জীবনের স্বার্থকতা কোথায়?

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুন্ডলা’ উপন্যাস পড়েছেন নিশ্চয়ই। এ উপন্যাসের এক জায়গায় বঙ্কিম লিখেছেন, ‘পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না। পরের জন্য তোমার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও’। আবার এ উক্তিটিও জানি যে, ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’। কথা হচ্ছে আমরা কোনটায় বিশ্বাসী হবো? ফুল হয়ে সুগন্ধ ছড়াবো, নাকি শুধু আপন প্রাণই বাঁচাবো?

একটু কঠিন করে যদি বলি– আমরা কি মত শুধুই খাবো-দাবো, সন্তান জন্ম দিবো, তারপর একদিন মরে যাবো–এইরকম জীবন গড়ে তুলবো, নাকি পৃথিবীতে যখন চলেই এসেছি তখন নিজেকে যেমন মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবো, তেমনি আমাদের সৃষ্টিশীল কাজ দ্বারা মানবকল্যাণে অবদান রেখে যাবো?

অনেকে যুক্তি দেন, জীবনে সফল হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাঁ এটা সত্য, তবে আংশিক। কারণ সফল হওয়াটা যতটানা গুরুত্বপূর্ণ, তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জীবনটাকে স্বার্থক করে তোলা। কারণ সাফল্য অনেকটাই বৈষয়িক বা বস্তুগত অর্জন, আর সার্থকতা আত্মিক বিষয়। যেমন, একজন বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হওয়াটা সফলতা, কিন্তু মানবসেবা নয়, শুধু অর্থ উপার্জন করাটাই যদি তার ডাক্তার হয়ে উঠার উদ্দেশ্য হয় তাহলে বুঝতে হবে তিনি হয়তো ব্যক্তিজীবনে সফল, কিন্তু সার্থক নন। অন্যদিকে আমরা একজন সার্থক মানুষ হিসেবে ডাঃ মোহাম্মদ ইব্রাহিমের কথা বলতে পারি। যিনি ডায়াবেটিকস রোগীদের নিদারুন দুঃখ দেখে রাজধানীর শাহবাগে ডায়াবেটিকস হাসপাতাল বারডেম প্রতিষ্ঠা করেছেন, যে হাসপাতাল থেকে অসংখ্য মানুষ আজ উপকৃত হচ্ছেন। তাই জীবনকে সার্থক করে তুলতে চাইলে মানুষের দুঃখবোধ দেখে কেঁদে ওঠার অনুভূতি থাকতে হবে।আমরা আরেকজন সার্থক মানুষের উদাহরণ দেই। তার নাম জেমস হ্যারিসন। অস্ট্রেলিয়ান এই নাগরিকের রক্তে ছিল এমন একটি অ্যান্টিবডি, যা অ্যানিমিয়া নামক রোগ থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারতো। হ্যারিসন প্রায় ৫৬ বছর যাবত রক্ত দিয়ে গেছেন, এমনকি তার ৭৪ বছর বছর বয়সেও। তিনি সর্বমোট ৯৮৪ বার রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছেন প্রায় ২০ লাখ শিশুর জীবন।

আমি ২০১১-১২ সালের দিকে চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের নিউজ রুম এডিটর ছিলাম, তখন আমাদের কুষ্টিয়ার জেলা প্রতিনিধি একটি প্যাকেজ/গল্প পাঠিয়েছেন একরকম যে, কুষ্টিয়ার কুমারখালীর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নাসির উদ্দীন। তিনি খেয়াল করেন উপযুক্ত স্থানের অভাবে তার গ্রামের শিশু-কিশোরেরা খেলাধুলার সুযোগ পায় না। তখন তিনি তার নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় একটি মিনি শিশু পার্ক স্থাপন করেন। তিনি গ্রামের শিশুদের পার্কে খেলতে দেন, পার্কের ফলমূল খেতে দেন, তার নিজের পাঠাগার থেকে বই পড়তে দেন। এছাড়া যেসব শিশুরা স্কুলে যায় না তাদের অভিভাবকদের বুঝিয়ে স্কুলে পাঠান এবং এলাকায় বৃক্ষরোপণ আন্দোলন পরিচালনা করেন। এই নাসির উদ্দীনের আর্থিক সামর্থ্য কিন্তু বেশি নয়, কিন্তু রয়েছে সমাজ পরিবর্তের বিপুল ইচ্ছা।একইভাবে বইপ্রেমিক পলান সরকার কিংবা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কথা আমরা সবাই জানি।

এই কিছুদিন আগে আমি বেশতো ডটকম নামের একটা ওয়েবসাইটে একটি প্রশ্ন দেখলাম এইরকম– ‘জীবনের সার্থকতা কোথায়? সেখানে চারজন উত্তর দিয়েছেন। একজন লিখেছেন, জীবনের সার্থকতা তখন-ই, যখন নিজেকে বিলীন করা হয় কারো মঙ্গল কামনায়। এ উত্তরের সাথে একমত পোষণ করে আমি বলবো– সমাজ ও রাষ্ট্রের ভালোর জন্য, মঙ্গলের জন্য কিছু করার মধ্যেই রয়েছে ব্যক্তির ও ব্যক্তি সমষ্টির সার্থকতা।

আসুন আমরা জীবনকে সফল করে তোলার পাশাপাশি জীবনটাকে স্বার্থক করে তুলি। সৃষ্টিশীল ও মানবতাবাদী উদ্যোগ ও কাজ দিয়ে আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেই।

 ২৫ এপ্রিল ২০১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *