ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা: দায় কার?

ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে ২২ মার্চ ২০১৬ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল প্রথম দফার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এ দফায় ৭১২টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ৬৪০টি ইউনিয়নের নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৪৬৯টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ৪৯টি জাতীয় পার্টি-জেপি ৭টি, জাসদ ৩টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ২টি, জাতীয় পার্টি ২টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১০৭টি ইউনিয়নে জয়ী হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যথাক্রমে ৩৬.৪৮% ও ১১.৫০% ভোট পেয়েছে (প্রথম আলো, ২৫ মার্চ,২০১৬)।

এবারই প্রথমবারের অনুষ্ঠিত হলো দলভিত্তিক ইউপি নির্বাচন (শুধুমাত্র চেয়ারম্যান পদে)। তাই স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনে দল বা সরকারের কোথাও প্রত্যক্ষ, আবার কোথাও পরোক্ষ প্রভাব থাকবে এমনটাই মনে করা হয়েছিল। বাস্তবে হয়েছেও তাই। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি নির্বাচনপূর্ব ও নির্বাচনকালীন ব্যাপক সহিংসতা। ৩৬টি জেলায় অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ৩২টিতেই সহিংসতা ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হানাহানির অভিযোগ সরকার দলীয় প্রার্থী বা দলসংশ্লিষ্ট স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিরুদ্ধেই উঠেছে। গণমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যমতে, নির্বাচনের দিনেই বিভিন্ন ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ১১ জন এবং আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। অনিয়মের কারণে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয় ৬৫টি কেন্দ্রে। ভোট গ্রহণ নির্বাচনের পরের দুইদিনে নির্বাচনের দিনে আহত আরও তিনজন-সহ নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৬ জন। আহতদের মধ্যে শতাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের পূর্বেই সারাদেশের অনেক এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ১০ জন এবং আহত হয়েছেন দুই সহস্রাধিক। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ২৭ এবং আহত সাড়ে তিন হাজারেরও অধিক।

সর্বশেষ ২০১১ সালে দু দফায় মোট ৪ হাজার ৩৬৬টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২৯ মার্চ-০৩ এপ্রিল প্রথম দফায় ৫৫৩টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ দফায় কেউ নিহত হয়নি, আহত হয়েছিলেন ১৫৫ জন। দ্বিতীয় দফায় ৩১ মে-০৫ জুলাই পর্যন্ত ৩ হাজার ৮১৩টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ দফায় ১ হাজার ৫৪৩ জন আহত ও ২২ জন নিহত হন। সবমিলিয়ে ২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনে প্রায় ১ হাজার ৭ শ’ জন আহত ও ২২ জন নিহত হন (প্রথম আলো, ৩০ মার্চ-০৬ জুলাই ২০১১)।

উপরের পরিসংখ্যান থেকে এটি স্পষ্ট যে, ২০১১ সালে প্রথম দফায় কেউ নিহত না হলেও এবার প্রথম দফা নির্বাচনেই ২২ জন নিহত হয়েছেন। এ সহিংসতার একটি বড় কারণ ছিল নির্বাচনকে প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকে গ্রহণ না করে মরিয়া হয়ে জয়ের প্রচেষ্টা চালানো। সহিংসতা ছাড়াও নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক অভিযোগ উঠে যেমন, ভোটকেন্দ্রে প্রতিপক্ষের এজেন্টদের ঢুকতে না দেয়া বা ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া; বুথ দখল করে বা ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মারা; লাইনে দাঁড়িয়ে জ্যাম সৃষ্টি করে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করা; ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা; ভোটকেন্দ্রের বাইরে পেশিশক্তি প্রদর্শন; নির্বাচন কর্মকর্তাকে গুলি করে আহত করা; চেয়ারম্যান প্রার্থীকে প্রকাশ্য ভোট দিতে বাধ্য করা (এক্ষেত্রে ভোটদানের জন্য দাঁড়ানো লাইনের আশেপাশে ঘুরে দলীয় কর্মীদের ভোটাদের শোনাতে দেখা গিয়েছে- ‘চেয়ারম্যানের ভোট ওপেনে, অন্যদের ভোট গোপনে’); ভোটারদের হাতে শুধুমাত্র সদস্য পদপ্রার্থীদের ব্যালট পেপার দেয়া; নির্বাচনী কর্মকর্তা কর্তৃক ব্যালট পেপারে সিল মারা বা সিল মারতে সহায়তা করা; নির্বাচনের পূর্বে, নির্বাচনকালে ও নির্বাচনের পর ব্যাপক সহিংসতা, হামলা, ভাংচুর, লুট-পাট, অগ্নি-সংযোগ; এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, ভাংচুর, লুট-পাট, অগ্নি-সংযোগ, দেশত্যাগের জন্য হুমকি প্রদান।

একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ তথা গ্রহণযোগ্য জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে আমাদের সংবিধান কমিশনকে একটি ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কমিশন যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সে লক্ষ্যে ২০০৮ সালে জারি করা এক অধ্যাদেশ-এর মাধ্যমে কমিশনের সচিবালয়কে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে বিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম মামলার (ডিএলআর ৪৫, ১৯৯৩) রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেছেন, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করা করণীয়, তার সবই করতে পারবে, এমনকি আইন ও বিধি-বিধানের সংযোজনও করতে পারবে। আফজাল হোসেন বনাম প্রধান নির্বাচন কমিশনার-এর (ডিএলআর ৪৫, ১৯৯৩) মামলার রায়েও সুপ্রিম কোর্ট একই মত দিয়েছেন।

অথচ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুটি রোধে কমিশনকে নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। গণমাধ্যমে মনোনয়নপত্র জমাদানে ব্যাপক অনিয়মের খবর প্রকাশিত হলেও বিষয়টি কমিশন সেভাবে আমলে নেয়নি। চেয়ারম্যান পদে প্রথম ধাপে ২৫টি এবং দ্বিতীয় ধাপের জন্য ১৩টি ইউনিয়নে শুধুমাত্র ১টি করে মনোনয়ন পত্র দাখিল হলেও এবং অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কিত প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও, নির্বাচন কমিশন বিষয়টি তদন্ত করে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং কমিশনের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, অভিযোগ না পেলে তারা কোনো অনিয়মের বিষয়কে আমলে নেবে না। অভিযোগ করা হলে বলা হয়েছে, অভিযোগ সুনির্দিষ্ট নয়। এমনকি সুস্পষ্টভাবে অভিযোগ করলেও কমিশন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে পদক্ষেপ গ্রহণের দায় চাপিয়েছে কখনও রিটার্নিং অফিসার বা কখনও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের উপর।

নির্বাচনের আগের দিন গণমাধ্যমের কাছে দেয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের বক্তব্যও ছিল হতাশাজনক। তিনি তখন বলেছিলেন, “আমরা নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রের অন্য বিভাগের ওপর নির্ভরশীল। যে কারণে তাদের উপর আমাদের কর্তৃত্ব কম। কাক্সিক্ষত সহযোগিতা পাই না। সেজন্য মারপিট হানাহানি অব্যাহত আছে। নির্বাচন অর্থকেন্দ্রিক হয়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনে সহিংসতা আমাদের চরিত্রগত। নির্বাচনের এই চিত্র আগে থেকেই আমরা বহন করে চলেছি। তাই এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে সময় লাগবে’। সিইসি’র এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্বই প্রকাশ পায়। এই ধরনের বক্তব্য মানুষের মধ্যে আস্থা সৃষ্টির পরিবর্তে শঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।

মূলত, একটি নির্বাচনের সঙ্গে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকলেও নির্বাচন পরিচালনার মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশনের আইনি, নৈতিকতাপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও সাহসী ভূমিকাই পারে কোনো নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অর্থবহ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে।

প্রথম দফার ভুলগুলো শুধরে নিয়ে সামনের নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজন করতে হলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেই যাতে নির্বাচনী আচরণবিধি যথাযথভাবে মেনে চলেন, সে ব্যাপারে নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি সকল দল ও প্রার্থীর জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে হবে। কালোটাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। কেউ নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করলে তাৎক্ষণিকভাবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে ভোটদানের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার বা ব্যালট বাক্স ছিনতাই রোধে পূর্ব থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচনে যারা প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় তাদের মনোনয়নপত্র জমাদানের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং দ্রুততার সাথে অনলাইনে জমাদানের বিধান করতে হবে।

পরিশেষে, আমরা মনে করি, নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি ও সহিংসতা অব্যাহত থাকলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। অর্থ ও পেশিশক্তিই তখন নির্বাচনে জেতার মূল নিয়ামক হয়ে দাঁড়াবে। এর মাধ্যমে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা আমাদের কারোই কাম্য নয়।

লেখক: নেসার আমিন, লেখক ও উন্নয়নকর্মী।

Leave a Reply

Your email address will not be published.