আধুনিক রাজনৈতিক অর্থনীতির জনক যেমন, এডাম স্মিথ বা ডেভিড রিকার্ডো অর্থনীতিকে পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করেননি। তারা সমসময় ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আধুনিক রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদদের জন্য অর্থনীতি ছাড়া রাজনীতিকে এবং রাজনীতি ছাড়া অর্থনীতি বুঝা অসম্ভব ছিল। দুটি ক্ষেত্র যদিও পৃথক কিন্তু একটি আরেকটির সঙ্গে সংযুক্ত। উনবিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত শুধুমাত্র অর্থনীতি শব্দটি ব্যবহার হত না। স্মিথ বুঝেছেন যে, যখনই একটি দক্ষ বাজার ব্যক্তিগত পছন্দ থেকে তৈরি হয়, সেটা একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে আকার লাভ করে, অর্থনৈতিক বাস্তবতা দিয়েই যে রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি গঠিত হয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একজন আধুনিক অর্থনীতিবিদের কাছে আলাদা কিছু নয়, একাট্টা। একটির টিকে থাকার ওপর অপরটির অস্তিত্ব নির্ভরশীল।
বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে ভাল বোঝা যাবে এটিকে রাজনৈতিক অর্থনীতির সংকট হিসেবে বুঝলে। অধিকন্তু এটা সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, এই সংকট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং চীনে ছড়িয়ে পড়ছে। এ সংকটের বিভিন্ন রূপ দেখা গেলেও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থার দিক থেকে প্রায় কাছাকাছি। তাই একে রাজনৈতিক অর্থনীতির সংকটই বলা যায়। এ সংকট ছড়িয়ে পড়া নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
সংকটের সূত্রপাত যেভাবে
আমরা জানি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকেই বর্তমান এই অর্থনৈতিক সংকটের শুরু। আরও স্পষ্ট করে বলা যায় যে, সেখানকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশেষ করে আবাসন খাতের সংকট থেকেই এটা শুরু হয়েছে। আবাসন ব্যবসায়ীরা ধরেই নিয়েছিল যে, বাসা বা ফ্লাটের দাম সবসময় বাড়তেই থাকবে। কিন্তু দেখা গেল ফ্লাটের দাম ভয়াবহভাবে পড়তে শুরু করল। এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি করল। এই সংকট শুধু সেখানে নয়, বরং সারা ইউরোপব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল।
অর্থনীতির দিক থেকে বলা যায় যে, এটা ছিল স্পষ্টতই অর্থনৈতিক সংকট। তবে রাজনৈতিক অর্থনীতির দিক থেকে অন্য ধরনের প্রশ্ন তোলা যায়, তা হলো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর ন্যায়সংগত অধিকার মাত্রা কতটুকু?
জাতীয় কাঠামো বা সিস্টেম ব্যাপারটা আসলে বিভিন্ন উপ-কাঠামো যেমন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষাগত ইত্যাদির একটি সমন্বিত ব্যবস্থা। এবার অর্থনৈতিক কাঠামো বা ব্যবস্থাকে আলাদা করে বিবেচনা করলে Ñ বিভিন্ন কর্পোরেট শাখাসমূহের অন্তর্ভুক্ত নিজস্ব প্রশাখা বা ব্যবস্থাসমূহ হতে একটি প্রশাখাকে স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এই জটিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সরল করে উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য একটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট থেকে বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করা। এই ব্যবস্থা, এই অর্থনৈতিক কাঠামোটা ফিনান্সিয়াল এলিটদের সিদ্ধান্তেও হেরফেরে ভেঙে পড়েছে। ফলে অবধারিতভাবেই এক রাজনৈতিক সংকটের উত্থান ঘটেছে। এটা যতটা না অর্থনৈতিক বিষয়াদি (যেমন, নগদ অর্থ, ঋণ, ডিপোজিট বা সুদ, সম্পদ, ইনডেক্স) তথা সমীকরণের হেরফেরে হয়েছে, তারচেয়ে বেশি হয়েছে নীতি নির্ধারক তথা এলিট শ্রেণির অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলশ্র“তিতে। এটিই আদতে এক ভয়ানক রাজনৈতিক সংকটকে কেন্দ্রীভূত করেছে। যার কারণ অর্থনীতির উপাদান বা সমীকরণসমূহের ভুলের জন্য নয়, বরং ফিনান্সিয়াল এলিট শ্রেণির দক্ষতা ও সততার ঘাটতি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অর্থনীতির গতি প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক সর্বেসর্বা এই এলিট শ্রেণিটি হয় নির্বোধ, না হয় অসৎ, কিংবা দুটোই। ব্যাপারটা এমন যে, এই শ্রেণিটি বিশ্বাস বা নির্ভরতার সকল শর্তকে নষ্ট করেছে শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে এবং একই সঙ্গে পুরা সমাজকে বিপদাপন্ন করে।
ভাল অথবা মন্দ দৃশ্যত অবস্থাটি ভয়ানক রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। এটি ছিল সত্যিকারেই একটা কাঠামোগত সংকট, যাকে তুলনা করা হয়েছে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সচরাচর সংকটসমূহের সঙ্গে। প্রশ্ন ছিল রাজনৈতিক কাঠামো এই সংকট মোকাবিলাই নয়, সেই সঙ্গে অপরাধী চক্রকে ধরাশায়ী করতে পারবে কিনা। অন্যভাবেও বলা যায়, অর্থনৈতিক কাঠামো যদি অপরাধী চক্রকে বিবেচনায় নাই আনলো তবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কীভাবে অপরাধ দমনে আইনগত কাঠামো তৈরি করতে পারত? কী হয়েছিল আসলে? এর জন্য দায়ী ফিনান্সিয়াল এলিট শ্রেণিটির সঙ্গে রাজনৈতিক শ্রেণি স্বার্থের খাতিরে এক হয়ে গিয়েছিল কি?
সংকট যেমন ছিল অর্থনৈতিক কাঠামোতে, তেমনি ছিল রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যেও। সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালে এই বিষয়ে মার্কিন সরকারের তৎপরতা ছিল আক্রান্ত অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে। অনেকের ধারণা ছিল এটি সরকার করবে ব্যর্থ অর্থনৈতিক নির্ধারক ব্যাক্তিবর্গ বা ফিনান্সিয়াল এলিটদের কারণে। সৃষ্ট সমস্যাবলীর আলোচনার মাধ্যমে কিন্তু এমনটা ঘটেনি। সমস্যার মূলে না গিয়ে অর্থনৈতিক কাঠামোর স্থিতিশীলতার জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালা হল। রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকরা অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারকদের হাতেই কাঠামো পুনর্গঠনের দ্বায়িত্ব অর্পণ করল।
এই সংকটটিই দ্বিতীয় সংকটের জন্ম দিল। সেটি হলো রাজনৈতিক নীতি নির্ধারক বা পলিটিক্যাল এলিটদের সংকট। পলিটিক্যাল এলিট শ্রেণির সমালোচনায় মুখর হতে দেখা গেল টি পার্টিগুলোতে, যেখানে মূল সমালোচনা হচ্ছিল আগের অর্থনৈতিক সংকটকে নিয়ন্ত্রণের ভুল প্রয়াস সম্পর্কে এবং তাকেই বর্তমানের অত্যধিক দেনাজনিত সংকটের হেতু হিসেবে চিহ্নিত করা হল। টি পার্টিগুলোর মতামত যদিও বেশ অতিরঞ্জিত ছিল কিন্তু তাদের ধারণাটা ছিল পূর্বের অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে পলিটিক্যাল এলিট একই সঙ্গে যেমন ঋণের আশ্রয় নিয়েছে তেমনি অতিমাত্রায় অপব্যবহার করেছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে। এদের বিতর্ক বা দাবিটা ছিল এই পলিটিক্যাল এলিট শ্রেণিটি আসলে ওই অর্থনৈতিক সংকটটাকে ব্যবহার করেছিল রাতারাতি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করার জন্য (স্বাস্থখাত উন্নয়ন ছিল ওই প্রক্রিয়ার পোস্টার চাইল্ড মাত্র)। এটি শুধুই ওই সময়টাকে ব্যবহার করে, যখন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেনার দায়ে আক্রান্ত।
ইউরোপে সংকট
এই চরম দেনাজনিত ঘটনা একই রকমভাবে ইউরোপেও প্রথমে অর্থনৈতিক এবং পরে রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। যখন আমেরিকান অর্থনৈতিক সংকট ইউরোপকে আঘাত করল অবধারিতভাবে অর্থনৈতিক মন্দা রাজনৈতিক সংকটকে ঘনীভূত করল। ক্ষুদ্র হলেও ইউরোপের একটা অংশ মনে করে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ইউরোপিয়ান সর্বসাধারণের জন্য নয়, বরং ফিনান্সিয়াল এলিট শ্রেণিকে সাহায্য করার জন্য। অথবা পুরো ইউরোপ নয়, শুধুই উত্তর ইউরোপ মানে ফ্রান্স ও জার্মান প্রভৃতিকে শক্তিশালী করার নিমিত্তে কিংবা এই উভয় কারণেই। এটি আগে অল্প সংখ্যকের বিশ্বাস হলেও মন্দা দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে বর্তমানে অনেকের বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অবমূল্যায়ন বিবেচনায় এই ইউরোপিয়ান সংকট ছিল প্রায় মার্কিন সংকটের অনুরূপ। কিন্তু সংকট ইউরোপে বেশিমাত্রায় ঘনীভূত এই ক্ষেত্রে যে, ইউরোপ এখানে এককেন্দ্রিক বা একক ইউনিট হিসেবে ইউরোপের সমস্ত ব্যাংকসমূহের সঙ্গে আলোচনা করতে পারছিল না। তারা তা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে, অথবা প্রত্যেক রাষ্ট্র পৃথকভাবে তাদের কেন্দ্রীয় বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ব্যাংক নির্ভর হয়ে। এতেই মনে হচ্ছিল যে, ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক উত্তর ইউরোপ বিশেষ করে জার্মানিকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। এই ধারণাটাই বদ্ধমূল হল যখন গ্রীসের মত পিছিয়ে পড়া ও প্রান্তীয় অঞ্চলের দেশ মন্দাক্রান্ত হয়।
গল্পটিকে দুটি দিক থেকে দেখা হয়। এর একটি জার্মান ভার্সান, যা একেবারে সাধারণ ব্যাখ্যা হিসেবে বহুল ব্যবহৃত। এদিক হতে বলা হয় গ্রীসের চরম দেনাগ্রস্ততাজনিত সংকটের কারণ হল সেখানকার সরকারের দ্বায়িত্বহীনতা বা অদূরদর্শিতা। তাদের (জার্মান) মতে, গ্রীক সরকার সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে তার সাধ্যের বাইরে অতিমাত্রায় বরাদ্দ করেছে, যা দেশটিকে দেনার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই কারণ দেখিয়েই জার্মানি গ্রীসের প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর পক্ষে ছিল না।
গল্পের অপর ব্যাখ্যাটা গ্রীক ভার্সান, যেটি সাধারণত আমলে নেয়া হয় না। তাদের মতে, জার্মানি আসলে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নকে তাদের স্বার্থে জার্মানমুখী করে ফেলেছে। জার্মানি পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তর রফতানিকারক রাষ্ট্র এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পরেই তার স্থান। উন্মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল করে জার্মান আসলে তাদের পণ্যের মাধ্যমেই তা গণ্ডিভূত করে ফেলেছে। প্রথম ২০ বছরের সাফল্যের এই ছিল গোপন কথা। কিন্তু যখন সংকট আক্রমণ করল তখন গ্রীসের অŸমতা টাকার অবমূল্যায়নের দিকে ঠেলে দিল। মুদ্রাটা যেহেতু ইউরো, যা ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই হিসাব ধরে জার্মানির রফতানি প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবার সামর্থতা, অন্যদিকে গ্রীসের সেই রফতানিকৃত পণ্যসমূহের নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা তাদের মন্দাকে পুরুদমে ঘনীভূত করে। ফলশ্র“তিতে তাদের ঋণগ্রস্ত হতে হয়। উপরন্তু ব্রাসেলস হতে সৃষ্ট নিয়ম, নীতিমালাসমূহ বরং জার্মানিকেই শক্তিশালী করে, যেখানে গ্রীসের করার কিছুই ছিল না।
এ দুই ব্যাখ্যার কোনটি সত্য বা অধিকতর গ্রহণযোগ্য সেটা মুখ্য নয়। মুখ্য বিষয়টা হচ্ছে ইউরোপ দুটি রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন, যার উৎপত্তিস্থল অর্থনীতি। এদের একটি সংকট হলোÑ ইউরোপের রাজনৈতিক এলিট শ্রেণিটি অর্থনৈতিক এলিট শ্রেণিকে পারস্পরিক স্বার্থে রক্ষা করছে। অন্য সংকটটি ইউরোপের নিজস্ব, তা হলো- একটি আঞ্চলিক সংকট, যেখানে অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। এটিই হয়ে ওঠতে পারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অস্তিত্বজনিত সংকট।
চীনের সংকট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্র ও ইউরোপের সংকট চীনকেও জোরালোভাবে ধাক্কা দিয়েছে। চীন পৃথিবীর বৃহত্তম রফতানিমুখী অর্থনীতি, একইসঙ্গে বড় গ্রাহক, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ মন্দাক্রান্ত হয় তখন চীন বেকার সমস্যার সম্মুখীন হয়। যদি কারখানা বন্ধ হয়, শ্রমিক বেকার হয়ে যায়, তা চীনকে সহজেই একটা ভয়ানক সামাজিক অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত করতে পারে। চীনা সরকারের তখন দুটি দ্বায়িত্ব ছিল। প্রথমত, মূল্য হ্রাসকে উৎসাহিত করে কারখানাগুলোকে চালু রাখা, এতে রফতানির ক্ষেত্রে লাভের মাত্রা কমে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, সমস্যা কবলিত দেনাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে নজিরবিহীনভাবে ঋণ প্রদান করা, যাতে করে তারা ঝরে না পড়ে। এই পদক্ষেপ কাজে দিয়েছিল, তবে তা চীনকে বড় মাত্রার মুদ্রাস্ফীতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এটি আবার দ্বিতীয় সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। শ্রমজীবীরা সেখানে ইতোমধ্যেই স্বল্প আয়জনিত সংকোচনের মধ্যে ছিল। ফলাফলটি ছিল তাদের আয় তথা মজুরি বৃদ্ধি, যা পরে রফতানিমুখী পণ্যাবলীর খরচ আরেক দফা বাড়িয়ে তোলে। একই সঙ্গে চীনের মজুরির মাত্রাকে কম প্রতিযোগিতামূলক করে ফেলে, যা ছিল মেক্সিকোর চেয়েও কম।
চীন ইতোপূর্বে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করত। ব্যাপারটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অর্থনীতির সুসময়ে ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। পরে উদ্যোক্তাদের যৌক্তিক পদক্ষেপ ছিল যে, হয় ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া অথবা শ্রমিক ছাটাই কিংবা দুটোই। চীন সরকার ব্যাপারটা কুলিয়ে উঠতে পারল না। ফলে অর্থনীতিতে সংকট আরও গেড়ে বসতে থাকল। রাজনৈতিক নীতি নির্ধারক বা এলিট শ্রেণিটি অবস্থার স্বাভাবিকতা আনতে আগ্রহী হলো। তাদের ইচ্ছানুযায়ী ব্যাপারটা করা হলো ফিনান্সিয়াল বা কর্পোরেট এলিট শ্রেণিসমূহকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে।
বিভিন্নভাবে তিনটি ভিন্ন অঞ্চল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং চীন এই সংকটকে আমরা দেখতে পেয়েছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পদক্ষেপটি ছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ। আর্থিক খাতে পরিবর্তন ও রদবদল এনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ। আবার ইউরোপে, যেখানে আগ থেকেই অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ছিল, অতঃপর রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকরা সেই নিয়ন্ত্রণ কীভাবে কাজ করবে বা কারা এতে লাভবান হবে তার ব্যাখ্যা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে। অন্যদিকে চীনে, যেখানে সবসময় পলিটিক্যাল এলিট অর্থনীতির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখেন এবং সেই ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তিনটি ক্ষেত্রেই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবহার দেখা যায়।
আবার তিনটি ক্ষেত্রেই এই পদক্ষেপ বাধার সম্মুখীন হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এটি ছিল দলগত আলোচনা, যা সবচেয়ে তৎপর ও কার্যকর ঘটনা, যা প্রতিরোধের অন্যতম নমুনা। এটি তাদেরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ইউরোপের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ আসে ইউরোপ বিরোধীদের কাছ থেকে (এবং অভিবাসন শ্রেণিটির কাছ হতে, যারা অবাধ অভিবাসন প্রশ্নে উন্মুক্ত সীমান্তের বিরোধী)। প্রতিরোধ এসেছিল আয়ারল্যান্ডের মত দেশের পলিটিক্যাল এলিটদের কাছ হতেও, যারা নিজেরা এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে চীনে প্রতিরোধ এসেছিল তাদের কাছ হতে, যারা মুদ্রাস্ফীতির ভোক্তভোগী এবং উভয়েই ক্রেতা এবং ব্যবসায়ী, যারা লাভজনক এবং প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন রফতানির সঙ্গে জড়িত।
তবে প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রই কিন্তু এই সংকটের কবলে পড়েনি। রাশিয়া প্রায় বছর আগেই এই সংকট কাটিয়ে ওঠতে পেরেছিল, ইতোমধ্যে তার রাজনৈতিক এলিটদের অর্থনীতির ওপর প্রভাব বজায় রেখেছে। ব্রাজিল এবং ভারতকে চীনের মত চরম সংকটে পড়তে হয়নি, যদিও তাদের চায়নার মত এতবেশি মাত্রার প্রবৃদ্ধির হার নেই। কিন্তু যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও চীন এমন সংকটাপন্ন হয় তখন এককথায় এটি যৌক্তিকভাবেই বলা যায় বিশ্ব অর্থনীতির ভারকেন্দ্র এবং তাদের সামরিক শক্তিও সংকটে পড়ে। সেটা কখনোই উপেক্ষা করা যায় না।
সংকট মানে একেবারে ভেঙে পড়া বা ধ্বংস হওয়া নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিক্যাল লেজিটিমিসি শক্তিশালী, ফলে তা যে কোনো অংশকেই মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। ইউরোপের রাজনৈতিক দিকটা দুর্বল হলেও ইউনিয়ন গঠনকারী প্রধান রাষ্ট্রসমূহ শক্তিশালী। অন্যদিকে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি একটি চরম শক্তির অস্তিত্ব হলেও দলটি অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে আলোচনা করে অভ্যস্ত নয়। দলটি রাজনৈতিক সংকট ধরে এমনভাবে আলোচনা করে যাতে দেশটির রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকরা অর্থনৈতিক সংকটসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এটিই একটি ভয়ানক রাজনৈতিক সংকট।
এটি অনুধাবন খুবই জরুরি যে, এটি কোন আদর্শগত বিষয় নয়। বামপন্থীরা বিশ্বায়ন এবং ডানপন্থীরা অভিবাসনের বিরোধিতা করছে। তারা পরস্পর একই রকম পদক্ষেপের মধ্যেই অবস্থান করছে। তারা উভয়েই এলিটদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। এটা শুধুমাত্রই শ্রেণি ইস্যুই নয়, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রত্যাশার অপ্রাপ্তি এই চ্যালেঞ্জের উৎস। এই চ্যালেঞ্জকারী প্রতিপক্ষ শ্রেণিটি খুবই ক্ষুদ্র অংশ, কিন্তু এদের দল ভারি হচ্ছে দ্রুতগতিতে। প্রকৃত সমস্যাটি হলো- প্রতিরোধকারীরা যখন এলিটদের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে তখন প্রতিরোধকারীদের মধ্যে বিশাল পার্থক্য একটা বিকল্প পলিটিক্যাল এলিট শ্রেণির উত্থানের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা কল্পনা করাও কষ্টকর।
বৈধতা সংকট
এটি হল তৃতীয় সংকট। এলিট শ্রেণিটির বৈধতাজনিত সংকটে পতিত হলে বা বৈধতা হারালে কিংবা এই শ্রেণিটি কোন অনাকাক্সিক্ষত শক্তি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে গেলে, এই পরিস্থিতিতে এলিটদের ঐক্যের চিন্তা পূর্বশর্ত কোন এক যৌক্তিক ভাবাদর্শ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই সংকট তাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দিবে। ইউরোপের ক্ষেত্রে তা শরিক রাষ্ট্রসমূহের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্রের ক্ষমতায়নই হতে পারে। চীনের ক্ষেত্রে তা আঞ্চলিক সংঘর্ষ থেকে খণ্ডায়নের দিকে যেতে পারে। এইসব হলো সংকটাবলীর চরম ফলশ্রুতি, কিন্তু আমরা দুটি জিনিস না বুঝে কখনোই অনুধাবন করতে পারব না আসলে কী হতে চলেছে। এর প্রথমটি হলো- রাজনৈতিক অর্থনীতিজনিত সংকট। তা যদি বৈশ্বিক নাও হয়, নিদেনপক্ষে প্রসারিত ও উদীয়মান হয়, তবে অবশ্যই কোন না কোনভাবে তা এই সংকটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবেই। দ্বিতীয়টি হলো- সংকটটি যদি হয় অর্থনৈতিক সমস্যা, তবে তা রাজনৈতিক সমস্যার উত্থান ঘটাবেই, যা বিপরীত পথে অর্থনৈতিক সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করবে।
অ্যাড্যাম স্মিথ-এর অনুসারীরা হয়ত ভাবতে পারেন যে, স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এক্ষেত্রে তার সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। সেজন্যই তিনি তাঁর বিখ্যাত বইটিকে বলতেন ‘দি ওয়েলদ অব নেসন (The Wealth of Nation)’। এটি ছিল সম্পদের ব্যাপারে এবং একই সঙ্গে জাতিসমূহের ব্যাপারেও। এটি ছিল রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর একটা কাজ, যা আমাদের তাই শেখায়, যা এই সময়ের জন্য সবচেয়ে, বেশি উপযোগী।
(জর্জ ফ্রেডম্যান-এর লেখা অবলম্বনে)
রাজনৈতিক ডটকম, ১৮ এপ্রিল ২০১১