পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে এগিয়ে আসছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্পোদ্যোক্তা পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপ। এ লক্ষ্যে গত ২৪ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘এনআইসি ইন্টারন্যাশনাল ইনকরপোরেটেড’-এর সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে গ্রুপটি। চুক্তি অনুযায়ী এনআইসি-এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি নিরসনে কাজ করবে বসুন্ধরা গ্রুপ।
সরকার অনুমোদন দিলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে ক্ষুদ্র পরিসরে এ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হবে। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে জানান, বসুন্ধরা গ্রপের এই নতুন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের বিদ্যুৎ সমস্যার যেমন সমাধান হবে, তেমনি কর্মসংস্থান বাড়বে এবং আসবে বৈদেশিক মুদ্রা। সরকার অনুমোদন দিলে এতে ২৫ থেকে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। পুরো প্রক্রিয়াগুলো যথাসময়ে শেষ হলে আগামী বছর তথা ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে যেতে পারবে।
পারমাণবিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হবে মানিকগঞ্জে। দেশের বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ঘাটতির ক্ষেত্রে ২০ মেগাওয়াট খুব বেশি বিদ্যুৎ নয়। কিন্তু এর মাধ্যমে বসুন্ধরা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাকি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে জমা দিতে পারবে।
এ ধরনের ছোট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানানো সহজ না কঠিন? এ সম্পর্কে জাপানের সেন্ট্রাল রিসার্চ ইউন্সিটিউট অফ ইলেক্ট্রিক্যাল পাওয়ার ইন্ডাস্ট্রির মিতসুরু কামবে মনে করেন, কঠিন কাজ নয়। বাংলাদেশের মত যেসব দেশের পারমাণবিক প্রকল্প নেই, তাদের উচিত বড় প্রকল্পে যাওয়ার আগে এ ধরনের ছোট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র্র স্থাপন করে দক্ষ প্রকোশলী গড়ে তোলা। তিনি মনে করেন, এ ধরনের প্রকল্পে মারাত্বক বিধ্বংসী পারমাণবিক জিনিসপত্র থাকে না। এর থেকে নিঃসরিত বর্জ্য সহজেই মাটির নীচে পুতে ফেলা যায়।
‘হাইপেরিয়ন’ নামক মেক্সিকোভিত্তিক একটি পারমাণবিক ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি বসুন্ধরার এ প্রকল্পটির নির্মাণ কাজে সহায়তা করবে। ২০০৮ সালে মার্কিন সরকার হাইপেরিয়নকে পারমাণবিক প্রযুক্তির লাইসেন্স দেয়। কোম্পানিটি বিশ্বের যে কোনো স্থানে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা দশ সেন্টের বিনিময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তারা ইতোমধ্যে এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য একশটিরও বেশি কার্যাদেশ পেয়েছে। হাইপেরিয়ন বিশেষ করে বিদ্যুৎ সুবিধা বঞ্চিত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তারা ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে চার হাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্র্র নির্মাণ করবে, যেগুলো জাপানের ফুকুশিমার মত পারমাণবিক বিস্পোরণসহ যে কোন ঝুঁকি থেকে নিরাপদ থাকবে।
হাইপেরিয়ন নির্মিত এ ধরনের পারমাণবিক কেন্দ্রকে ‘নিউক্লিয়ার ব্যাটারি’ বলা হয়, যেটি একটি তরল ধাতব চুল্লী। ছোট এ পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে গড়ে ২৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এ কেন্দ্রগুলো সাধারণত স্বচালিত। এমনকি এটি পরিচালনার জন্য কোনো মানুষের প্রয়োজনও হয় না। এ ধরনের কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও তুলনামূলকভাবে কম।
বাংলাদেশে এর আগেও চারদলীয় জোট সরকার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কামনা করেছিল। গত ৩০ আগষ্ঠ এ তথ্য সম্বলিত এক তারবার্তা প্রকাশ করে জুলিয়ান এ্যাসাঞ্জ-এর উইকিলিকস। উক্ত তারবার্তার মাধ্যমে জানা যায় যে, ২০০৫ সালের ২৮ জুলাই বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এক তারবার্তা পাঠিয়ে ওয়াশিংটনকে জানান, বাংলাদেশে সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী আব্দুল মঈন খান ঢাকায় মার্কিন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন যে, তাদের সরকার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পারমাণবিক চুল্লীর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়। তবে বাংলাদেশের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে জনাব মঈন এ ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো সাড়া পাননি। জনাব খান বাংলাদেশে পারমাণবিক চুল্লী স্থাপনের প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য চীনের সাহায্যও চেয়েছিলেন।
উইকিলিকস-এ ফাঁস হওয়া উক্ত তারবার্তার মাধ্যমে আরও জানা যায় যে, ২০০৫ সালের জুন মাসে মার্কিন কমকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী আব্দুল মঈন খান পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে এবং পারমাণু বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কামনা করেন। একই বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি কমিশন-এর চেয়ারম্যান সি এস করিম মার্কিন কমকর্তাদের জানান, আব্দুল মঈন খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে সহায়তা বৃদ্ধি করতে চান। জনাব করিম পরবর্তীতে পরমাণু বিদ্যুতের চুল্লী এবং এ সংক্রান্ত প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে মার্কিন কর্মকর্তাদের নিকট একটি খসড়া দলিল হস্তান্তর করেন। ফাঁস হওয়া তারবার্তা থেকে জানা যায়, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে মার্কিন কমকর্তাদের মধ্যকার এ আলোচনা দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকে।
এ ধরনের ছোট পারমাণবিক চুল্লী স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হতে পারে না। অর্জুন মকিজানি এবং মিশেল বয়েড ‘ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি অ্যান্ড এনবায়রনমেন্টাল রিসাচ’-এর এক গবেষণাপত্রের মাধ্যমে এমনটিই দেখিয়েছেন। তারা মনে করেন, এ ধরনের পরমাণু চুল্লীতে খরচ যেমন বেশি, তেমনি এটা নিরাপদ নয়। এছাড়া বর্জ্য নিয়েও সমস্যা পোহাতে হয়। তারা তাদের গবেষণাপত্রে বলেন যে, কিছু বিশেষজ্ঞ আছেন যারা বড় পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপনে বিশাল খরচ, নিরাপত্তা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যা থাকার কারণে ছোট পারমাণবিক চুল্লী স্থাপনের পরামর্শ দেন। কিন্তু ছোট পারমাণবিক চুল্লী এ সমস্যাগুলার সমাধান করে না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশে এ ধরনের ছোট পারমাণবিক চুল্লী স্থাপনের আগে অবশ্যই এ সংক্রান্ত্র তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। এর বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আবশ্যক।
রাজনৈতিক ডটকম, ২৮ এপ্রিল ২০১১