বিতরণ ব্যবস্থাও সংকট তৈরি করছে।

তাতে করে উৎপাদন ব্যায় বাড়ছে, নতুন উৎপাদন ক্ষমতা তৈরি করা আর্থিকভাবে কষ্টকর হচ্ছে। যেই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়ে জাতীয় গ্রিড লাইনে যাচ্ছে, সেই পরিমাণ বিদ্যুতের মূল্য সরকারের হাতে আসছে না। সোজা মানে হলোÑ যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরকার তুলে দিচ্ছে বিতরণ সংস্থাগুলোর হাতে, ফিরতি হিসাবে ওই সংস্থাগুলো সরকারের হাতে ওই পরিমাণ বিদ্যুতের মূল্যের চেয়ে অনেক কম আয় জমা দিচ্ছে। তাহলে বাকি বিদ্যুৎ এর কী খবর? বিদ্যুৎ তো এমন কোনো পণ্য নয়Ñযা মজুদ করে রাখা যায়, কিংবাা বিতরণ লাইন থেকে স্রেফ হাওয়া যেতে পারে। বিদ্যুৎ নিশ্চয় ব্যবহার করে খরচ করতে হয়। গ্রাহক ব্যবহার কিংবা অপব্যবহার যা-ই করে বিদ্যুৎ খরচ করুক না কেন, সেই মূল্য আদায় করার দায়িত্ব তো বিতরণকারী সংস্থাগুলোর কাছে Ñ ডেসা, ডেসকো, পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎ ইত্যাদির কাছে। তারা ঠিক কী কারণে এই মূল্য বাবদ প্রকৃত রাজস্ব আয় সরকারের হাতে তুলে দিচ্ছে না? বিতরণকারী সংস্থাগুলোর তরফ থেকে একটা জবাব প্রস্তুত আছে – সিস্টেম লস।

এই সিস্টেম লস বিষয়টি আসলে ‘চুরি’। বিতরণকারী সংস্থাগুলো অবৈধভাবে গ্রাহকের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে, মিটার জালিয়াতি করে ওই গ্রাহকদের ব্যবহৃত বিদ্যুতের পরিমাণ কম দেখায় এবং স্বাভাবিক পরিণতিতে সরকারের খাতে কম বিল জমা পড়ে। তাছাড়া দাপ্তরিক হিসাবের বাইরে অবৈধ সংযোগ দেয়া তো আছেই। এভাবে বিল কমিয়ে দেখানো ও অবৈধ সংযোগ দেয়ার মাধ্যমে প্রতি বছর যে কোটি কোটি টাকা লোকসান হয় তা-ই ডেসা, ডেসকো আর পিডিবি’র ভাষায় সিস্টেম লস।

ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ-কারবার
প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ভারত সফরে চুক্তি করে এসেছেন যে, ওই দেশ থেকে প্রতিদিন ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। ভারতের প্রতিশ্র“ত ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশকে ২০১২ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আগামী দু বছরের মধ্যে বাংলাদেশে যে ঘাটতি এখনই অনুমান করা যাচ্ছেÑ তিন হাজার মেগাওয়াট ঘাটতির ওই সময়ে আড়াই শ’ খুব বেশি কিছু যোগান হবে না। কাজেই সংকট নিরসনে সরকার কী করছে? এই প্রশ্নের জবাবে ওই কারবারের ফিরিস্তি দিয়ে খুশি হওয়ার কিছু নেই। এই বিদ্যুৎ আনার জন্য বিতরণ লাইনসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত খাতে বাংলাদেশকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে, তা দেশের মধ্যে নতুন উৎপাদন চালু করার চেয়ে অনেকানেক বেশি ব্যয়বহুল ও লোকসানি হবে। এই বিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হবে ১,১০০ কোটি টাকা। বিদ্যুতের দাম পড়বে ইউনিট প্রতি পাঁচ টাকার উপরে। এই বিদ্যুৎ আমদানির জন্য আগামী দু বছরের মধ্যে এক আন্তঃদেশীয় গ্রিড লাইন স্থাপন করতে হবে। ভারতের বহরমপুর থেকে বাংলাদেশের ভেড়ামারায় ১৩০ কিলোমিটারের এই গ্রিড লাইনটি হবে। বাংলাদেশের অংশে ৪৫ কিলোমিটার ও ভারতের অংশে ৮৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন হবে। দু দেশের সঞ্চালন ব্যবস্থার পার্থক্যের কারণে বাংলাদেশের ভেড়ামারায় একটি বিশেষ সাব-স্টেশন স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশের ৪৫ কিলোমিটার অংশে বিদ্যুৎ লাইন স্থাপনে ব্যয় হবে ১,১০০ কোটি টাকা আর ভারতের ৮৫ কিলোমিটার অংশের ব্যয় হবে ২০০ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে বিদ্যুতের ট্যারিফ বেশি, এবং ভারত ভর্তুকি দিতে আগ্রহী হবে কিনা তা নিশ্চিত নয়।

অবশ্য যদি ভারত কম পরিমাণে হলেও ভর্তুকি দিতে রাজি হয় তাতে করেও শেষ হিসাবে তাদের বেলায় লোকসানের কিছু নেই। পুরাটাই লাভ। কারণ বর্তমানে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে ক্রমবিকাশমান শিল্পের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা যেভাবে ক্রমবর্ধমান, তাতে করে এই বিদ্যুৎ কারবার দেশটির খুবই কাজে আসবে। কারণ চুক্তি অনুযায়ী, ভারতের পশ্চিমাঞ্চল থেকে বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিড লাইনে বিদ্যুৎ আসবে, একই সঙ্গে এই জাতীয় গ্রিড পূর্ব সীমান্তে ভারতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হবে। মূলত ভারত আগামী ২০২০ সালের মধ্যে তার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে হাইড্রোলিক পাওয়ার প্লান্টসহ বিভিন্ন প্লান্টের মাধ্যমে কম খরচে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। উৎপাদিত বিদ্যুতের ২০ ভাগও তাদের ওইসব অঞ্চলে চাহিদা নেই। ফলে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ তারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তাদের পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে নিতে আগ্রহী। একবাক্যে বলা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডলাইনকে তারা ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে, পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়ার জন্য; তুলনামূলক বেশি দূরত্ব, প্রচুর ব্যয় ও নিরাপত্তা ঝুঁকি ইত্যাদি কারণে যে পরিচালন শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে হলে ভারতের জন্য অলাভজনক হতো।

সৌরবিদ্যুৎ
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারের প্রচার বিভাগ বলছে- ‘এটা সাশ্রয়ী জ্বালানি শক্তির এক অনন্য নজির, সবাইকে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে এগিয়ে আসতে হবে।’ গ্যাস, ডিজেল, ফার্নেস অয়েল, কয়লা ইত্যাদি ভিত্তিক উৎপাদনের চেয়ে সৌরবিদ্যুৎ যে সাশ্রয়ী সে বিষয়ে আমাদের সন্দেহ নেই। কিন্তু বিটিভি’র ভাষায় ‘আমরা দুঃখিত, বিদ্যুৎ বিভ্রাট প্রচারে বিঘœ ঘটায়’। যাদের লক্ষ্য করে এই পাবলিসিটি সেই পাবলিক নিশ্চয় এ ঘোষণা জানতে পারছে না, কারণ ওই সময়ে হয়তো অধিকাংশ স্থানেই লোডশেডিং। ছাপা মাধ্যমে জেনেশুনে পাবলিকের প্রতিক্রিয়া হচ্ছেÑ প্রধানমন্ত্রীর দফতরই আর জাতীয় গ্রিড লাইনের ওপর ভরসা করতে পারছেন না!

এ কথা সত্যি যে, শিল্প উৎপাদনে না হলেও অন্তত অফিস ও গৃহস্থালির বিদ্যুতের প্রয়োজন জাতীয় গ্রিড লাইনের ওপর ভরসা না করেই মেটানো সম্ভব। আর তা সম্ভব সৌরবিদ্যুতের ছোট ছোট প্যানেল বসিয়ে। শহরাঞ্চলের বাইরে চাহিদা কম হওয়ার কারণে সেটা আরও বেশি সম্ভব। যেমন বাংলাদেশের একটি দ্বীপ থানা এলাকাÑ মনপুরা’র পুরো বিদ্যুতের প্রয়োজন মেটানো হয় সৌরবিদ্যুতের প্যানেল ব্যবহার করে।

বাংলাদেশে গড়ে বছরে ২৫০-৩০০ দিন সূর্যালোক আসে, বর্ষার তিনমাস বাদ দিয়ে বাকি সময়ে সূর্যালোক যথেষ্ট নিরবিচ্ছিন্ন ও প্রখর। প্রতিদিনে গড়ে ৫ কিলোওয়াট-ঘণ্টা শক্তি বাংলাদেশের প্রতি বর্গমিটারে পাওয়া যায়। ভূপতিত এই সৌরশক্তির মাত্র ০.০৭% বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তর করা গেলেই বাংলাদেশের বিদ্যুতের চাহিদা মিটিয়ে ফেলা অনেকখানি সম্ভব হবে। সৌরবিদ্যুৎ পরিবেশ-বান্ধব ও একবার বিনিয়োগ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা গেলে রক্ষণাবেক্ষণের ন্যূনতম কিছু খরচ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের আলাদা কোনো খরচ নেই।

প্রাথমিক সমস্যার দিক হচ্ছে, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদক প্লান্ট বসানোর প্রাথমিক বিনিয়োগ অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তির তুলনায় অনেক বেশি। বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচের তুলনায় প্রায় দুই গুণ। সৌরশক্তি আহরণ করার প্রচলিত পদ্ধতি হলো সিলিকন নির্মিত ফোটোভোল্টেইক কোষ ব্যবহার করা। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সিলিকন বানাতে যতটা বিদ্যুৎ খরচ হয়, সে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ওই কোষের মোট প্রায় দুবছর সময় লাগার কথা। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক বিনিয়োগ উঠে আসতেও সময় তুলনামূলক বেশি লাগে।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবহার সর্বোচ্চ হলো মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে। এর মধ্যে মার্চ থেকে মে মাসে সেচের কাজেও বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। এই কারণে বিদ্যুৎ ঘাটতি এই তিন মাসেই সর্বোচ্চ হয়, যার ফলশ্র“তিতে লোডশেডিং, পরিণতিতে দুর্বিষহ কষ্ট। সেচের জন্য বিদ্যুৎও পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না। জলবিদ্যুৎ ও বায়ুশক্তি উৎপাদিত বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বর্ষাকালই হলো পিক সিজন Ñ এই সময়েই কাপ্তাই বাঁধে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, বায়ুশক্তি-চালিত টারবাইন বসানো হলে তাও এ সময়ে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। অন্যদিকে শীতকালে চাহিদা যথেষ্ট কম আর দিনের বেলায় লোডশেডিং-এর প্রভাব ততটা দুর্বিষহ হয় না, তবে সেচ কাজের যথেষ্ট সমস্যা হয়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে গরমকালের তিনমাসে বিদ্যুৎ ঘাটতি অন্যান্য সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ থাকে। সৌরবিদ্যুতের সুবিধা হলো এর পিক সিজন হলো গরমকালেই, কারণ গরমকালেই সূর্যের বিকিরণ সর্বোচ্চ হয়। এই সময়ে নিরবিচ্ছিন্ন-ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। আবার দিনের ২৪ ঘণ্টার বিদ্যুৎ ব্যবহারের মধ্যেও অন্য একটি প্যাটার্ন লক্ষ করা যায়। সৌরবিদ্যুৎ যদি সঞ্চয়ের কোনো ব্যবস্থা নাও করা হয় তাহলেও তা দিনের বেলাতেই সর্বোচ্চ হারে সরবরাহ করা যেতে পারে, যা সরাসরি সেচের কাজে ও কলকারখানা চালানোর কাজে লাগানো যেতে পারে। একইভাবে শীতকালে সেচের কাজের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়েই করা সম্ভব।

বাংলাদেশে মরুভূমি নেই, তবে সূর্য আছে, সূর্যের তেজও আছে। তাই প্রতিফলক বসিয়ে কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা খুব একটা শক্ত কাজ নয়। তবে এই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের আরও একটি সুবিধা আছে। একে সহজেই প্রচলিত তাপবিদ্যুৎ ব্যবস্থার হাইব্রিডের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলা যায়। বর্তমানেও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বয়লারে জল ফুটিয়ে বাষ্পশক্তি বানানো হয়। জল গরম করার পুরো শক্তিটিই আসে কয়লা বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। কিন্তু এই জলকে যদি কেন্দ্রীভূত সৌরশক্তির মধ্যে দিয়ে আনা যায় তাহলে এর উষ্ণতা আগেই বৃদ্ধি পাবে, ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা বা গ্যাস কম পোড়াতে হবে। অথবা, কিছু পরিমাণ জলের বাষ্পীভবন সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে করা হবে, বাকিটা জ্বালানি পুড়িয়ে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো আছে সেগুলোকে প্রয়োজনে এইভাবে হাইব্রিডে রূপান্তর করা সম্ভব। ভারতেও অনেক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে সৌরতাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরিবর্তিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এতে সৌরশক্তি ২০-৫০% অবদান রাখতে পারে। বর্ষায় সূর্যের তেজ কমে গেলে বেশি জ্বালানি ব্যবহার হবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে, গরমকালে বা শীতকালে জ্বালানির প্রয়োজন কমবে। একইভাবে, সৌরশক্তি ধরে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই, জ্বালানির যোগান সন্ধ্যার পরে বাড়িয়ে দিলেই হবে, আপনা হতেই বিদ্যুৎ উৎপাদন অপরিবর্তিত থাকবে।

ইউরোপের পরমাণু-গবেষণাগারের প্রধান নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্টেনবার্জার সম্প্রতি দাবি করেছেন যে, বায়ুশক্তির তুলনায় সৌরতাপ শক্তি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও ভবিষ্যতে দ্বিতীয়টির সাফল্যের সম্ভাবনাই বেশি। সৌরতাপ সম্ভাবনার ম্যাপে বাংলাদেশকে ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলের মত “সম্ভাবনাময়” হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি।

কল-কারখানাগুলো সৌরবিদুতের মাধ্যমে তাদের বিদ্যুতের চাহিদা মিটাতে পারে। তবে দেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সহজ করার জন্য অল্প মূল্যে সৌর প্যানেল উদ্ভাবন ও উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ দিতে হবে। কৃষি ক্ষেত্রে শুষ্ক মৌসুমে যেসব অগভীর নলকূপ রয়েছে সেগুলো যাতে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পরিচালনা করা যায়, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মাটির নীচের পানি উত্তোলন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হবে। না হলে পরিবেশের বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব নয়। মোটকথা হলো সরকার যদি চিন্তা করে তাহলে সৌরবিদুতের মাধ্যমেই বিদ্যুতের মোট উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়াতে পারে।

বর্তমান বিদ্যুৎ ঘাটতি, উৎপাদন ও বিতরণ অব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার মাত্র চল্লিশ শতাংশ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতাভুক্ত Ñ প্রতি একশ জনে চল্লিশ জন বিদ্যুৎ ভোগ করেন, গড়ে প্রতি জন ভোগ করেন ১৪০ ইউনিট বিদ্যুৎ। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগ মুহূর্তে জনগণকে প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলÑ ২০১১ সালের মধ্যে ৫ হাজার মেগাওয়াট, ২০১৩ সালের মধ্যে ৭ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০২১ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। কিন্তু সরকার সম্প্রতি বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের জন্য শুধু কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা ছাড়া নিজের জায়াগায় দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে এখনো পর্যন্ত বিশেষ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি। সরকার যথেষ্ঠ সময়ও পেয়েছে। কারণ গুরুতর এই জাতীয় সংকট মোকাবিলায় প্রাথমিকভাবে কিছু ফলাফল হাতেনাতে তুলে দিতে একটি দক্ষ ও সদিচ্ছাসম্পন্ন সরকারের জন্য ১৫ মাস মোটেও খুব কম সময় নয়। অন্যদিকে সংকটের তীব্রতা কমে আসারও কোনো লক্ষণ এখনো সাধারণ মানুষ দেখতে পাচ্ছে না। সংকটের তীব্রতা হ্রাস না পেয়ে বরং তা আরও বেড়েছে।

বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে সরকারের উদ্যোগ ও বাস্তবতা
পদক্ষেপ নেয়ার অংশ হিসেবে চাহিদা ও সরবরাহ নির্ধারণেও সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা নেই, দেশীয় পর্যাপ্ত দক্ষ লোক থাকা সত্ত্বেও বিদেশি পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে অর্থের অপচয়, আর্থিক সুবিধা গ্রহণের উদ্দেশ্যে বিতরণ লাইনের ভারসাম্যহীন বিস্তার, পিএমএমপির লঙ্ঘন, প্ল্যান্টের আকার, প্রকৃতি ও স্থান নির্ধারণ নিয়ে রাজনীতিকরণ করা ছাড়াও বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়, প্ল্যান্ট স্থাপনে নিম্ন মানের যন্ত্রপাতির ব্যবহার-সহ দুর্নীতি পুরা বিদ্যুৎ খাতকে ধ্বংস করেছে। ফলে সরকার বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ কাজের কাজ না করে বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য বর্তমান সরকারও যথারীতি বিগত সরকারের কার্যক্রমকে দায়ী করছে।

লোডশেডিং মুক্ত দেশ গড়তে বর্তমান সরকার যে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে সময়মতো তার বাস্তবায়ন অনিশ্চতায় পড়তে পারে। এদিকে বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সংকটও তীব্র হচ্ছে। জাতীয় উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে লোডশেডিংমুক্ত করার যে ঘোষণা দিয়েছে, সে বিষয়েও সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের পর থেকে দেশে কোনো লোডশেডিং হবে না। এই সময়ের মধ্যে ৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এর জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকা। মহাপরিকল্পনায় বছরভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, চলতি বছর চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে পার্থক্য অর্থাৎ ঘাটতি ১ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। ২০১০ সালে ঘাটতি হবে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। ২০১১ সালের পার্থক্য ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। ২০১২ সালে ১ হাজার ৮৫০ মেগাওয়াট। ২০১৩ সালে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট এবং ২০১৪ সালে ঘাটতি হবে ১ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। কিন্তু যদি গ্যাস না পাওয়া যায় তাহলে ২০১৪ সালে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ হাজার মেগাওয়াট।

সরকার নতুন কেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়েও বড় পরিকল্পনা হাতে নেয়। সে অনুযায়ী চলতি মাসের প্রথমার্ধের মধ্যে দুটি পর্যায়ে সারা দেশের গ্রাহকদের মধ্যে বিনামূল্যে মোট দুই কোটি ৬৫ লাখ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাল্ব বিতরণ করার কথা ছিল। এতে প্রায় ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে বলে সরকারিভাবে জানানো হয়। বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে সরকার বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাল্ব বিনামূল্যে বিতরণের যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে তা অবশ্যই সুফল বয়ে আনতো। শুধু ঢাকা শহরের রাস্তার বাতিগুলোর পরিবর্তে এই এলইডি বাল্ব ব্যবহারেও দৈনিক ১১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্ভব। কিন্তু এই উদ্যোগও আপাতত কার্যকর হচ্ছে না।

জরুরি ভিত্তিতে ঘাটতি মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের প্রথম পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ হলো বেসরকারি খাতে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন। যদিও বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ই এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার কয়েকটি ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপও নেয়। তবুও বর্তমান সরকার জরুরি ভিত্তিতে মোট ৫৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটি ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় নয় মাস পর।

ইতোমধ্যে সেচ মৌসুম কাছে চলে আসায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, চার মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য ডিজেলচালিত কয়েকটি ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। বাকিগুলো হবে ফার্নেস তেলচালিত। ডিজেলচালিত কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে প্রায় ১৫ টাকা, যা ফার্নেস তেলচালিত কেন্দ্রের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। তারপরও জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য ওই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। কিন্তু চলতি সেচ মৌসুমে এর এক ইউনিট বিদ্যুৎও পাওয়া যাচ্ছে না। দেশীয় উদ্যোক্তারা মনে করছেন, বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ দ্রুত না করে সরকার বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় ভাড়াভিত্তিক ছোট ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর যে পরিকল্পনা করছে তাতে বিদ্যুৎ সমস্যা কাটবে না। দেশীয় প্রযুক্তিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে বর্তমান সংকটের সমাধান সম্ভব। অন্যথায় এ সংকট আরও বাড়বে।

বাংলাদেশে আজ বিদ্যুতের যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তার গোড়ার কারণ হলো এ দেশে কখনো সমন্বিত জ্বালানি নিরাপত্তা, নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়নি। এ পর্যন্ত যা হয়েছে তা বিচ্ছিন্নভাবে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও জ্বালানি বিভাগের কাজের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার ছয় শতাংশের কাছাকাছি। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা না হলে তা সাত শতাংশে চলে যেত। প্রবৃদ্ধির এই হার ধরে রাখতে হলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

চিন্তা, ৮ এপ্রিল ২০১০

Leave a Reply

Your email address will not be published.