আপনাদের অনেকেই সম্ভবত জানেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে হিটলার প্রায় ৬০ লাখ ইহুদীকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু হিটলার কেন এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলেন–এ নিয়ে দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরেই গবেষণা করে চলেছেন ইতিহাসবিদরা। তাদের গবেষণা থেকে হিটলারের ইহুদী নিধন বা হলোকাস্টের বেশকিছু উঠে এসেছে, যেগুলো হলো:
প্রথমত. কিশোর বয়সে হিটলার অনেক ছবি আঁকতেন। তখন তার খুব ইচ্ছা ছিল আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়া। সে সময় হিটলার অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে থাকতেন। জানা যায়, তাকে আর্ট কলেজে থেকে বেশ কয়েকবার প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছিল। কারণ আর্ট স্কুলের রেকটর ছিলেন ইহুদি এবং ইহুদি ছাত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল পুরো কলেজে।
দ্বিতীয়ত. হিটলারের মনে ইহুদি বিদ্বেষের বীজ বপন হয়েছিল ১৯০৭ সালে, যখন তার মা ক্লারা মারা যান একজন ইহুদি ডাক্তার এডওয়ার্ড ব্লোচ-এর অধীনে চিকিৎসারত অবস্থায়, যদিও এ বিষয়ে সব ইতিহাসবিদ একমত হতে পারেননি।
তৃতীয়ত. হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পরাজিত হওয়ার কারণ হিসেবে একমাত্র ইহুদিদের দায়ী করতেন। তার আরও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ৯ নভেম্বর, ১৯১৮ সালে জামার্নির রাজতন্ত্রের বিলোপ ইহুদিদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল। তাছাড়া হিটলার লক্ষ করেন, জার্মান দেশে বসে ইহুদীরা জার্মানির ব্যবসা-বাণিজ্য-সহ অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে, যা তিনি মেনে নিতে পারেননি।
চতুর্থত. ইতিহাসবিদ ইয়াহুদ বাউয়ারের মতে, ইহুদী নিধন বা হলোকাস্টের মূল কারণ ছিল আদর্শগত, এর শেকড় হিটলারের কাল্পনিক অলীক জগৎ (ইলিউশনারি ওয়ার্ল্ড অব নাজি ইমাজিনেশন)। হিটলার মনে করতেন যে, একটি আন্তর্জাতিক ইহুদি চক্রান্ত চলছে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে। তাই ইহুদিদের নির্মূল করতে পারলেই তিনি বিশ্ব জয় করতে পারবেন এমন একটি ধারণা তার মধ্যে কাজ করছিল। তবে কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন, মধ্যযুগের পর থেকেই জার্মান সমাজে ও সংস্কৃতিতে এন্টি সেমিটিজম অর্থাৎ হিব্র“, আরব, আসিরীয় ও ফিনিসীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি বিরোধিতা ছড়িয়ে পড়ে।
পঞ্চমত, হিটলারের নাৎসীবাদের মূলনীতি ছিল– জার্মানদের ভাষা হবে জার্মান, তারা হবে আর্য রক্তের এবং তারা থাকবে সকল ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত। তাছাড়া হিটলারের মতে, জার্মানরা সুপিরিয়র জাতি, তাই তাদের অধিকার রয়েছে বিশ্বকে শাসন করার, যে বিশ্ব হবে ইহুদীমুক্ত।
তবে, ইহুদীদের প্রতি হিটলারের মনে যে প্রচন্ড ঘৃণা ও বিদ্বেষের জন্ম হয়েছিল তা কোনো ধরনের উগ্র চিন্তা বা অন্যায়বোধ থেকে জন্মলাভ করেনি বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। কারণ হিটলার ইতিহাস সম্পর্কে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন।
হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় আসীন হন ১৯৩৩ সালে। এর আগেই তিনি তার লেখা বই ‘মেইন কেম্প’-এ ইহুদিদের জার্মান রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক জীবন থেকে তাড়ানোর আভাস দিয়েছিলেন, তবে তিনি তাদের নিঃশেষ করে দেবেন তা অবশ্য লিখেননি। ১৯২২ সালের দিকে সাংবাদিক মেজর জুসেফ হেলকে নাকি হিটলার বলেছিলেন, ‘আমি যদি কোনো দিন সত্যি সত্যিই ক্ষমতায় যাই, তবে আমার প্রথম ও সব কিছুর আগের কাজ হবে ইহুদিদের শেষ করে দেয়া। হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর ও ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তার এন্টি সেমিটিজম বা ইহুদি বিরোধী প্রচারণা।
হিটলার ক্ষমতায় আসার পরই জার্মানির সব প্রান্তে ইহুদি বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, শুরু হয় তাদের ওপর লুটতরাজ ও হত্যা। হিটলার চেয়েছিলেন এভাবে ইহুদিদের দেশ থেকে বিতাড়ন করবেন। কিন্তু কোনো মানুষই সহজে নিজের আশ্রয়স্থল ত্যাগ করতে চায় না। তাই ১৯৩৫ সালে নতুন আইন চালু করলেন হিটলার। তাতে দেশের নাগরিকদের দুটি ভাগে ভাগ করা হলো, জেন্টিল আর জু। জেন্টিল অর্থাৎ জার্মান, তারাই খাঁটি আর্য, জু হলো ইহুদিরা। তারা শুধুমাত্র জার্মান দেশের বসবাসকারী, এদেশের নাগরিক নয়। প্রয়োজনে তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। এরপর চার্চ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইহুদীদের চিহ্নিত করার জন্য জন্ম রেকর্ড সরবরাহ করে, যা থেকে জানা যেত কে ইহুদি আর কে ইহুদি নয়। অর্থ মন্ত্রণালয় ইহুদীদের সমস্ত সম্পতি বাজেয়াপ্ত করে, জার্মান প্রতিষ্ঠানগুলো ইহুদিদের চাকরিচ্যুত করে এবং জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইহুদিদের ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ রকম আরও বহু হিংসাত্মক ও নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে হিটলারের সরকার।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার হিটলার চূড়ান্তভাবে ইহুদীদের নিধন ও হত্যা করা শুরু করেন। জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ইহুদিপাড়া তথা ঘেটো গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। এছাড়া কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ও গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে ইহুদীদের হত্যা করা হয়। জার্মানি ও জার্মানির দখলিকৃত রাষ্ট্রগুলোতে এই হত্যাযজ্ঞ চলে হিটলারের পরাজয়ের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত।
—————————–
তাং: ২০ এপ্রিল ২০১৭