কোম্পানিগুলোই বলছে বিদ্যুৎ সমস্যায় ভাড়া বিদ্যুৎ কোনো সমাধান নয়

কয়েক দফা সময় বাড়ানোর পরও ভাড়া বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো উৎপাদন শুরু করতে পারছে না। দ্রুততম সময়ে বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা বলে নানা অনিয়মের অভিযোগের মধ্যে ভাড়া বিদ্যুতের অনুমোদন দিলেও এ পর্যন্ত মাত্র তিনটি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে, তাও নির্ধারিত সময়ের অনেক পর। যন্ত্রপাতি আমদানি, জমি পাওয়া, নির্মাণ ও মাটি ভরাটজনিত সমস্যা, জ্বালানি তেল রাখার সমস্যা এবং ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ঝামেলা – সর্বোপরি কোম্পানিগুলোর অদক্ষতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে ভাড়া বিদ্যুতের উৎপাদন অনিশ্চিত। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোই বলছে যে, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে ভাড়া বিদ্যুৎ কোনো সমাধান নয়।

অভিজ্ঞতা ও অর্থায়নের অভাবে আটকে ভাড়া বিদ্যুৎ, বাড়ছে ভর্তুকি
সরকার ভাড়াভিত্তিক বেশিরভাগ কোম্পানিকে কোনরকম দরপত্র ছাড়াই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছিল। সরকারের যুক্তি ছিল- দরপত্রের ঝামেলা এড়িয়ে কোম্পানিগুলো দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনে আসতে পারবে। কিন্তু এখনো ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতের অধিকাংশ কেন্দ্রের কাজ লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেনি। কারণ ভাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে সাত শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও উৎপাদনে এসেছে মাত্র চার শ’ মেগাওয়াট। তবে নর্দান পাওয়ার সলিউশন লিমিটেড-এর সহকারি ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুলতান আহমেদ তাঁর প্রকল্পের পক্ষ নিয়ে জানিয়েছেন, তারা সাধ্যমত উৎপাদনে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এখন পর্যন্ত তারা ৬৫ ভাগ কাজ শেষ করেছেন।

ভাড়াভিত্তিক বেশ কয়েকটি কোম্পানি তাদের ব্যর্থতার জন্য শর্তানুসারে গত মার্চ মাস পর্যন্ত প্রায় ১৫০ কোটি টাকা জরিমানাও দিয়েছে। যেসব কোম্পানি সময়মত উৎপাদনে যেতে পারেনি, তাদেরকে প্রতিদিন প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য ৫ মার্কিন ডলার জরিমানা দিতে হচ্ছে। দেশ এনার্জি লি. এর প্রকল্প সমন্বয়কারী যাকিল হক স্বীকার করে বলেন, ‘হ্যাঁ, জরিমানা দিতে হয়েছে।’ তিনি মনে করেন, ১০০ মেগাওয়াটের একটা বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র তিন মাসে কোনোমতেই নির্মাণ করা সম্ভব হয় না। এছাড়া জমি পাওয়ায় ধীরগতি, জমির মাটি পরীক্ষা এবং সেখানকার আবহাওয়া ইত্যাদি সমস্যাকে সময়মত বিদ্যুৎ উৎপাদনে আসতে বাধা মনে করেন জনাব হক। তিনি বলেন, ‘বর্ষাকালে এখানকার মাটি এত নরম যে, ১০০ ফিট করে এক একটা পাইলিং করতে হয়েছে। এখানেই আমরা দেড় মাস পিছিয়ে গিয়েছি।’ এর সঙ্গে তিনি কারিগরি সমস্যার কথাও বলেছেন। কারিগরি এবং বর্ষার কারণে মাটি নরম হওয়ার সমস্যা ছাড়াও যন্ত্র-মেশিন পরিচালনা-মেরামতে কারিগরি দক্ষতার অভাব আছে কি না তার কথায় তা পরিষ্কার নয়। তিনি দাবি করে বলেন, ‘আমরা মনে করি, আমাদের যথেষ্ট কারিগরি দক্ষতা আছে। আমরা আরও কয়েকটি নতুন কেন্দ্র নির্মাণ করতে চাই।’

সরকার ক্ষমতায় আসার পর চলমান বিদ্যুৎ সংকট কাটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে এ পর্যন্ত ৩৩টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চার থেকে পাঁচটি চুক্তি হয়েছে ২০০৯ সালে। বাকি চুক্তিগুলো হয়েছে ২০১০ সালে। এর মধ্যে সরকারি খাতে ১৩টি। ১৬টি দ্রুত ভাড়াভিত্তিক (কুইক রেন্টাল) বেসরকারি খাতে। আর চারটি ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে ২ হাজার ৯ শ’ মেগাওয়াট। চড়ামূল্যের এ ভাড়াভিত্তিক প্রকল্পগুলো থেকে সরকার তিন থেকে পাঁচ বছর বিদ্যুৎ কিনবে।

অন্যদিকে এসব কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ নিয়ে খোদ বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ই অভিযোগ তুলেছে। অনেকে এরজন্য বিদ্যুৎ খাতে কোম্পানিগুলোর অনভিজ্ঞতাকে দায়ী করেছেন। ফলে এখন ভাড়া এবং দ্রুত ভাড়াভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সময়মত উৎপাদনে আসতে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এমন আশঙ্কার কথা খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কমিটির ২২তম বৈঠকে প্রকাশ করা হয়। কমিটির সভাপতি সুবিদ আলী ভূঁইয়া ওই বৈঠকের শৈষে জানানÑ এসব কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হবে না। তিনি আরও বলেছেন, কমিটিকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টগুলোর মধ্যে বেশকিছু প্লান্টের নির্মাণকাজ শেষ হতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি লাগবে। তবে তিনি জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই প্লান্টগুলো স্থাপনের কাজ শেষ করার জন্য কমিটি মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিয়েছে। অপরদিকে একই কমিটির বিরোধীদলীয় সদস্য এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন অভিযোগ করে বলেন, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন না মেনে সরকারদলীয়দের কাজ দেয়ার ঘটনা হতাশাজনক। এক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

জমি পাওয়া নিয়ে সমস্যা পোহাতে হয়েছে বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে। এতে কোন কোন কোম্পানি নিজে জমি ঠিক করতে দেরি করেছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে পিডিবিই জমি দিতে দেরি করেছে। কোন কোন কেন্দ্রে ধীরগতিতে মাটি ভরাট হয়েছে। আবার কোথাও জমি কেন্দ্র উপযোগী না থাকায় পাইলিং করতে দেরি করেছে। কেরানীগঞ্জে পাওয়ার প্যাক-এর এক শ’ মেগাওয়াটের কেন্দ্র, যশোরের নোয়াপাড়ায় ভলকান এনার্জির ৪০ মেগাওয়াটের কেন্দ্র ও নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে পিডিবি পাওয়ার টেকনোলজির এক শ’ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে। যে কারণে তারা সময়মত উৎপাদনে আসতে পারবে না। আবার কোন কোন কেন্দ্রে রয়েছে জ্বালানি তেল রাখার সমস্যা। দেশ এনার্জি লি. এর জনাব হক জানিয়েছেন, সাধারণত পিডিবির নিজস্ব জমি থেকেই জমি দেয়া হয়েছে কোম্পানিগুলোকে। তবে সব এলাকায় নিজস্ব জমি না থাকায় কিছু কিছু কোম্পানিকে জমি দেয়া সম্ভব হয়নি। তাতে ওইসব কোম্পানিকে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। আবার যেসব জায়গায় জমি আছে সেসব জায়গায় সেগুলোকে উৎপাদন কেন্দ্রের উপযোগী করে তোলার মত ব্যবস্থা নেই।

বেশিরভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে চীন, ফিনল্যান্ড সহ অন্যান্য দেশ থেকে। আমদানির ক্ষেত্রে পুরানো যন্ত্র ও মেশিনারিজ আনার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কোম্পানিগুলো। যাকিল হক জানালেন, ‘আমাদের কথা আমরা বলতে পারি যে, আমরা ব্র্যান্ডের নতুন যন্ত্রপাতি আমদানি করেছি। আমাদের কোম্পানি স্বচ্ছতা ও গুণগত মানের নিশ্চয়তায় বিশ্বাস করে। পুরানো যন্ত্রপাতি এনে আমরা বাজে কাজ করতে চাই না। তবে দেশীয় বেশ কয়েকটি কোম্পানি আছে যারা পুরনো যন্ত্রপাতি আমদানি করছে। এরফলে তারা যথাযথ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে না। কিছু কিছু কোম্পানিকে আমি নিজে দেখেছি। কিন্তু আমি তাদের নাম উল্লেখ করতে চাই না।’ তবে চীন থেকে আনার কথা স্বীকার করে এসব যন্ত্রের ব্যাপারে তিনি দাবি করে বলেন, ‘এগুলো আমেরিকায় তৈরি। আমেরিকা থেকে প্রথমে এগুলো চীনে আসে। তারপর বাংলাদেশে আমরা ক্রয় করে নিয়ে এসেছি।’

একইভাবে নর্দার্ন পাওয়ার সলিউশন লিমিটেড-এর সহকারি ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুলতান আহমেদও চীন থেকে আনার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, তাদের কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি ফিনল্যান্ড এবং চীন থেকে আনা হয়েছে। তবে তিনি দাবি করে বলেন, ‘আমাদের আমদানি করা সব যন্ত্রপাতিই ব্র্যান্ডের এবং নতুন। আমরা অধিকাংশ যন্ত্রপাতি ইতিমধ্যে আমদানি করে ফেলেছি।’

দেরিতে উৎপাদনে যেতে জ্বালানি ও অন্যান খরচ, ব্যাংক ঋণ ও যন্ত্রপাতির আমদানি সহ ইত্যাদি সমস্যাকে অন্যতম বড় বাধা মনে করছেন ভাড়াভিত্তিক এসব বেসরকারি কোম্পানি। এরসঙ্গে তারা কাস্টমসের ঝামেলার কথাও বলেছেন। তারা প্রথমত অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়ার কথা বলেছেন। জনাব হক বলেন, ‘সরকার যদি আমাদের মত বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে ঋণ দেয়ার জন্য ব্যাংকগুলোর জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করে দেয়, তাহলে ঋণ পেতে সহজ হবে।’ কারণ ‘ব্যাংক ঋণের জন্য আমরা এগেঠতে পারছি না।’ তাঁর মতে, বিনিয়োগ বান্ধব অর্থায়ন জরুরি। ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ সুদ ধার্য করে ঋণ দেয় তাতে ব্যাংক থেকে অর্থ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যাংকগুলো তাদেরকে ১১ শতাংশ সুদ আদায়ের শর্তে ঋণ দিচ্ছে।

একইভাবে উৎপাদন শুরু করতে দেরি হওয়ায় আমদানিজনিত সমস্যাও একটি বড় বাধা হিসাবে তারা মনে করেন। জনাব হক জানান, বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে কাস্টমসের ঝামেলা পোহাতে হয়। যে কারণে দ্রুত উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, ‘কী করলে এ প্রক্রিয়াকে সহজ করা যায় এ সম্পর্কে সরকারি উদ্যোগ দরকার। এছাড়া ভাড়াভিত্তিক কোম্পানিগুলোর জন্য পর্যাপ্ত ফার্নেস তেল ও ডিজেলের ব্যবস্থা রাখা দরকার। এক্ষেত্রে বিপিসি’র (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) ভূমিকা আরও বাড়াতে হবে।’

দরপত্র ছাড়া অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলোকে ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় টাকার অভাবে খান জাহান আলী পাওয়ার কোম্পানি ইতোমধ্যে সামিট পাওয়ারের নিকট মালিকানা বদল করেছে। একই অবস্থা বরিশাল ৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের। আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় এ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ নিয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটিই এখন বিপাকে পড়েছে। কোম্পানিটি মালিকানা বদলের চেষ্টা করলে তাতে সায় দেয়নি পিডিবি।

অপরদিকে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সময়মত উৎপাদনে আসতে না পারায় কোম্পানিগুলোর প্রতি পিডিবি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এ কারণে সরকার আপাতত নতুন করে আর কোন ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেবে না। অন্তত অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত এরকমই। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়কে লেখা অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনামূলক চিঠিতে এধরনের মত জানানো হয়েছে। কারণ হিসেবে ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে অতিরিক্ত ব্যয় এবং এই কেন্দ্রগুলো সময়মত চালু না হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, চড়ামূল্যের এ ভাড়াভিত্তিক প্রকল্পগুলো সময়মত উৎপাদনে না আসলেও এ কারণে বিদ্যুৎ খাতে চলতি বছর (২০১১) সরকারকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। বর্তমান মূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রি করলে আগামী পাঁচ বছর এ খাতে ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। গত ৪ জানুয়ারি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১০-২০১১: অর্থবছরের অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরে।

রাজনৈতিক ডটকম, ৮ অক্টোবর ২০১১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *