মার্ক্স পাঠের প্রাসঙ্গিকতা ও এর প্রায়োগিক দিক নিয়ে কিছু কথা

গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর অংশগ্রহণ করেছিলাম বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম-এর পাবলিক লেকচারে। ডাকসু’র দোতলায় অনুষ্ঠিত ঐ লেকচারের বিষয় ছিলো- ”মার্ক্স পাঠের ভূমিকা”। মূল বক্তা ছিলেন- কে এন ঈপ্সিতা- গবেষক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিউট। জনাব ঈপ্সিতা’র বক্তব্য শেষে আমাকে অভিমত ব্যক্ত করতে বলা হলো। আমি নিজে মার্ক্স সর্ম্পকে কিছুটা পড়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছার মত অবস্থায় যেতে পারিনি। তাই আমার কথাগুলো নবীন পাঠকের মত মনে হতে পারে।

আমি বললাম যে, মূলত তিনটি কারণে আমি মার্ক্স পড়ি। প্রথমত, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া, দ্বিতীয়ত, মার্ক্সের রাজনৈতিক ও দর্শন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া, তৃতীয়ত, বিদ্যমান পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি সম্মক ধারণা পাওয়া।

মূলত, জার্মান নাগরিক কার্ল মার্ক্স (১৮১৮ – ১৪ই মার্চ, ১৮৮৩) ছিলেন মানবতাবাদী দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ বিশেষজ্ঞ। তিনি শ্রেণীহীন শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
মার্ক্সের দর্শনে তিনটি সমকালীন ধারণার প্রভাব ছিলো। একটি হচ্ছে হেগেল, কান্ট এবং ফয়েরনেখের জার্মান দর্শন – যা মার্ক্সকে দিয়েছিলো তার দ্বান্দিক বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তি, অন্যটি হচ্ছে উনবিংশ শতকের ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডোর অর্থনৈতিক তত্ত্ব – যা মার্ক্সকে অনুপ্রাণিত করেছিলো তার অর্থনৈতিক তত্ত্ব সাজাতে। আর সর্বোপরি ফরাসী বিপ্লবের চিন্তাধারা তাকে বাতলে দিয়েছিলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব নির্মাণের পথ।

মার্ক্স পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার শোষণমূলক এবং মানবতাবিরোধী রূপ দেখে ব্যথিত হন এবং বঞ্চিত মানুষকে উদ্ধারের জন্য উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। তার জীবদ্দশায় পৃথিবীর আর্থ সামাজিক বিন্যাসের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে মানব ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার ভিত্তি খুঁজে নেন, এবং তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন মার্ক্স। মার্ক্স ধারণা করেছিলেন, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একদিকে যেমন শোষিত শ্রেণি নিদারূণভাবে শোষিত এবং নিপীড়িত হবে, তেমনি তাদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে তারা যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে শামিল হবে, আর তাতে তাদের বিজয় হবে অনিবার্য। জনগণ প্রবেশ করবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়।
তিনি মনে করেন, এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানায় পরিচালিত হবে। তাই এই উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যে উদ্বৃত্ত মূল্য বা ‘সারপ্লাস’ ভ্যালু তৈরি হবে, তা সমাজের স্বার্থেই পুনর্বিনিয়োগ করা হবে। এর পরবর্তী পর্যায়ে ‘বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী’ সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যা মানব সমাজের সর্বোচ্চ রূপ। কার্ল মার্ক্স তাঁর এই চিন্তাধারাকে প্রয়োগ সম্পর্কিত দর্শন বা ‘ফিলোসফি অব প্র্যাক্টিস’ বলে চিহ্নিত করেছেন।

কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মার্ক্সের প্রতিটি কথাই কিন্তু অভ্রান্ত নয়। কারণ রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ এবং পরবর্তীতে সারা বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর তার অনেক বাণীর অভ্রান্ততা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়। পৃথিবী জুড়ে পুঁজিবাদ বা ধণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রের উত্তরণের যে ‘আমূল ভবিষ্যদ্বানী’ মার্ক্স করেছিলেন, আজকের বিশ্বের প্রেক্ষাপট বিশ্ল্বেষণে মনে হয় পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি সেভাবে যায়নি। মার্ক্স মনে করেছিলেন যে, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণি বুঝি কেবল শোষণ আর বঞ্চনার শিকার হবে এবং এর ফলে শ্রমিক শ্রেণির পিঠ ‘দেওয়ালে ঠেকে যাওয়ায়’ তারা ধণতান্ত্রিক সিস্টেমের পতন ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জায়গায় সফলতা এলেও ধনতন্ত্রের পতন হয়নি, বরং বলা যায় ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদি ব্যবস্থা নিজস্ব সিস্টেমের দুর্বলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে বিবর্তিত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের ‘ওয়েল ফেয়ার স্টেট’গুলো শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে আজ অনেক বেশী মনোযোগী। বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী বা শ্রমিকেরা আজ কোম্পানির স্টক কিনতে পারছে, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে শ্রমিকেরা নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারছে অনেক ভালভাবে – এই পুঁজিবাদী সমাজেই। তারা কিন্তু বিপ্লবের পথে যাচ্ছে না।

তাই মার্ক্সবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে লেলিন বা মাও সেতুং এর মত করে এর রূপান্তর করতে হবে। নিজ দেশের ভৌগোলিক ও সংখ্যাগরিষ্ঠের মন-মগজের আলোকে মার্ক্সবাদের রূপান্তর ঘটানো সম্ভব না হলে অনেক্ষ ক্ষেত্রেই মার্ক্সবাদ ব্যর্থ হবে এবং হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, মার্ক্স নিজে কিন্তু বিপ্লবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন তাত্ত্বিক। লেলিন ও মাও সেতুং ছিলেন বিল্পবী। যে কারণে পরের দু জন নিজ দেশের প্রেক্ষিতে মার্ক্সবাদের রূপান্তর ঘটিয়ে লেলিনীয় মার্ক্সবাদ এবং মাওবাদের উদ্ভব ঘটিয়েছেন এবং তারা সে সময় সফলও হয়েছেন। সুতরাং মার্ক্সকে পুরোপুরি না পড়ে এবং মার্ক্সকে নিজ দেশের আঙ্গিকে ব্যাখ্যা না করে জনগণের সামনে তুলে ধরা হলে মার্ক্সবাদ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন হতে পারে অলীক স্বপ্ন, যার প্রতিফলন বাংলাদেশ-সহ বিভিন্ন দেশে প্রতিফলিত হচ্ছে।

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

Leave a Reply

Your email address will not be published.