এক.
বাঙ্গালি জাতির জীবনে ৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি এক গৌরবময় দিন। যেমন গৌরবোজ্জ্বল ৭১’র ১৬ ডিসেম্বর। ফেব্রুয়ারি-ডিসেম্বর মাসের এ দুটি দিন এ জাতি কোনো দিন ভুলবে না, ভুলে যাওয়ার মত নয়। একটিতে বাঙ্গালি জাতির সূচনা, অন্যটির মাধ্যমে জাতির পূর্ণতা। অমর একুশে জনতার প্রতিবাদের এক অদম্য প্রাণশক্তি, যা পরবর্তীতে পরিণত হয় মুক্তিযুদ্ধের মহাপ্লাবনে। ৭১’র ১৬ ডিসেম্বর যার সার্থক রূপ। বাংলা ভাষার প্রতি মমতা, দরদ ও স্পৃহা বাঙ্গালির ধমনীতে ছিল সদা বহমান। কিন্তু এ ভাষা নিয়ে হয়েছে বহু ষড়যন্ত্র। স্বাজাত্যবোধসম্পন্ন বীর বাঙ্গালির প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে সফল হয়নি এসব ষড়যন্ত্র।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটে সপ্তম শতাব্দীতে। তাঁর মতে, বাংলাদেশের অধিবাসীরা প্রথম থেকেই বাংলা ভাষায় কথা বলত না। বর্তমান বাংলা ভাষা প্রচলনের আগে গৌড় ও পুন্ড্রের লোকেরা অসুর ভাষাভাষী ছিল। এই অসুর ভাষাই ছিল আমাদের দেশের ভাষা। বাংলাদেশে আর্যদের আসার আগে এদেশবাসী যে ভাষা ব্যবহার করতেন, তার কোন নিদর্শন আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
ধরে নেয়া হয়, বাংলা ভাষার প্রাথমিক স্তর পঞ্চম থেকে দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় উদ্ভূত হয়েছিল। সেন রাজগণ বিদেশি ছিলেন বলে বাংলা সম্বন্ধে বিশেষ কৌতূহলী ছিলেন না। তাদের সভায় সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের প্রাধান্য ছিল বেশি। বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও প্রসার লাভ ঘটেছে বৌদ্ধ আমলে; বিশেষ করে স্বাধীন পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। পাল এবং সেন বংশীয় রাজাদের আমলে বাঙালি জনগণ ও তাদের ভাষাও অন্যতম মুখ্য বিশিষ্টতা প্রাপ্ত হয়। নতুন ভাষা বাঙলার রূপ গ্রহণের সাথে সাথে বাঙালির মানসিক সংস্কৃতি এই ভাষার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের কাজে লেগে গেল-আনুমানিক দশম শতক হতে প্রাচীন বাঙলায় রচিত বৌদ্ধ চর্যাপদকে অবলম্বন করে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক ইতিহাস শুরু হয়।
মধ্যযুগে [১২০০-১৮০০ সাল] আরকান রাজ সভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা হয় এবং সেখানকার মুসলমান কবিগণ ধর্ম সংস্কার মুক্ত মানবীয় প্রণয়কাহিনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করে এক নতুনতর বৈশিষ্ট্য দেখান। আরকান রাজসভার বাংলা সাহিত্যের একজন নামকরা কবি মহাকবি আলাওল, যাঁর সাহিত্য সম্পদের প্রাচুর্য সহজেই চোখে পড়ার মত। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে রূপ নিয়ে আমরা গর্ব করি তা প্রকৃত প্রস্তাবে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে মুসলিম শাসনামল থেকে। ইলিয়াস শাহীর আমলে (১৩৫২-১৪১৪, ১৪৪২-১৪৮৭ সাল) সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং পরবর্তীতে হুসেইর শাহীর আমলে (১৪৯৩-১৫৩৮) বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত করতে অবদান রাখে। বাংলা ভাষায় মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় আত্মপ্রকাশ করেছিল। ইতরের ভাষা বলে বাংলা ভাষা পণ্ডিত সমাজে অপাংক্তেয় ও উপেক্ষার পাত্র ছিল।
ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে বাংলার মুসলমানদের যতখানি হাত রহিয়াছে হিন্দুদের ততখানি নহে। এদেশের হিন্দুগণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্মদাতা বটে; কিন্তু তাহার আশৈশব লালন পালন ও রক্ষাকর্তা বাংলার মুসলমান। স্বীকার করি, মুসলমান না হইলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য মনোরম বনফুলের ন্যায় পল্লীর কৃষককণ্ঠেই ফুটিয়া উঠিত ও বিলীন হইত, কিন্তু তাহা জগতকে মুগ্ধ করিবার জন্য উপবনের মুখ দেখিতে পাইত না বা ভদ্র সমাজে সমাদৃত হইত না।’
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হবার পর বাংলা সাহিত্যে আবার পালা বদল হল। অবসান ঘটে মুসলিম শাসনের। ফারসির বদলে নতুন রাষ্ট্র ভাষা হল ইংরেজি। ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের প্রভাবে ইংরেজি পড়া বাঙালির হাতে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়া পত্তন হয়। ফোর্ড উইলিয়ামের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতগণ বাংলাভাষায় পণ্ডিতী রীতির জন্মদান করেন এবং বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের আমলে বাংলা ভাষা এক রকম বাঙালিত্ব বর্জন করে খাঁটি আর্য ভাষায় (সংস্কৃত) রূপান্তরিত হয়।
তবে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং তৎপরবর্তীতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে যে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেন তা অবিস্মরণীয়। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের সবকটি শাখা সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি নানা বৈচিত্রে ও অভূতপূর্ব অবদানে বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেন। একইসাথে সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয় বাংলা ভাষাও। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয় অতিক্রম করে তিনি বাংলা কাব্যে এক নতুন ধারার যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসেন।
দুই.
বাঙালির এই প্রাণের ভাষা, মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জোরালো হতে থাকে ব্রিটিশ আমল থেকেই। ১৯২১ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য লিখিত প্রস্তাব পেশ করেছিলেন নওয়াব আলী চৌধুরী। ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯২৮ সালে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব ভারতীয়’ এক সভায় ভাব ও সাহিত্যগুণে বাংলাভাষাকে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ভাষা উল্লেখ করেছিলেন। ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ গৃহীত হওয়ার আগেই বাংলাভাষাকে ভারতের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠেছিল। ১৯৪৬ সালের ৩ জুন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের ভারত বিভাগ পরিকল্পনা ঘোষণা হওয়ার পর উপমহাদেশের রাজনীতিতে ভাষা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্ট ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে ‘ভারত ইউনিয়ন’ এবং পাকিস্তান নামে দুটি সার্বভৌম দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পূর্ব বাংলা, পানুর, বেলুচিস্তান, সিন্ধু, কাশ্মির, সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে গঠিত হয়েছিলো স্বাধীন পাকিস্তান। পাকিস্তানের প্রায় ৫৬ শতাংশ নাগরিক বাংলাভাষী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাভাষাকে অবজ্ঞা করার চক্রান্ত করা হয় বিভিন্নভাবে। এতে বাঙ্গালি শিক্ষিত সম্প্রদায় প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম ও নুরুল হক ভূঁইয়ার একান্ত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ‘তমুদ্দন মজলিস’ নামে একটি সংগঠন। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর সভাপতিত্বে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের প্রথম প্রকাশ্য দাবি উত্থাপিত হয়। অচিরেই এ দাবি সার্বজনীন দাবিতে পরিণত হয়।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে পাকিস্তানের জনক কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেনÑ ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। এই মন্তব্য ছাত্র সমাজকে প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত করে। ২৪ মার্চ তাঁর সম্মানে আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমার্বতন অনুষ্ঠানে তিনি আবারো বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। এই মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ছাত্ররা ‘না না’ বলে প্রতিবাদ জানায়, ক্রমান্বয়ে ভাষার অধিকার রক্ষার সংগ্রাম সুদৃঢ় হতে থাকে।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকালে ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। পরীক্ষামূলক ২১টি কেন্দ্রে বাংলাভাষাকে আরবি হরফে লেখার প্রচেষ্টা সফল হয়েছে, জনগণ স্বীয় উদ্যোগে নতুন নতুন কেন্দ্র খুলছে।’ এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ৩০ জানুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট ও সভা আহ্বান করে। ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা জেলা লাইব্রেরিতে মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় গঠন করা হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ২১ ফেব্র“য়ারি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ অধিবেশনের তারিখ হওয়ায় ঐ দিন গোটা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই কর্মসূচি বানচালের জন্য ২০ ফেব্র“য়ারি অপরাহ্নে নুরুল আমিন সরকার ঢাকা শহরে একমাস মেয়াদি ১৪৪ ধারা জারি এবং সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সরকারি ঘোষণায় ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি (বাংলা ১৩৫৮ সালের ৮ ফাল্গুন) সরকারি আইন অমান্য করে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ছাত্রসমাজ ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথে নেমে আসে। তখন ধৈর্য্য, সহনশীলতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় না দিয়ে সরকারের বাহিনীগুলো আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ শুরু করলে বহু ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয়। বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউর ঘটনাস্থলেই মারা যান। ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা পূর্ব পাকিস্তান। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বিশ্ব ইতিহাসে আত্মত্যাগের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বাঙ্গালি জাতি। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ সূচিত হয়।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি অত্যন্ত আবেগঘন ও শ্রদ্ধাভরে প্রথম শহীদ দিবস পালন করা হয়। ছাত্ররা মেডিকেল কলেজের বিলুপ্ত শহীদ মিনারের জায়গায় কালো কাপড় ও কাগজ দিয়ে প্রতীকী শহীদ মিনার বানায়। ১৯৫৪ সালের ৯ মে পাকিস্তান গণপরিষদ বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সংবিধানের ২১৪নং অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ২১ ফেব্রুয়ারিকে আনুষ্ঠানিক শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আইয়ুব খানের সামরিক সরকার ১৯৫৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ছুটির দিবস বাতিল করে। জনগণের প্রতিবাদের মুখে ১৯৬৯ সালে এ ছুটি পুনরায় বহাল করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এ ছুটি আজ পর্যন্ত বহাল আছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশের সংবিধানে প্রথম ভাগের ৩নং অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯৮৭ সালে দেশের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য বাংলা ভাষা আইন প্রণয়ন করা হয়।
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১১