ভূমিকা: বিগত চার দশক ধরে বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে তিনটি প্রধান দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জাতীয় পার্টি এবং এ দলগুলোর প্রধান শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে ঘিরে। স্বভাবতই সচেতন নাগরিক হিসেবে সবারই এই তিন শক্তিমান রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে জানার আগ্রহ রয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কিত একটি বিবরণ তুলে ধরা হলো।
শেখ হাসিনা
১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হন শেখ হাসিনা। সে হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বয়স ৩৬ বছর। এই সময়ে আটটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে দু বার তাঁর দল আওয়ামী লীগ নির্বাচন বয়কট করে। একটি ছিল চতুর্থ সংসদ নির্বাচন (৩ মার্চ ১৯৮৮ সাল), আরেকটি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬)।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে:
শেখ হাসিনা দলের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ তিনবার ক্ষমতাসীন হয়। তিনবারই প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। বর্তমানে টানা দুইবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতাসীন রয়েছেন তিনি।
১২ জুন ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে (সপ্তম) ১৪৬ আসনে জয়ী হয়ে তিনি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য নির্বাচিত হন ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে (নবম)। তখন ২৩০টি আসনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট। এরপর ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের (দশম) সংসদ নির্বাচনে (নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি-সহ ৭০ শতাংশ দল এ নির্বাচন বর্জন করে) বিজয়ী হয়ে তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। গত নির্বাচনে তাঁর দল ২৩৮টি আসন পায়।
বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে:
আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত তিনবার সংসদে বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করে। তিনবারই বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ হাসিনা। ৭ মে ১৯৮৬ সালের (তৃতীয়) নির্বাচনে ৭৬টি আসন পেয়ে তিনি প্রথমবার বিরোধী দলের নেতা হন হাসিনা। দ্বিতীয়বার ৮৮টি আসন পেয়ে তিনি বিরোধী দলের নেতা হন ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, (পঞ্চম) নির্বাচনের মাধ্যমে। তৃতীয়বার ৬২টি আসন পেয়ে বিরোধী দলের নেতা হন ১০ অক্টোবর ২০০১ সালের (অষ্টম) নির্বাচনের মাধ্যমে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জয়-পরাজয়ের হিসাব:
হাসিনা হাসিনা এ পর্যন্ত ছয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের ১৮টি আসন থেকে নির্বাচন করে ১৬টিতে বিজয়ী হন।
১৯৮৬ (তৃতীয়), ১৯৯৬ (সপ্তম) ও ২০০৮ (নবম) সালে অনুষ্ঠিত প্রত্যেকটি নির্বাচনে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটিতেই নির্বাচিত হন তিনি।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে (পঞ্চম) দুটি আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে একটি আসন থেকে তিনি নির্বাচিত হন। ঢাকা-৭ আসনে বিএনপি প্রার্থী সাদেক হোসেন খোকা-এর নিকট পরাজিত হন।
২০০১ সালের নির্বাচনে (অষ্টম) পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচন করে চারটিতে জয়ী হন। রংপুর-৬ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নুর মোহাম্মদ মণ্ডলের কাছে পরাজিত হন তিনি।
২০১৪ সালের নির্বাচনে (দশম) দুটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দুটি আসনেই জয়লাভ করেন শেখ হাসিনা।
বেগম খালেদা জিয়া
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৮৪ সালে বিএনপি’র চেয়ারপার্সন হিসেবে রাজনীতিতে আসার পর থেকে এ পর্যন্ত আটটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর দল বিএনপি তিনবার নির্বাচন বয়কট করে। প্রথমবার ১৯৮৬ সালে (তৃতীয়), দ্বিতীয়বার ৩ মার্চ ১৯৮৮ সালে (চতুর্থ) এবং সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে (দশম)। এই তিনটি নির্বাচন ছাড়া বিএনপি ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। এরমধ্যে তিনবার বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়। আর দুইবার বিরোধী দলে বসার সুযোগ পায়।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে:
বেগম খালেদা জিয়া প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালের (পঞ্চম) নির্বাচনে জয়ী হয়ে। ওই সময়ে তার দল ১৪০টি আসন পায়। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের (ষষ্ঠ) নির্বাচনে জয়ী হয়ে। ঐ নির্বাচনে বিএনপি ২৭৮টি আসনে জয় পায়। ১০ অক্টোবর ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩টি আসন পেয়ে খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।
বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে:
বেগম খালেদা জিয়া দুইবার বিরোধী দলের নেতা হন। প্রথমবার ১২ জুন ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। তখন বিএনপি ১১৬টি আসন পায়। দ্বিতীয়বার ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৩০টি আসন পায় এবং সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খালেদা জিয়া।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জয়-পরাজয়ের হিসাব:
বেগম খালেদা জিয়া চারটি নির্বাচনে (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের ছাড়া) দেশের ১৮টি আসন থেকে প্রার্থী হন এবং সবগুলোতেই বিজয়ী হন।
১৯৯১ (পঞ্চম), ১৯৯৬ (সপ্তম) ও ২০০১ (অষ্টম) সালে অনুষ্ঠিত প্রত্যেকটি নির্বাচনে পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটি আসনেই জয়লাভ করেন তিনি।
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটিতেই নির্বাচিত হন তিনি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরোক্ত ১৮টি আসন ছাড়াও বেগম খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে (ষষ্ঠ) অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাঁচটি আসনে (ফেনী-১, ফেনী-২, বগুড়া-৭, রাজশাহী-২ ও সিরাজগঞ্জ-২) প্রার্থী হন। কিন্তু ঐ নির্বাচনে সকল দল অংশ না নেয়ায় এবং নির্বাচন কমিশন ঐ নির্বাচনের তথ্য সংরক্ষণ না করায় ৯৬’র নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা জানা যায়নি।
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৩ সালে নির্বাচিত সরকারের অধীনে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালনকালে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে দেশ শাসন করেন। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেন। ঐ নির্বাচনে তার দল জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসনে পায় এবং তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে (বিএনপি ও আওয়ামী লীগ-সহ অধিকাংশ দল এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি) জাতীয় ১৫১টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। ১৯৯০ সালে গণবিক্ষোভের মুখে এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনের অভাবে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ক্ষমতা হারানোর পর এরশাদ গ্রেফতার হন এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না-আসা পর্যন্ত কারারূদ্ধ থাকেন। ১৯৯১ সালের (পঞ্চম) জাতীয় নির্বাচনে তিনি কারাগার থেকেই নির্বাচন করে রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের (সপ্তম) সাধারণ নির্বাচনে রংপুরের চারটি এবং কুড়িগ্রামের একটি-সহ তিনি মোট পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। ছয় বছর কারারুদ্ধ থাকার পর ১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। ২০০১ সালের নির্বাচনে (অষ্টম) অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ২০০৮ সালের (নবম) নির্বাচনে মহাজোটে যোগ দিয়ে রংপুর, কুড়িগ্রাম ও ঢাকার তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটিতেই জয়ী হন। ২০১৪ সালের (দশম) নির্বাচনে (নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি-সহ ৭০ শতাংশ দল এ নির্বাচন বর্জন করে) তার দল সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং তার স্ত্রী রওশন এরশাদ প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এরশাদ দুটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটিতে জয়ী হন। বর্তমানে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জয়-পরাজয়ের হিসাব:
১৯৯১ সালের (পঞ্চম) জাতীয় নির্বাচনে তিনি কারাগার থেকেই নির্বাচন করে রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ সালের (সপ্তম) সাধারণ নির্বাচনে রংপুরের চারটি এবং কুড়িগ্রামের একটি-সহ তিনি মোট পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন।
২০০১ সালের নির্বাচনে (অষ্টম) অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
২০০৮ সালের (নবম) নির্বাচনে মহাজোট থেকে রংপুর, কুড়িগ্রাম ও ঢাকার তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটিতেই জয়ী হন।
২০১৪ সালের (দশম) নির্বাচনে এরশাদ দুটি আসনে (রংপুর-৩ ও লালমনিরহাট-১) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটিতে (রংপুর-৩) জয়ী হন।
তথ্যসূত্র:
- http://www.amadershomoy.biz/unicode/2015/09/09/14839.htm#.WP8RQ9R97Dc
- http://www.risingbd.com/risingbd-special-news/32808
- নেসার আমিন, বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ফলাফল (১৯২০-২০১৬), প্রকাশকাল: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
- নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট
- http://www.banglanews24.com/politics/news/bd/97684.details
- http://www.dw.com/bn/%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%A6%E0%A6%BE-%E0%A6%93-%E0%A6%8F%E0%A6%B0%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%88%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8/a-3904071