উপজেলা নির্বাচনে জয়ী কে?

গতকাল (৩১ মার্চ ২০১৪) সর্বশেষ পঞ্চম দফায় ৭৩টি সহ ৪৫৮টি উপজেলায় (দেশের উপজেলার সংখ্যা ৪৮৭টি) নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রায় সমাপ্ত হলো চতুর্থ উপজেলা নির্বাচন-২০১৪। আদালতের নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন কারণে ২৯টি উপজেলায় নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত ৪৫১টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ ২১৯টিতে, বিএনপি ১৫৬টিতে, জামায়াতে ইসলামী ৩৬টিতে, জাতীয় পার্টি ৩টিতে, স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দলের সমর্থিত প্রার্থীরা ৩৭টিতে জয়ী হয়েছেন (তথ্যসূত্র: প্রথম আলো)। আর মানবজমিন-এর (১ এপ্রিল ২০১৪) প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাপ্ত ৪৪৭টি উপজেলায় আওয়ামী লীগ ২২৪টি, বিএনপি ১৬০টি, জামায়াতে ইসলামী ৩৫টি, জাতীয় পার্টি ৩টি ও অন্যান্য দলের সমর্থিত প্রার্থীরা ২৫টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন। তবে তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনের (২০০৯) তুলনায় চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা ৭৮ উপজেলায় কম জয়ী হয়েছেন।

প্রথম দু দফায় ৯৭টি উপজেলায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন, যেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ৮০টি আসনে জয় পান। এ দু দফায় বড় ধরনের কোন সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু তৃতীয় দফা থেকে  দেখা দেয় সহিংসতা। সহিংসতার পরিমাণ পরবর্তী ধাপগুলোতে আরও বৃদ্ধি পায়। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, নির্বাচনে সহিংসতার মাত্রা যত বেড়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের জয়ও তত বেড়েছে।

প্রাপ্ত সর্বশেষ ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে ৬৩টি উপজেলায় বেশি জয় পেলেও নৈতিকভাবে দলটির পরাজয় হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। কারণ আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার সঙ্গে সহিংসতার সম্পর্ক স্পষ্ট। নির্বাচন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, জাল ভোট দেয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে সংঘর্ষ, হানাহানি, বোমাবাজি ও অগ্নিসংযোগের মত সহিংসতা একটি ধাপের চেয়ে অন্য ধাপে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাঁচ দফায় মোট ১০৯টির মতো ভোটকেন্দ্র স্থগিত করা হয়। প্রথম দফায় ১০টি, দ্বিতীয় দফায় ২১টি, তৃতীয় দফায় ২৬টি, চতুর্থ দফায় ৩৩টি ও পঞ্চম দফায় ১৯টি) ভোটকেন্দ্র স্থগিত করা হয়। প্রথম দফা নির্বাচনে ৬, দ্বিতীয় দফায় ১০০ এবং তৃতীয় দফায় মোট প্রায় ৩৬৫ কেন্দ্রে, চতুর্থ দফায় ২২০ কেন্দ্রে এবং পঞ্চম দফায় পাঁচ হাজার ৪৩৪ কেন্দ্রের মধ্যে প্রায় এক হাজার ১০০ কেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা ঘটে। এছাড়া অনেক কেন্দ্রে সংঘর্ষ না হলেও নীরবে প্রশাসনের সহায়তায় ভোট জালিয়াতি হয়েছে (প্রথম আলো, ১৭ মার্চ ২০১৪)।

প্রথম দফা নির্বাচনে তেমন একটা অনিয়মের ঘটনা না ঘটলেও দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হন তিন জন। তৃতীয় দফায় নিহত হন তিন জন এবং আহত হন দু শতাধিক (প্রথম আলো, ১৬ মার্চ ২০১৪)। চতুর্থ দফায় সহিংসতায় নিহত হন চার জন, আহতের সংখ্যা কমপক্ষে আড়াইশ (প্রথম আলো, ২৪ মার্চ ২০১৪)। সর্বশেষ পঞ্চম দফা নির্বাচনে নিহত হন এক জন (প্রথম আলো, ১ এপ্রিল ২০১৪)।

কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে পঞ্চম দফা নির্বাচনে ২০ উপজেলায় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত, বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র ৩৭ জন প্রার্থী (যুগান্তর, ১ এপ্রিল ২০১৪)। একই অভিযোগ এনে এর আগের দফাগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপজেলায় বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত, বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করেন।

নির্বাচনে এ পরিমাণ সহিংসতা হলেও তা অস্বীকার করছে নির্বাচন কমিশন। পঞ্চম দফায় সোমবার (৩১ মার্চ ২০১৪) ৭৩টি উপজেলায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করেছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক। তিনি বলেন, গতবারের তুলনায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তাই আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।’ এর আগে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া-না-হওয়া আল্লাহর ওপর নির্ভর করে দাবি করে নিজেদের দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যায় কমিশন।

একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ তথা গ্রহণযোগ্য জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে আমাদের সংবিধান কমিশনকে একটি ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম মামলার (ডিএলআর ৪৫, ১৯৯৩) রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেছেন, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করা করণীয়, তার সবই করতে পারবে, এমনকি আইন ও বিধি-বিধানের সংযোজনও করতে পারবে। কিন্তু নির্বাচনে প্রচুর পরিমাণে আচরণবিধি লঙ্ঘন তথা ব্যালট ছিনতাই, কেন্দ্র দখল, জালভোটসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটে খোদ পুলিশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সামনেই। এসব ঘটনার ব্যাপারে কমিশন তেমন কোনো শক্ত পদক্ষেপ নেয়নি (প্রথম আলো, ৩০ মার্চ, ২০১৪)।

প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর থেকে (সর্বশেষ দশম জাতীয় নির্বাচন ছাড়া) গত বছরের শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কয়েক হাজার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একজন ব্যক্তিরও প্রাণহানি ঘটেনি। তাই নাগরিক হিসেবে আমাদের মনে আশা জেগেছিল যে, নির্বাচনী সহিংসতা ও অনিয়মের অভিশাপ থেকে বোধহয় আমরা মুক্ত হয়েছি। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে যে পরিমাণ কারচুপি ও সহিংসতা হয়েছে তা নাগরিক হিসেবে আমাদের শঙ্কিত করছে। কারণ আমরা মনে করি, নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি ও সহিংসতা অব্যাহত থাকলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। অর্থ ও পেশিশক্তিই তখন নির্বাচনে জেতার মূল নিয়ামক হয়ে দাঁড়াবে। এর মাধ্যমে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।

অনলাইন বাংলা (একটি অনলাইন দৈনিক), ১ এপ্রিল ২০১৪

Leave a Reply

Your email address will not be published.