‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট: সমাধান কি অসম্ভব?’

bd

লেখক: বি.ডি. রহমতউল্লাহ
প্রকাশনা সংস্থা: সংহতি প্রকাশন
প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০১০
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৬০
মূল্য: ৭৫ টাকা।

নিজস্ব জ্বালানি উৎসের ওপর কর্তৃত্ব কোনো দেশের সার্বভৌমত্বেরই শামিল। যেই বয়ান আর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেই জ্বালানি ক্রমশ চলে যায় বহুজাতিক পুঁজির দখলে; সেইসব প্রক্রিয়া বাংলাদেশে সবচেয়ে কাছে থেকে দেখেছেন যিনি, তিনি হলেন প্রকৌশলী বি.ডি. রহমতউল্লাহ। কাজেই তিনি যখন লিখছেন ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট: সমাধান কি অসম্ভব?’ শিরোনামে; তখন সেই বই এই বিষয়ে আগ্রহীদের অবশ্যপাঠ্য না হয়ে উপায় নেই।

বি.ডি. রহমতউল্লাহ পেশাগত জীবনে একজন প্রকৌশলী। পাওয়ার সেল ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে (আরইবি) দীর্ঘ ৩০ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বলা যায়, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক অবস্থা এবং সমস্যার পেছনের কারণ দেখেছেন খুব কাছ থেকে, নিবিড়ভাবে। বাংলাদেশে গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতিতে কয়লাখনি থেকে দুষণমুক্ত জ্বালানি আহরণের প্রস্তাব উপস্থাপকদের মাঝে তিনি অন্যতম। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে ‘পাওয়ার সেল’ দিয়ে শুরু করে সর্বশেষ পিপিপি’র মত উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা যেভাবে ক্রমশ ঝুঁকিতে পড়ছে; এই প্রক্রিয়ার মধ্যে জনাব রহমতউল্লাহ তাঁর অভিজ্ঞতার থেকে লিখেছেন। তাঁর পেশাদারি ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতার জায়গা থেকে সমাধানে পরিকল্পনা বাতলেছেন।

জ্বালানি উৎপাদন-পরিচালন ও বিতরণ ব্যবস্থার প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের মাধ্যমে, এবং বিশেষত নবায়নযোগ্য উৎসেরÑযেমন, সৌর বিদ্যুৎ চালু করার মাধ্যমে বর্তমান জ্বালানি সংকট ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দূর করা সম্ভব; এমনটিই মত ও পরিকল্পনা দিচ্ছেন এই অভিজ্ঞ প্রকৌশলী। জনাব রহমতউল্লাহ’র এই পর্যালোচনাটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি সংকট ও সমস্যার গভীরতা দেখার পাশাপাশি সমাধানের নানা বিকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছেন। পাশাপাশি ভবিষ্যতে একটি গণমুখী সরকার কীভাবে জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার কার্যকর ভিত্তি তৈরি করতে এবং জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে পারবে তার রূপরেখাও দিয়েছেন।

বিদেশি করপোরেশনগুলো গ্যাস রফতানির ন্যায্যতা দেখাতে কখনো ‘গোটা দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে’ বলে যেমন প্রচারণা চালায়, তেমনি উল্টোদিকে কখনো আবার উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা তোলার যুক্তি হিসেবে গ্যাসের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত কমিয়ে দেখায়; এই তামাশার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন লেখক। নাগরিক চাহিদা পূরণ করবে না জেনেও কীভাবে একের পর এক প্রকল্প জ্বালানি খাতে নেয়া হয় বিশেষজ্ঞ তকমাওয়ালা সাবেক আমলা ও প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিতরা যেভাবে তাতে অংশগ্রহণ করেন, সে সম্পর্কে আগাপাশতলা ধারণা পাঠক পাবেন এই বইয়ে। পিডিবির দুর্নীতির অজুহাতে ভারত থেকে প্রায় পাঁচগুণ বেশি দামে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি কিংবা বড় পুকুরিয়ায় সীমিত আকারে উন্মুক্ত কয়লাখনির উদ্যোগ কোন কিছুই লেখকের বিবেচনায় শাসকগোষ্ঠী ও বহুজাতিক বিনিয়োগকারীদের সামগ্রিক তৎপরতা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

দীর্ঘদিনের পেশাদারি অভিজ্ঞতা থেকে জনাব রহমতউল্লাহ জানেন যে, বিশ্ব অর্থনীতি তথা বিশ্ব পুঁজি’র মুরুব্বি প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতা সংস্থার পরামর্শ ও অনেক ক্ষেত্রে দাতা ও পশ্চিমা করপোরেশনগুলোর অর্থায়নে তাদের কথামত কাজ করতে গিয়েই বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে। সেমতে এই অভিজ্ঞ প্রকৌশলী প্রস্তাব করছেন সমাধানের কার্যপ্রক্রিয়া।

জাতীয় উন্নয়নে বিদ্যুতের যেমন ব্যবস্থা দরকার
রহমতুল্লাহ লিখছেন যে, জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্তকরণে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নের হার সামগ্রিক জাতীয় উৎপাদনের দ্বিগুণ থেকে আড়াই গুণ হারে বাস্তবায়ন করতে হয়। অর্থাৎ ৬% হারে জিডিপি বাস্তবায়ন করতে হলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নের হার দ্বিগুণ থেকে আড়াই গুণ করতে হবে। এর মানে দাঁড়ায় ১২% থেকে ১৫% হারে বাড়াতে হবে। এতে করে বিদ্যুতের যে ধরনের উৎপাদন-পরিচালন-বিতরণ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হবে তা হবে এরকম;
ক. নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, অর্থাৎ যা নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করে।
খ. মানসম্মত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, অর্থাৎ ভোল্টেজ বা ফ্রিকোয়েন্সি ওঠানামা করে না।
গ. সাশ্রয়ী ও যৌক্তিক মূল্যে ট্যারিফ নির্ধারণ, অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে গ্রাহক পর্যন্ত সরবরাহ করতে সার্বিক ব্যয় হতে হবে যৌক্তিক হারে।

বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে যেসব কারণ দূর করা চাই
প্রকৌশলী রহমতউল্লাহ মনে করছেন উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলোর কোনটিই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তার কারণ হলো:
ক. রাজনৈতিক দলগুলো পরাশক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করছে, যেই ক্ষমতা চর্চার মধ্যে জাতীয় উন্নতি ও প্রগতির রাজনীতির কোনো জায়গা নেই।
খ. ঔপনিবেশিক আমলের গড়ে ওঠা এই প্রশাসনিক ব্যবস্থা একদিকে যেমন অদক্ষ, অপরদিকে দুর্নীতিগ্রস্ত।
গ. বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছ, সৎ, নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদের উৎসাহ না দেয়া।
ঘ. বিদ্যুৎ খাতের জন্য জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো জ্বালানি নীতি না থাকা।
ঙ. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সাশ্রয়ী ও সংরক্ষণশীল নীতি নেই।
চ. সঠিক সময়ে সঠিক নীতি মেনে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিচ্ছা।

এই সময়ের বিদ্যুৎ সংকট তৈরিতে প্রধানত বিশ্বব্যাংক দায়ী বলে মনে করেন লেখক। তিনি দাবি করেন, এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকারেরই বিশ্বব্যাংকের পরামর্শের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না। বিশ্বব্যাংক হলো সব দাতা সংস্থার সমন্বয়ক। তাই বাংলাদেশের মত দেশগুলোর বিদেশনির্ভর শাসকগোষ্ঠী এই প্রতিষ্ঠানটির পরামর্শ মেনে চলে। বিশ্বব্যাংক ও দাতাসংস্থাগুলো ১৯৮০ সাল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশকে ঋণ দেয়া বন্ধ করায় ১৯৯০ সালের দিকে এসে চাহিদা এবং উৎপাদন সমান হয়ে যায়। বিদ্যুৎ খাত সংস্কারের কথা বলে বিশ্বব্যাংকের কথামত সরকার বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারিকরণে পদক্ষেপ নেয়। এভাবে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়ায় ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ সংকট মারাত্বক আকার নেয়। সেই সংকট এখন গভীর সমস্যায় রূপ নিয়েছে। তার ওপর এই সমস্যা দূর করার কোনো নিজস্ব পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে না এখনো। যেই বিশ্বব্যাংকের কথামত কাজ করে বাংলাদেশের সরকারগুলো দেশের বিদ্যুৎখাতকে বর্তমানের গভীর সমস্যায় ফেলেছে, সেই বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে নতুন করে ‘ভাড়া বিদ্যুৎ’ বা ‘দ্রুত ভাড়া রেন্টাল’ এর মত ক্ষতিকর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। লেখকের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এই ভাড়া বিদ্যুতের ব্যবসা চালাতে গিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা অর্জন ব্যাহত হচ্ছে।

গ্যাস-এর ‘কৃত্রিম সংকট’ দূর করা যায় ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে
চলমান গ্যাস সংকটকে ‘কৃত্রিম সংকট’ হিসেবে শনাক্ত করেছেন লেখক। তিনি লিখছেন, ‘বাপেক্সের শক্তিশালী ভুমিকা না থাকায় প্রত্যাশামত গ্যাসও পাওয়া যাচ্ছে না। এতে গ্যাসের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে।’ তিনি তথ্য ও পরিসংখ্যানের সাহায্যে বিস্তারিত লেখায় দেখিয়েছেন যে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের এই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি গ্যাস উত্তোলন করছে না। আর বর্তমানে ২২৫ কোটি ঘনফুটের মত গ্যাসের যে চাহিদা দেশে আছে, এ পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে বড়জোর ৫০০ কোটি টাকা খরচ করে গ্যাসক্ষেত্রগুলোর কূপগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত সংক্রান্ত কাজ করতে হবে মাত্র। কিন্তু সরকার তা করছে না।

খোলামুখ কিংবা ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ পদ্ধতির বিকল্পে কয়লা ওঠাতে হবে
কয়লা উত্তোলনে আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন (ইউসিজি-UCG) বা কয়লাকে গ্যাসীকরণ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কয়লা ওঠানোর ওপর জোর দিয়েছেন জনাব রহমতউল্লাহ। তিনি লিখছেন যে, বাংলাদেশের পললভূমিতে এই ধরনের ওপেনপিট বা খোলামুখ পদ্ধতি কিংবা এমনকি ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা ওঠালেও ভূমিধ্বস এবং সার্বিকভাবে ভূ-বিপর্যয় অনিবার্য। উল্লেখ্য, বড়পুকুরিয়া কয়লাক্ষেত্রে ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা ওঠানোর বেলায়ও ভূমিধ্বস-সহ সার্বিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে। তাঁর মতে, খোলামুখ পদ্ধতি কিংবা ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা ওঠানোর ফলে যে ‘ভূমিধ্বস, বায়ু দূষণ, পানির স্তর নেমে গিয়ে সার্বিক ক্ষতি’ কিংবা ‘জমির উর্বরা শক্তি, জমি হারিয়ে উদ্বাস্তু হওয়া, মরুকরণের প্রতিক্রিয়া’ ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে খেসারত দিতে হবে তা জাতীয় উন্নয়নে কয়লা উত্তোলন যা যোগ করবে তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি। বি.ডি. রহমতউল্লাহ’র প্রশ্ন ‘তাহলে এ ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে কয়লা উঠানোর পেছনে কার স্বার্থ কাজ করে’?

তাঁর মতে, উন্মুক্ত ও সুড়ঙ্গ এ দু পদ্ধতির বিপরীতে ইউসিজি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কয়লা উত্তোলন করতে হব। এই গ্যাসীকরণ পদ্ধতিতে ভূ-গর্ভস্থ কয়লা সরাসরি তরল করে তার থেকে গ্যাসে পরিণত করা যায়। এই গ্যাস সরাসরি বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা রাসায়নিক কারখানায় ব্যবহারের মত কাজে লাগানো যায়। এই পদ্ধতিতে উৎপাদন তুলনামূলক বেশি, খরচ কম, পরিবেশগত বিপর্যয়ের শঙ্কাও কম।

তিনগুণ লোকসান দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানির মত উদ্যোগ বন্ধ করতে হবে
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সরকারি পরিকল্পনাকে ‘ভারতের কাছে একটি নতজানু এবং আর্থিক ঔপনিবেশিকতার চূড়ান্ত নিদর্শন’ আখ্যা দিয়ে রহমতউল্লাহ লিখছেন- পরিকল্পিত ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানিতে যে খরচ হবে ওই পরিমাণ অর্থে বাংলাদেশে খুব অনায়াসে ৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যায়।

উল্লেখ্য, ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য যেই পরিচালন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে বাংলাদেশকে-লেখকের হিসাবে তার পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা। কিন্তু ভারত এই খরচের পরিমাণ ধার্য করেছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে পরিচালন অবকাঠামো তৈরি বাবদ ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৮০০ কোটি বেশি আদায় করছে। যেই ১১ শ’ কোটি টাকা ভারত ঋণ দিচ্ছে বাংলাদেশকে, অনেক উচ্চ হারের সুদে। পাশাপাশি, ঋণের আরও শর্ত হচ্ছে- অবকাঠামো তৈরিতে প্রয়োজনীয় সব দ্রব্যসামগ্রী ভারতের কাছ থেকেই কিনতে হবে।

রাজনৈতিক ডটকম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১১

Leave a Reply

Your email address will not be published.