গ্যাসের ব্যবহার ও উত্তোলন: প্রয়োজন একটি কার্যকর জ্বালানি নীতি

বাংলাদেশ মাথাপিছু জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বনিম্ন পর্যায়ের দেশগুলোর মধ্যে একটি। দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন উল্লেখযোগ্য হারে জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি। বাংলাদেশে জ্বালানি শক্তির প্রধান উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস। প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদ নবায়নযোগ্য সম্পদ নয়। এর মজুদ একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। অধিকাংশ হিসাব মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে, তা বর্তমান হারে ব্যবহৃত হলে ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এ অবস্থায় দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ শক্তির প্রধান উৎস প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধান, উত্তোলন ও ব্যবহার সম্পর্কে যেকোনো সিদ্ধান্ত প্রহণের আগে গভীরভাবে চিন্তা করা এবং সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য।

গ্যাসের উৎপাদন ও ঘাতটির খতিয়ান:
২০০৯ সালে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ছিল দু শ’ কোটি ঘনফুট। বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাওয়া গেছে ১৬০ থেকে ১৭০ কোটি ঘনফুট। ২০১০ সালে চাহিদা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫০  কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলা থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দৈনিক গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে ২০০ কোটি (২০০০ মিলিয়ন) ঘনফুটের কম। চাহিদার তুলনায় ঘাটতি প্রায় ৫০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ঢাকাসহ তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির আওতাধীন এলাকায় ১৮০ কোটি ঘনফুট দৈনিক চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ১৪৫ কোটি ঘনফুটের পাওয়া যাচ্ছে ১৮০ কোটি ঘনফুট।

বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রগুলোর কী অবস্থা
২৩টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে আঠারটি থেকে বর্তমানে গ্যাস উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে ১২টি গ্যাসক্ষেত্র পেট্রোবাংলার অধীনে আর ছয়টি বিদেশি কোম্পানিগুলোর অধীনে। দেশের সর্ববৃহৎ তিতাস গ্যাস ক্ষেত্রে ৬৮টি কূপ থেকে বছরে উৎপাদন কূপ খনন করা হয় ১৬টি, যার ১৪টি থেকে উৎপাদন চালু আছে। কেবল তিতাস ও হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রের মধ্য অঞ্চলে ১৩টি কূপ। কূপ প্রতি দৈনিক দশ-বিশ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি করলে দৈনিক দেড়শ-দু শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব।

বিবিয়ানা ক্ষেত্র থেকে সবচেয়ে বেশি গ্যাস পাওয়া সম্ভব। ২০০৭ থেকে শুরু করে দু বছরে ১২টি উৎপাদন কূপ খনন করা হয়েছে। প্রতিটি কূপে দৈনিক ৫২ মিলিয়ন ঘনফুট, সর্বোচ্চ আশি মিলিয়ন ঘনফুট। সেখানে নতুন দু ট্রিলিয়ন ঘনফুটেরও (টিসিএফ) বেশি গ্যাস পাওয়া গেছে, তা জাতীয় গ্রিডে আনতে প্রায় দু বছর সময় লাগবে।

তবে দেশের প্রথম সাগরবক্ষীয় গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গুর উৎপাদন ক্রমেই কমে আসছে। একসময় এই ক্ষেত্র থেকে দৈনিক ১৮ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস তোলা হয়েছে। এখন তা দৈনিক দু কোটি ঘনফুটেরও নিচে নেমে এসেছে। ক্ষেত্রটি আগামী বছরই বন্ধ করে দিতে হবে। অনেকের মতে, এর কারণ হলো এই ক্ষেত্রটির ঠিকাদার-পরিচালক আইরিশ কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জির অদূরদর্শিতা।

ফেনী গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে কানাডীয় কোম্পানি নাইকো রিসোর্সেস। সরকারের সঙ্গে কিছু বিরোধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আরও কয়েকটি বন্ধ কূপ চালু করার যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।

গাজীপুরের পরিত্যক্ত কামতা গ্যাসক্ষেত্র থেকে নতুন করে উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখানে মোট মজুদের পরিমাণ ৭২ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ১৯৮৪ সাল থেকে নয় বছরে ২১ মিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলনের পর গ্যাসের সঙ্গে পানি উঠতে থাকায় পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯ বছর পড়ে আছে গ্যাসক্ষেত্রটি। সম্প্রতি বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড লি. এর অধীনে সেখানে সাইসমিক সার্ভে চালানো হচ্ছে। উত্তোলনের দায়িত্ব পেয়েছে বাপেক্স। এছাড়াও পরিত্যক্ত ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মেঘনা ও চট্টগ্রামের সেমুতান থেকেও গ্যাস উত্তোলনের চেষ্টা চলছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহ
আমাদের দেশের মোট জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৭৫% প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর। কিন্তু গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি এবং নতুন গ্যাসের উৎস আবিষ্কারে সচেষ্ট না হওয়ার সংকট ঘনীভূত হয়েছে। দৈনিক ৯৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস হলে সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। কিন্তু এখন গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে ৭৯ কোটি ঘনফুট।

ডিসেম্বরের মধ্যে ৮১১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের প্রয়োজন ১৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু পেট্রোবাংলা গ্যাস সরবরাহ করতে পারবে মাত্র ৬২ মিলিয়ন ঘনফুট। ৬২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে ২৪০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যার ফলে ৫৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। সরকারি পরিকল্পনায় ২০১৩ সাল নাগাদ যে চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে, তার প্রায় দু হাজার মেগাওয়াট হচ্ছে গ্যাসভিত্তিক। এই সময়ের মধ্যে যথেষ্ট গ্যাস পাওয়া না গেলে এই বিদ্যুৎও উৎপাদন সম্ভব হবে না।

বিগত দুটি সরকারের সময় নতুন যেসব বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়েছে এর প্রায় সবই গ্যাসনির্ভর। বিকল্প জ্বালানির কথা চিন্তা না করে শুধুমাত্র গ্যাসনির্ভর বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তারও দ্রুত ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত নয়।

গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে পেট্রোবাংলার ভাষ্য এবং উদ্যোগ
গ্যাসের চলমান ঘাটতি ও তা সম্পূর্ণ পূরণের জন্য পেট্রোবাংলা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুরের ভাষ্যমতে, গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। ২০১২ সালের মধ্যে ৫০ কোটি এবং ২০১৬ সালের মধ্যে আরও ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। উৎপাদন বাড়ানোর যতগুলো উদ্যোগ বর্তমানে একসঙ্গে বাস্তবায়িত হচ্ছে, এর আগে কখনো তা হয়নি। বাপেক্স ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপসহ অনেক প্রকল্প একসঙ্গে বাস্তবায়ন করছে। তাদের কাজের গতি ও পরিধি আরও বাড়ানোর জন্য দুটি নতুন রিগ (গ্যাসকূপ খননযন্ত্র) কেনা হয়েছে।

দেশের গ্যাস সংকট মেটাতে বিজিএফসিএল-এর ৩টি গ্যাস কূপ ওয়ার্কওভার করছে। আগামী ৩ মাসের মধ্যে কূপগুলোর ওয়ার্কওভার কাজ সম্পন্ন হবে। এতে করে সারাদেশের গ্যাস পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে যেসব কূপের ওয়ার্কওভার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে, কাজ শেষ হলে এ খাতের আরেক দফা উন্নতি সাধিত হবে। এর পরই জাতীয় গ্রিডে আরও যোগ হবে বাড়তি ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

বাপেক্স কী উদ্যোগ নিয়েছে
বাপেক্স এখন বেশকিছু কাজে নিয়োজিত। তাদের হাতে এখন তিনটি পুরোনো রিগ রয়েছে, যার একটি এখন মেঘনা গ্যাসক্ষেত্রের ১ নম্বর কূপে সংস্কার কাজ চালাচ্ছে। এই কূপটি থেকে প্রায় দেড় কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আরেকটি রিগ হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রে স্থাপন করা হচ্ছে, সেখানকার ১১ নম্বর কূপটিতে সংস্কারকাজ শুরু করার জন্য। তৃতীয় রিগটি এখন স্থাপন করা হচ্ছে তিতাস-১২ নম্বর কূপে সংস্কারকাজের জন্য। এর আগে ওই তিনটি রিগ সিলেট-৭, তিতাস-৪ ও ১৪ নম্বর কূপের সংস্কারকাজ শেষ করেছে। এর ফলে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বেড়েছে। মেঘনা-১, হবিগঞ্জ-১১ ও তিতাস-১২ নম্বর কূপের কাজ শেষ হলে এ বছরের মধ্যে প্রায় সাত কোটি ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়বে।

বাপেক্স ত্রিমাত্রিক জরিপ (থ্রি-ডি সার্ভে) শুরু করছে একটি ফরাসি কোম্পানির কারিগরি সহায়তা নিয়ে। এর আগে বাপেক্স কখনো ত্রিমাত্রিক জরিপ করেনি। সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস লি. (বিজিএফসিএল) এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিএফসিএল) মোট পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রে ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালানোর কাজ করবে তারা। এই পাঁচটি ক্ষেত্র হচ্ছে তিতাস, বাখরাবাদ, রশীদপুর, কৈলাসটিলা ও সিলেট গ্যাসক্ষেত্র। আগস্টের মধ্যে মাঠপর্যায়ের কাজ শেষ হবে। রশীদপুর গ্যাসক্ষেত্রে বাপেক্স একটি নতুন কূপও খনন করবে। আগামী শুকনো মৌসুমে তাঁরা তিতাস কিংবা বাখরাবাদ ক্ষেত্রে ত্রিমাত্রিক জরিপ শুরু করবে। এছাড়া বাপেক্স এই সময়ে নতুন সম্ভাবনাময় নেত্রকোনা গ্যাসক্ষেত্রে দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ শেষ করেছে। আগস্ট নাগাদ ফেঞ্চুগঞ্জ ক্ষেত্রে নতুন কূপ খনন শুরু করবে।

গ্যাসের  উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার যা করছে
গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। দ্রুততার সঙ্গে গ্যাস সরবরাহের জন্য পেট্রোবাংলা ফাস্ট ট্রাক প্রোগ্রাম নিয়েছে। সমুদ্রের তিনটি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দুটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এরই মধ্যে গ্যাস তহবিল গঠন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সুবিধা সম্প্রসারণে ৩৫৬ কিলোমিটার গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। প্রাকৃতিক গ্যাসের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারসহ একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। গ্যাসের সম্প্রসারণে ২৫৬ কিলোমিটার নতুন পাইপ লাইন তৈরি করা হবে। সরকার গ্যাস সংকট নিরসনে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এলএনজি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং চট্টগ্রামের জ্বালানি সঙ্কট মোকাবিলায় ব্যবহার করা হবে। জাতীয় কয়লা নীতির খসড়া প্রণীত হয়েছে ও জ্বালানি নীতি হালনাগাদ করা হচ্ছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ৬ হাজার ১১৫ কোটি টাকা।

গ্যাস উৎপাদন বাড়তে পারে যেভাবে
উৎপাদনরত কূপগুলো থেকে উৎপাদন বাড়িয়ে, বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলো মূল্যায়ন ও নতুন উৎপাদন কূপ খনন করে এবং সাময়িক বন্ধ কূপগুলো উৎপাদনে এনে গ্যাসের এখনকার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় বিশ থেকে ত্রিশ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠাও বেশি সময় কিংবা ব্যয়সাপেক্ষ নয়। শুধুমাত্র তিতাস গ্যাস (৭টি) এবং হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডে (৬টি) মোট ১৩টি কূপ হতে দৈনিক অতিরিক্ত ১৫০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব। যদি কূপ থেকে সব পুরাতন যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে একটি কূপের বিপরীতে ২ থেকে ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি প্রয়োজন পড়বে না।

পেট্রোবাংলার অধীনস্ত গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি কূপে এখন গ্যাস উৎপাদন বন্ধ। ভূবিজ্ঞানীদের মতে, মেঘনা-১, কৈলাসটিলা-৫, রশিদপুর-৫ এ নতুন স্তর থেকে গ্যাস উৎপাদন করা যায়। ১০টি কূপে পানিসহ নানা জটিলতা দূর করে নতুনভাবে গ্যাস উৎপাদন করা যায়। দৈনিক ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন এভাবে বাড়ানো সম্ভব।

‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির’ সদস্য সচিব ড. আনু মোহাম্মদ বলেন, ‘সরকার একটু উদ্যোগ নিলেই গ্যাসের এই ঘাটতি পূরণ করতে পারে। প্রথমত, অনেকগুলো গ্যাসকূপ বন্ধ হয়ে আছে, যেগুলো পুনরায় চালু করা দরকার। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের হাতে যে গ্যাসক্ষেত্রগুলো আছে সেগুলোর উৎপাদন বাড়াতে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তবে সক্ষমতা এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কারিগরি দক্ষতা এবং অর্থের প্রয়োজন আছে। খুব যে অর্থের প্রয়োজন আছে তাও না।’

বিদেশি কোম্পানিগুলোর বিতর্কিত ভূমিকা
গ্যাস সম্পদের ওপর বিদেশি কোম্পানির কর্তৃত্ব থাকলে প্রয়োজন অনুযায়ী তার অনুসন্ধান বা উত্তোলন করা যায় না। যেমন, অতীতের বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানিগুলোর হাতে যে ১২টি গ্যাসক্ষেত্র আছে, এর বেশির ভাগেই এখনো অনুসন্ধান ও উত্তোলন করা হয়নি। সেগুলোর বেশির ভাগ তারা অলস ফেলে রেখেছে। শেভরন ও নাইকোর কাছ থেকে মাগুরছড়া বা টেংরাটিলার ক্ষতিপূরণ এখনো আদায় করা হয়নি। চারদলীয় জোট সরকারের জ্বালানিমন্ত্রী এ.কে.এম মোশাররফ সে সময় নাইকোর স্বার্থে মাত্র একটি ‘মার্সিডিজ’ গাড়ির বিনিময়ে দুটি গ্যাসফিল্ডকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন।

১৯৯৭ সালে ইউনিক্যাল কোম্পানি মাগুরছড়াতে এবং ২০০৫ সালে নাইকো ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ঘটায় শুধুমাত্র তাদের অদক্ষতার কারণে, যার ফলে বাংলাদেশ চিরতরে হারায় দুটি গ্যাসক্ষেত্র এবং আর্থিকভাবে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির জালিয়াতির আর একটি উদাহরণ হলো সমুদ্রবক্ষের এক মাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু। এই ক্ষেত্রটি ১৯৯৮ সালে আবিষ্কার করে শেল ও কেয়ার্ন এনার্জি কোম্পানি। সে সময় তারা উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ দেখিয়েছিলো ৮৪৮ বিসিএফ, যা থেকে ২০ বছর ধরে গ্যাস উত্তোলন সম্ভব। কিন্তু দশ বছর যেতে না যেতেই ৪৪০ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করতেই গ্যাসক্ষেত্রটি আরও বছর দু পরই পরিত্যক্ত ঘোষণা হতে পারে।

বিদেশি কোম্পানিগুলোর হাতে যে গ্যাসক্ষেত্রগুলো আছে সেগুলো পিএসসি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে অনুসন্ধান করবার কথা থাকলেও তা নির্দিষ্ট সময়ে করা হয়নি। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং বিভিন্ন দফায় সেসব চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এখন আবার স্থলভাগের অবশিষ্ট ব্লকগুলো বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার জন্য আইনগত, প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের শেষদিকে বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে সাড়া দেয় ছয়টি বিদেশি কোম্পানি। দরপত্র যাচাই বাচাইয়ের পর যুক্তরাষ্টের কনোকো ফিলিপস আটটি এবং আইরিশ টাল্লোকে একটি ব্লকের জন্য মনোনীত করা হয়। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর চুক্তি সই করেনি। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী ইঙ্গিত দিয়েছেন সরকার এক মাসের মধ্যে এ কোম্পানি দুটির সঙ্গে গ্যাস উত্তোলনের বিষয়ে চুক্তি করবে।

এমনিতে যে ক’টি গ্যাসক্ষেত্র বিদেশি কোম্পানির কর্তৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে তাতে প্রতিবছর প্রায় দু হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। প্রতিবছর যে বিপুল অংকের টাকা ভর্তুকি দিতে হয়, যার এক দশমাংশ দিয়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠান চাহিদা অনুযায়ী সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এই ভর্তুকি কমানোর চেষ্টায় আবার বেশ কয়েক দফা গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলোÑ বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে ডলারে। সরকার ভর্তুকি দিয়ে কেনার ফলে শত শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা দেশ থেকে চলে যাচ্ছে এবং এর ফলে জনগণকে বেশি দামে গ্যাস ও বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে।

বছর দশেক আগে বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে বলে এক শোরগোল তৈরি করা হয়েছিল। এই শোরগোলে মূল পালন করে বিদেশি তেল কোম্পানিগুলো, সহযোগী ছিল মার্কিন দূতাবাস, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, কতিপয় আমলা ও বিদেশি সংস্থার পরামর্শক। কারণ এতে তাদের স্বার্থসিদ্ধি হবে বলে তারা ধরে নিয়েছিল।

আমাদের দেশের ভূবিজ্ঞানী, খননবিদ, কারিগরি ব্যক্তিবর্গ অনুসন্ধান ও উন্নয়নে যথেষ্ট সুদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। তাদেরকে যদি অনুসন্ধান করতে যথাযথ সুযোগ ও সহায়তা দেয়া হত তবে আমাদের পক্ষে বিদেশিদের ওপর নির্ভর করা প্রয়োজন ছিল না। সুতরাং দেশীয় প্রকৌশলীদের কাজ করতে না দেয়া এবং সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব Ñ এদুটোই জ্বালানি খাতের উন্নয়নের বড় প্রতিবন্ধকতা।

কবে নাগাদ প্রণয়ন হবে জ্বালানি নীতি
একটি সফল জ্বালানি নীতি দ্বারা বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধন করা যায়। জ্বালানি নীতি শুধুমাত্র বর্তমান সময়ের উৎপাদন নিয়ে আলোচনা করে না বরং দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন ও পরিকল্পনা পেশ করে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর পেট্রোবাংলা নামক একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়াও পেট্রোলিয়াম অ্যাক্ট ১৯৭৪, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান নীতিমালা তথা প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি), দেশের ৫টি প্রধান গ্যাসক্ষেত্র নামমাত্র মূল্যে শেল অয়েল কোম্পানি থেকে কিনে নেয়া এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তিনটি বিদেশি কোম্পানির সহযোগিতায় বাংলাদেশ এনার্জি স্টাডি (বিইএস) কার্যক্রম ইত্যাদি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সেসব ছিল ঐতিহাসিক কার্যক্রম। তাতে সাধারণ মানুষের আস্থা স্থাপিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে আমলাতন্ত্রের দৌরাত্বে দেশের প্রশাসন, নীতি নির্ধারণ ও নীতি বাস্তবায়ন সবকিছু পাল্টে যায়।

কিন্তু বর্তমানে প্রকৃত অর্থে দেশে কোনো জ্বালানি নীতি নেই। সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী একটি জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করার বিষয়ে সরকারকে এর আগে অনেকবার বলা হলেও কোনো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ না নেয়ায় আজ এ দুর্ভোগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জ্বালানি নীতির একটি খসড়া তৈরি করা হলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি।

জ্বালানি নীতি না থাকার ফলে কোন কোন উৎপাদন খাতে গ্যাস ব্যবহার করা হবে, কী ধরনের গ্যাস কোথায় ব্যবহার হবে, পরিবহনে আদৌ গ্যাস ব্যবহার করতে হবে কিনা, বা করলে কী ধরনের গ্যাস ব্যবহার করা হবে, প্রাইভেট গাড়িতেও একইভাবে গ্যাস দেয়া যাবে কিনা বা দিলে কী ধরনের গ্যাস দিতে হবে, শিল্প কারখানা পর্যায়ে কীভাবে গ্যাস দেয়া হবে এবং কোন খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে তা সুনিদিষ্ট হয়নি। গ্যাসের সীমিত মজুদ জানার পরও পরিবহনে সিএনজি গ্যাস দেয়া হচ্ছে। এরফলে সিএনজি গ্যাসভিত্তিক পরিবহনের বিস্তার ঘটেছে। বর্তমানে দেশের মোট গ্যাসের পাঁচ ভাগ ব্যবহার হচ্ছে সিএনজি পাম্পগুলোতে। একইভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করতে গিয়ে অজপাড়াগাঁয়ে পর্যন্ত বাড়ির রান্নার কাজে গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে। দেখা গেছে, বাসাবাড়ির রান্নার কাজে মোট গ্যাসের ১১ ভাগ লাগে। সরকার রান্নার কাজে গ্যাস না দিতে পেরে এখন এলপি সিলিন্ডার গ্যাস ব্যাবহারের পরামর্শ দিচ্ছে। সরকার শিল্পকারখানায় গ্যাস দিতে পারছে না বলে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে গেছে।

চিন্তা, ১৯ জুলাই ২০১০

Leave a Reply

Your email address will not be published.