শান্তির অন্বেষায় পাহাড়ি-বাঙ্গালি

গত ১৯ ও ২০ ফেব্র“য়ারি (২০১০) পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে পাহাড়িদের প্রায় ৩৫৭টি বাড়ি পুড়েছে এবং ১৫০০ পাহাড়ি হয়েছে গৃহছাড়া। ভয়ে-আতঙ্কে গভীর বনে চলে গেছে দু হাজারের বেশি পাহাড়ি নরনারী ও শিশু। অন্যদিকে এক শ’ বাঙালির বাড়ি পুড়েছে এবং গৃহহারা হয়েছে চার শতাধিক। পার্বত্য এলাকায় বিরাজমান এ সমস্যা একটি জাতীয় সমস্যা। এটিকে ছোট করে বা হেলাফেলা করে দেখার সুযোগ নেই। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং এর সমাধানের প্রক্রিয়ার প্রতি সমগ্র জাতির দৃষ্টি নিবদ্ধ। এ সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। পার্বত্য জনগণ ও রাষ্ট্রশক্তির মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা, সমস্যা সমাধানে পারস্পরিক আস্থার অভাব এবং সমতল ভূমির সঙ্গে পাহাড়ি জনগণের জীবন, জীবিকা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি ব্যবধানের পরিণতিই বর্তমান সংকটের কারণ।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিবাদের সূত্রপাত যেখান থেকে
বাংলাদেশের সর্ব পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত পাহাড় ও বন সম্পদে সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রাম। প্রশাসনিকভাবে তিনটি জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার মর্যাদা লাভ করে ১৯৮৩ সালে। ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৪৭ সালের ২০ আগস্ট। বৃটিশ আমলে ১৩টি উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনকার্য পরিচালিত হয়ে আসছিল ১৯০০ সালের হিল ম্যানুয়েল দ্বারা। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এই হিল ম্যানুয়েল বাতিল করে, যাতে উপজাতিদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি ছিল এবং জমির ওপর তাদের অধিকার প্রদান করা হয়েছিল। পাকিস্তান সরকারের একাধিক সিদ্ধান্ত উপজাতীয়দের ক্ষুব্ধ করে তোলে। কাপ্তাই বাঁধ হাজার হাজার পার্বত্যবাসীকে ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করে এবং কাপ্তাই হ্রদে ভেসে যায় চাকমা রাজার প্রাসাদ। এতে তারা খুবই বিক্ষুব্ধ হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭০ সালে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য এমএন লারমা ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৯৭৩ সালে তারা সংগঠনের সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী গঠন করে এবং সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শান্তিবাহিনী পাহাড়ি এলাকায় হত্যা, গুমসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যে লিপ্ত হয়। এই অবস্থার মোকাবিলার জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম পার্বত্য এলাকায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। শান্তিবাহিনীর আক্রমণে এ পর্যন্ত সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর প্রায় চার শতাধিক সদস্যসহ বিশ হাজার বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।

১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়ি বাঙ্গালি, জাতি-উপজাতির পার্থক্য ভুলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাঙ্গামাটি স্টেডিয়ামে আয়োজিত এক নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দেন। এ সময় রাজা ত্রিদিব রায়কে স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এতে উপজাতীয়রা আরও প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে। ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন করেন। এম.এন. লারমার নেতৃত্বে বিক্ষিপ্তভাবে বাঙ্গালি ও সেনাবাহিনীর ওপর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে জেএসএস নেতা সন্তু লারমা আত্মগোপনে চলে যান। সে বছরের ২৬ অক্টোবর তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৮০ সালে ছাড়া পান। ১৯৮১-তে একবার  গ্রেফতার হয়ে মুক্ত হওয়ার পর আবার তিনি আত্মগোপন করেন। এদিকে এসময় সংগঠনের (জেএসএস) মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টি হয়। প্রাথমিকভাবে সমঝোতা হলেও ১৯৮২ সালে অপর গ্র“পের আক্রমণে নিহত হন মানবেন্দ্র লারমা ও আরও আটজন নেতা। সন্তু লারমা দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। সে বছর অনুষ্ঠিত জনসংহতির সমিতির জাতীয় সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়, যার সভাপতি নির্বাচিত হন সন্তু লারমা। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সংগ্রামের পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে সংলাপের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের দীর্ঘ ১৩ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে এ চুক্তিটি সই হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল, দেশের সংবিধান অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। চুক্তি অনুযায়ী সরকারের প্রধান করণীয় ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ অঞ্চলের স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে বিশেষ শাসনব্যবস্থা কায়েম করা, ভূমি সমস্যার নিষ্পত্তি এবং জুম্মদের সংস্কৃতি-জীবনাচরণ সংরক্ষণ। চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে প্রতিটি সরকার দাবি করে এসেছে যে চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ এগোচ্ছে। তবে পাহাড়িদের মতে, চুক্তির মৌলিক বিষয়ের কোনোটিই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের পরও অনেক পাহাড়ি পরিবারকে তাদের বংশ পরম্পরায় ভোগ-দখল করা জমি বা বাগান থেকে জোর করে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এমনকি বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরও পাহাড়িদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ, দখল ও খুনের ঘটনা ঘটেছে।

চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গ
বিগত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতা গ্রহণের পরও সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের কথা। মহাজোট সরকার ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়ের বাস্তবায়ন এখনো শুরু করা হয়নি।

চুক্তি অনুযায়ী যা বাস্তবায়িত হয়েছে
চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে শান্তিবাহিনীর প্রায় দু হাজার সদস্য অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। তখন তাঁদের প্রত্যেককে সরকার ৫০ হাজার টাকা করে দেয়। অনেকটা অবসান হয় পাহাড়ে চলতে থাকা প্রায় দু দশকের শান্তিবাহিনী-সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী বন্দুক যুদ্ধের। ১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর চুক্তিটি মন্ত্রিপরিষদে পাস হয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১০০ দিনের মধ্যে যে কাজগুলো সম্পন্ন করার কথা ছিল, এর অংশ হিসেবেই গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ১৯৯৮ সালের ৩, ৪ ও ৫ মে যথাক্রমে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন এবং ৬ মে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন পাস হয়। ১৯৯৯ সালের ৯ মে অন্তর্বর্তীকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে পাহাড়ি শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স গঠিত হয়। সে বছরই সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে। এছাড়া জেএসএস-এর ৬৪ জন ও প্রত্যাগত শরণার্থীদের ১৮৪ জনকে সরকারি চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়। জেএসএস-এর ৬৭৫ জনকে পুলিশ কনস্টেবল ও ১১ জনকে ট্রাফিক সার্জেন্ট পদে নিয়োগ দেয়া হয়।

গুরূত্বপূর্ণ যা বাস্তবায়িত হয়নি
পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলের স্বীকৃতি দেয়া এবং এর বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের কোনো পদক্ষেপ সরকার এখন পর্যন্ত নেয়নি। আঞ্চলিক পরিষদের দায়িত্ব এবং ক্ষমতাও কার্যকর করা হয়নি। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছেও যথাযথ দায়িত্ব ও ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদ বিধিমালাসহ অন্যান্য বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের নির্বাচনও করা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী তিন জেলার অস্থায়ী সেনাক্যাম্পও সরিয়ে নেওয়া হয়নি। তবে এ ধরনের প্রায় ৫০০ ক্যাম্পের মধ্যে বর্তমান সরকার ৩৫টি এবং এর আগে আরও ৩১টি ক্যাম্প সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলের প্রধান সমস্যা ভূমি বিরোধ ও ভূমিদখল। পার্বত্য চুক্তির ১৩ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু এখনো এ সমস্যার কোনো পরিপূর্ণ সমাধান হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে হলেও পার্বত্য অঞ্চলে এখনো ভূমিদখল এবং বসতি স্থাপন অব্যাহত রয়েছে। শান্তিচুক্তির ৫নং শর্ত অনুযায়ী একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান করে ২০০১ সালে গঠন করা হয় নয় সদস্যের পার্বত্য ভূমি কমিশন। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ কমিশন আইনি সীমাবদ্ধতা, অর্থ ও লোকবল সংকটের কারণে নয় বছরে কাজই শুরু করতে পারেনি। দফায় দফায় কমিশনের কাঠামোর রদবদল হয়েছে মাত্র। এক-এগারোর পরে সর্বশেষ বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে গঠিত হয় নতুন ভূমি কমিশন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে প্রশাসন তিনভাবে বিভক্ত। এক. বেসামরিক প্রশাসন; দুই. সামরিক প্রশাসন; তিন. পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। এই তিন অংশের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এই তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুর্বলতর স্থানে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। অথচ আঞ্চলিক পরিষদকে ক্ষমতায়ন করাই ছিল শান্তিচুক্তির মর্মবাণী। পাশাপাশি, দীর্ঘদিনের দাবি সত্ত্বেও বেসামরিক প্রশাসনের ভূমিকাও গৌণই রয়ে গেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পুনর্বাসিত বাঙ্গালি
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া পাকিস্তান সরকারের আমল থেকেই শুরু হয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার রাঙ্গামাটি, রামগড় ও বান্দরবানে অনেক বাঙ্গালিদের বসতি স্থাপন করে দেয়। ১৯৬৬ সনে আবার কয়েক হাজার বাঙ্গালিদের পুনর্বাসিত করে। বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পর পরই দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রায় ৫০,০০০ বাঙ্গালি পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করে। ১৯৭৪ সালে এম.এন.লারমা পাহাড়িদের পক্ষে আন্দোলনে নামলে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া স্থিমিত হয়ে যায়। ১৯৭৯ সালে সরকার গোপন সার্কুলারের মাধ্যমে পুনরায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালিদের বসতি স্থাপন প্রক্রিয়া আরম্ভ করে। ঐ বছরই সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বিধিমালার ৩৪ নং বিধি সংশোধনের মাধ্যমে সেখানে পুনর্বাসনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূরীভূত করে। একই বছর সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০,০০০ ভূমিহীন বাঙ্গালি পরিবার পুনর্বাসিত হয়। এরপর ১৯৮০ সালের শেষের দিকে আরও ২৫,০০০ পরিবার পুনর্বাসিত হয়ে যায়। এভাবে ১৯৮৪ সালের মধ্যে ৪,০০,০০০ বাঙ্গালি পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত হয়। ১৯৮৬ সালের দিকে সরকারি প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী তাদের দেয়া হয় খাস জমি হিসেবে পাহাড় ও টিলা। এসব সেটেলারের প্রায় সবাই ছিলেন নদীভাঙা এলাকার এবং হতদরিদ্র। ১৯৫১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনসংখার পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ হাজার ৭০ জন (মোট জনসংখ্যার ৬%)। আর ১৯৯১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৩০১ জন (মোট জনসংখ্যার ৪৯%)। মূলত পার্বত্য এলাকার উপর পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের হস্তক্ষেপ খর্ব করা এবং সেখানে বাঙ্গালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করাই ছিল এই পুনর্বাসনের প্রধান উদ্দেশ্য।

১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর সাক্ষরিত শান্তি চুক্তিতে পাহাড়িদের শান্তির কথা বিবেচনা করা হলেও ভাবা হয়নি পুনর্বাসিত বাঙ্গালিদের কথা। হাজারো সমস্যার মধ্যে দিনাতিপাত করছে তারা। বাইরের দুনিয়া থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দুর্গম পাহাড়ের চরম নিরাপত্তাহীনতায় বসবাস করছে এসব পুনবার্সিত বাঙ্গালিরা। তাদেরকে ৫ একর জমি ও এককালীন অর্থ দেওয়ার কথা বলে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। কিন্তু তারা কেউই এক থেকে দেড় এককের বেশি জমি পায়নি। বাঙ্গালিদের জীবন-জীবিকা, শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বসবাস সবকিছুর নিয়ন্ত্রক উপজাতি নেতারা। পার্বত্য এলাকায় বসবাস, ফসল লাগানো কিংবা বিক্রি করতে হলে জেএসএস, ইউপিডিএফসহ উপজাতিদের বিভিন্ন সংগঠনকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়।

পার্বত্যাঞ্চলে সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৮০ ভাগ চাকরির সুবিধা ভোগ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতিরা। বাকি ২০ ভাগ বাঙ্গালিদের জন্য। বার্ষিক বরাদ্দকৃত ৯৫ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্যের মধ্যে ২০ হাজার মেট্রিক টন বিশেষভাবে বরাদ্দ করা হয় উপজাতিদের জন্য। অবশিষ্ট অংশ বণ্টন করা হয় শরণার্থী, গুচ্ছগ্রাম ও উপজাতি অধূষ্যিত অঞ্চলের বিভিন্ন উন্নয়নে। এক্ষেত্রে বাঙ্গালিদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। উন্নয়ন বরাদ্দের শতকরা ৯০ ভাগ উপজাতিদের জন্য ব্যয় করা হয়। শান্তিচুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতরের প্রধান কর্তারা উপজাতীয়। সে কারণেও দুটি সরকারি দফতর থেকে বাঙ্গালিরা কোনোরকম সুবিধাই পাচ্ছে না।

শেষকথা
বাংলাদেশ কেবল বাঙালির রাষ্ট্র নয়, এখানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল সবাই সম-মর্যাদার নাগরিক। এই উপলব্ধি বাংলাদেশের সংহতি ও সুশাসনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এই বিশ্বাস ধারণ করতে হবে যে, পাহাড়িদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সেই বোধের বিকাশ ভিন্ন পার্বত্য সমস্যা সমাধানের কোনো পথ নেই। আসলে পাহাড়ি-বাঙালি সৌহার্দ্যই পার্বত্যাঞ্চলের শান্তি ও উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত। পাহাড়ি এসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ এখনও মূল রাজনৈতিক ধারায় ফিরে আসেনি বা আসতে পারেনি। নীতি নির্ধারকদের অবহেলা, উপেক্ষা আর ভুল পদক্ষেপে পার্বত্যবাসীর মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তার টেকসই সমাধান করতে হবে। সরকারকেই চেষ্টা করতে হবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে সংহতির বাতাবরণ রচনার।

২৫ মার্চ, ২০১০

Leave a Reply

Your email address will not be published.