‘সুজন’-এর দৃষ্টিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন

‘সুজন’-এর দৃষ্টিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন

কিছুটা দেরিতে হলেও নাগরিক সংগঠন ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’ কর্তৃক গত মে মাসে প্রকাশিত হলো ‘বাংলাদেশ: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০১৪’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন। ১৫০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনটি সম্ভবত বাংলাদেশে প্রথমবারের মত কোনো নির্বাচনকে নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন।

প্রতিবেদনে নির্বাচন-পূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থা এই তিন পর্বে ভাগ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত প্রায় সকল প্রাসঙ্গিক তথ্য তুলে ধরা হয়। এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা বিশ্লেষণ এবং উপরোক্ত নির্বাচন সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করা, যাতে ভবিষ্যতে পাঠক, লেখক ও গবেষকরা তাঁদের প্রয়োজনে বর্তমান প্রতিবেদনের তথ্য ব্যবহার করে উপকৃত হতে পারেন।

প্রতিবেদনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী জনাব দিলীপ কুমার সরকারের সাথে ছিলাম আমি নেসার আমিন। প্রতিবেদনটি সম্পাদনা করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ও সুজন নির্বাহী সদস্য ড. তোফায়েল আহমেদ। আমরা প্রতিবেদনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নৈর্ব্যক্তিক থাকার চেষ্টা করেছি।

প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয় যে, নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম করা আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। তবে সে নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য। বস্তুত গণতান্ত্রিক শাসনের প্রথম ও অতি আবশ্যকীয় শর্ত হলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তথা ‘জেনুইন ইলেকশান’ বা সঠিক নির্বাচন করতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র আন্তর্জাতিকভাবেও অঙ্গীকারবদ্ধ। তা সত্ত্বেও, বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল একতরফা ও বিতর্কিত। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি-সহ দেশের ৭০ শতাংশ (৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, যা ব্যাপক বিতর্ক তৈরি করে। নির্বাচন ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিরোধী জোটের নেতা-কর্মীরা। এরফলে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ভোটারদের মধ্যে তৈরি হয় ভয়-ভীতি, যে কারণে এই নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার ছিল খুবই কম। মোটকথা, একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয় নির্বাচন কমিশন। অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে যাত্রা করে বাংলাদেশের নির্বাচনী ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।’

প্রারম্ভিক কথার পর প্রতিবেদনে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হয়, যাতে অন্যান্য নির্বাচনগুলোর সাথে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে তুলনা করা যায়।

প্রতিবেদনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে একটি সাধারণ বিবরণ তুলে ধরা হয়। বলা হয়: ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নবম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি-সহ ৪০টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি রাজনৈতিক দলই (৭০ শতাংশ) এ নির্বাচনটি বর্জন করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-ইনু) এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি-সহ মাত্র ১২টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

এছাড়া নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় নির্বাচনটি নিয়ে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। নির্বাচনের পূর্বেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের সরকার গঠনের মত সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত হয়। উল্লেখ্য, ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার ফলে নির্বাচনে সারাদেশের মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭৭ ভোটারের মধ্যে ১৪৭টি আসনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান অবশিষ্ট ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন ভোটার, যদিও ভোট প্রদানের হার ছিল নগণ্য।

নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২৩৪টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। বর্তমান সংসদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনে ৩৪টি আসন পেয়ে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। সংসদে প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বেগম রওশন এরশাদ। জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করলেও, দলটি সরকারের অংশ। দলের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য পূর্ণ মন্ত্রী, দুইজন প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রতিমন্ত্রী এবং দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশেষ দূত’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।’

উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পেছনে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার যুক্তি তুলে ধরেছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ১৯ শে ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, ‘উনি [খালেদা জিয়া] যদি হরতাল বন্ধ করেন, অবরোধ বন্ধ করেন, মানুষের ওপর জুলুম অত্যাচার বন্ধ করেন, তাহলে ওই নির্বাচনের পর আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা যদি একটি সমঝোতায় আসতে পারি। প্রয়োজনে আমরা আবার পুনরায় নির্বাচন দেব। পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দেব (বিবিসি বাংলা, ০৫ জানুয়ারি ২০১৮)।’ কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সরকারের দিক থেকে আলোচনার আর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।’

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচিত বিষয়। এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘অত্যন্ত অস্থিতিশীল ও সহিংস এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সংকটের কারণে এই অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে সে সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অধীনে ১৪ দলীয় জোট, জাতীয় পার্টি (এরশাদ) এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যুগপৎ আন্দোলন পরিচালনা করে। তাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা’ যুক্ত করা হয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) ও নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত সর্বোচ্চ আদালতের একটি সংক্ষিপ্ত আদেশকে ভিত্তি করে — পূর্ণ রায় বের হওয়ার আগেই — আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ৩০ জুন ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করে। উল্লেখ্য, সে সময় সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির প্রস্তাবের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রস্তাব আনা হলেও কমিটির সর্বসম্মত প্রাথমিক সুপারিশ ছিল একটি মীমাংসিত বিষয় হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে বহাল রাখা (প্রথম আলো, ২৮ অক্টোবর ২০১৩)।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার জোটভুক্ত দলগুলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তখন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় সরকারের অধীনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন এবং সেই সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ঘোষণা দেন। তিনি সংবিধান থেকে একচুলও না সরারও ঘোষণা দেন। তিনি সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বিএনপিকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে অনঢ় থাকেন। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জন করে। বিএনপি জোট শুধুমাত্র নির্বাচন বর্জনই করেনি, তারা নির্বাচন প্রতিহত করারও ঘোষণা দেয়। এরফলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিএনপি জোটের নেতা-কর্মীরা, ঘটে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানি।

সে সময় দেশের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে ঘোষণা দেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টা পদ থেকে জাতীয় পার্টির সব সদস্যকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন। ০৪ ডিসেম্বর ২০১৩ এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকায় সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। ‘জাপা নির্বাচনে না গেলে যদি অন্য কোনো দল জয়ী হয়, তাহলে জামায়াতে ইসলামীর উত্থান হবে’ এমন কথা বলে সুজাতা সিং এরশাদকে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য চাপ দেন (প্রথম আলো, ০৫ ডিসেম্বর ২০১৩)। কিন্তু এরশাদ নির্বাচনের ব্যাপারে অনঢ় থাকেন। কিন্তু রওশন এরশাদ-এর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি গ্রুপ নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এমনকি চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের অনুপস্থিতিতে তারা দলের নির্বাচন ইশতেহার ঘোষণা করেন। অসুস্থতার অজুহাতে র‌্যাব এরশাদকে হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে ভর্তি করে। এরশাদের সমর্থক জাতীয় পার্টির একটি অংশ তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে। হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় জেনারেল এরশাদ তার মনোনয়নপত্র লিখিতভাবে প্রত্যাহার করেন, যদিও নির্বাচন কমিশন তা অগ্রাহ্য করে। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি সীমিত সংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে সে সময় দেশ-বিদেশের নানা চেষ্টা চলছিল। নির্বাচনের পূর্বে দুই দলের মধ্যে সমঝোতা তৈরির লক্ষ্যে তিন দফায় ঢাকায় আসেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। প্রথমবার ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এবং সর্বশেষ ৬ ডিসেম্বর ২০১৩ পাঁচ দিনের সফরে ঢাকা আসেন তিনি। তাঁর এই সফরের আগে ২৩ আগস্ট ২০১৩ বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করে সংঘাতের পথ ছেড়ে শান্তিপূর্ণভাবে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানান। তারানকো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বেশ কয়েকবার বৈঠকে বসেন। একটি মতানৈক্যে পৌঁছার জন্য তারানকোর মধ্যস্থতায় মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু উপরোক্ত সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায়, তথা নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে কোনো সমঝোতা না হওয়ায়, উত্তপ্ত ও সহিংস পরিস্থিতিতেই অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।’

প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সর্বমোট ১ হাজার ১০৭ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। মনোনয়নপত্র বাতিল (২৩০ জন) ও প্রত্যাহারের (৩৩৪ জন) পর ১৫৩টি আসনে একজন করে প্রার্থী থাকায় তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বাকি ১৪৭টি আসনে সর্বমোট ৩৯০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ফলে, ৩০০ নির্বাচনী এলাকার সর্বমোট প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৪৩ জন।

নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, প্রার্থীগণ মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা আকারে আট ধরনের তথ্য স্ব-স্ব নির্বাচনী এলাকার রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে দাখিল করেন। একইসঙ্গে তারা দাখিল করেন আয়কর প্রত্যয়নপত্র ও আয়করণ বিবরণী। নির্বাচনের পূর্বে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘সুজন’-এর পক্ষ থেকে সকল প্রার্থীর (হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে) তথ্যের বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়।

বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীগণের বেশিরভাগই (৭১.১%) স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিসম্পন্ন ছিলেন। পেশার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ৫৪৩ জন প্রার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বেশির পেশা (৫২.৩% বা ২৮৪ জন) ব্যবসা। অর্থাৎ অন্যান্য নির্বাচনের মত এ নির্বাচনেও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টি তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণ — ৮৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ৫১ জন ব্যবসায়ী (৫৯.৩০%) — ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন দেয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২৫০ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৩৬ জন (৫৪.৫%) ব্যবসায়ীকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়।

৫৪৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ৫২ জনের (৯.৫৭%) বিরুদ্ধে বর্তমানে ১৪১টি মামলা আছে, অতীতে ২০৩ জনের (৩৭.৩৮%) বিরুদ্ধে ৯৩৩টি মামলা ছিল এবং অতীত ও বর্তমানে (নির্বাচনকালীন) উভয় সময়ে মামলা ছিল বা রয়েছে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ৩৪ জন (৬.২৬%)। সম্পদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ৫৪৩ জন প্রার্থীর মধ্যে কোটি টাকার বেশি সম্পদের অধিকারী ২০৩ জন (৩৭.৩৮%)। তবে হলফনামায় অনেক প্রার্থীই সম্পদের মূল্য উল্লেখ না করেননি, যে কারণে আর্থিক মূল্যে সম্পদের প্রকৃত পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে প্রার্থীরা সম্পদের অর্জনকালীন মূল্য উল্লেখ করেন, যে কারণে সম্পদের বর্তমান বা প্রকৃত পরিমাণ নিরূপণ করা যায় না। ৫৪৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ৭২ জন (১৩.২৫৯%) ঋণগ্রহীতা। ৫৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে (তিনজনের তথ্য পাওয়া যায়নি) ১৫৯ জনের আয়কর প্রদান সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া গেছে। ১ লাখ ১ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা আয়কর দেয়ার সংখ্যাই বেশি (৫৯ জন)।

‘সুজন’-এর প্রতিবেদনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী-সহ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার, সংসদের উপনেতা, চিফ হুইফ ও হুইফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ৪৮ জনের — যাঁরা নবম (২০০৮) ও দশম (২০১৪) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন — হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যের বিশ্লেষণও তুলে ধরা হয়।

১৯৯০ সালের পর প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি দলের কাছেই ইশতেহার ঘোষণা নির্বাচনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্ব হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের ১৭ দিন আগে ইশতেহার ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আর দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ এবং দলের সিনিয়র নেতাদের অনুপস্থিতিতেই ইশতেহার ঘোষণা করে জাতীয় পার্টি। এছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি (জেপি) ও তরিকত ফেডারেশন দায়সারাভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করে— এমন পর্যবেক্ষণই উঠে আসে ‘সুজন’-এর প্রতিবেদনে।

সুজন-এর প্রতিবেদনে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে নির্বাচনের দিনের একটি সাধারণ চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘বিএনপি-সহ বিরোধী জোটের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরফলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ভোটারদের মধ্যে তৈরি হয় ভয়-ভীতি। যে কারণে ভোট প্রদানের হারও ছিল কম। জাল ভোট দেওয়া ছিল এই নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। নির্বাচনী সহিংসতায় নির্বাচনের দিন সারাদেশে নিহত হন ১৯ জন। ভোটের দিন এতসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি এর আগে কোনো জাতীয় নির্বাচনে দেখা যায়নি। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর ঘোষিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল। এরপর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ৪১ দিনে নিহত হন ১২৩ জন। নির্বাচনপূর্ব সহিংসতার দিক থেকেও এই নির্বাচন অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।’

সাম্প্রতিককালে ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণ’ ব্যাপারটা একটা আন্তর্জাতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত, পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি নির্বাচনে কারচুপি ও জবরদস্তির প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করে বলেই মনে করা হয়। কিন্তু দেখা যায়, একতরফা নির্বাচন হওয়ায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক ও পর্যবেক্ষক সংস্থার অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়ান ফেডারেশন, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া তাদের দেশ থেকে পর্যবেক্ষক পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায়। একইভাবে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ যেমন, জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের পর্যবেক্ষক পাঠানো থেকে বিরত থাকে। এমনকি এসব সংস্থা তাদের স্থানীয় প্রতিনিধিকেও নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো নির্দেশনা প্রেরণ করেনি। প্রথম আলো (০৬ জানুয়ারি ২০১৪) জানায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার জন্য ভারত ও ভুটান থেকে দু’জন করে চারজন পর্যবেক্ষক এসেছিলেন। তাঁরা ঢাকায় পাঁচটি কেন্দ্রের ২৫টি পোলিং বুথ পর্যবেক্ষণ করেন। বাংলাদেশের প্রধান পর্যবেক্ষক মোর্চা ‘ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (ইডব্লিউজি) শুরুতে ১৪৬ আসনে ১৫ হাজার পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেও সংগঠনটি মাত্র ৮০ আসনে ১০ হাজার পর্যবেক্ষক প্রেরণ করে। ‘জানিপপ’ও সীমিত পরিসরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে। আরেক নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘ফেমা’ বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়নি।

আমরা জানি, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে কমিশনের অগাধ ক্ষমতা রয়েছে। নির্বাচনী আইনানুযায়ী ও আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, নির্বাচনের সময় সরকার-সহ নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত সকলেই কমিশনের আদেশ ও নির্দেশনা মানা-সহ অন্যান্য সহযোগিতা করতে বাধ্য। আমরা এও জানি যে, আইনি বিধি-বিধান প্রণয়ন করার ক্ষমতা একমাত্র আইনসভার। কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের খাতিরে আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে সেই ক্ষমতাও দিয়েছে। তা সত্ত্বেও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে ব্যর্থ হয় নির্বাচন কমিশন। ভোটকেন্দ্রে বিরোধী জোটের হামলা ও প্রাণহানি ঠেকাতে যেমন ব্যর্থ হয়, তেমনি কেন্দ্র দখল করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে সরকারি দলের কর্মীদের ব্যালট পেপারে সিল মারার মতো ঘটনাও বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি। উপরন্তু ভোটার উপস্থিতি স্মরণাতীত কালের সর্বনিম্ন হওয়ার বিষয়টি কমিশনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।

অতীতের নির্বাচনগুলোতে ভোটের দিন কমিশন সচিবালয় থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করা হলেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এমনকি একতরফা এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আগ্রহ ছিল না নির্বাচন কমিশনেরও। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ এবং নির্বাচন কমিশনার মো. জাবেদ আলী শুধুমাত্র একটি করে নির্বাচন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। নির্বাচনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ জানান, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে কমিশনকে নির্বাচন করতে হয়েছে।

প্রতিবেদনের তৃতীয় অধ্যায়ে নির্বাচন পরবর্তী চিত্র বিশেষ নির্বাচনী ফলাফল তুলে ধরা হয় এবং নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয়। এই ভাগে বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষ এই নির্বাচনকে কীভাবে মূল্যায়ন করেছে তা তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদন থেকে আমরা দেখতে পাই যে, নিকট অতীতের যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী নারী প্রার্থীর সংখ্যা কম। নির্বাচনে ২৭টি আসনে নারী প্রার্থী ছিলেন ২৮ জন। ১৯টি আসনে জয়লাভ করেন ১৮ জন নারী। নির্বাচনে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে ৩০০ আসনে ৩৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে বিজয়ী হন ১৭ জন প্রার্থী।

‘সুজন’-এর প্রতিবেদনে নির্বাচিত ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের (সংরক্ষিত ৫০ জন-সহ) তথ্যের বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে অধিকাংশই (২৭৫ জন বা ৭৮.৫৭%) স্নাতক বা স্নাতকোত্তর। পেশার ক্ষেত্রে ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে অধিকাংশই (১৭৫ জন বা ৫০%) ব্যবসায়ী। ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ৩১ জনের (৮.৮৫%) বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা রয়েছে, অতীতে মামলা ছিল ১৪৩ জনের (৪০.৮৫%) বিরুদ্ধে, অতীত ও বর্তমান উভয় সময়ে মামলা ছিল বা রয়েছে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ২৩ জন (৬.৫৭%)। ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে বাৎসরিক ৫ লক্ষ টাকার কম আয় করেন ৮০ জন (২২.৮৫%) প্রার্থী, বছরে কোটি টাকার উপরে আয় করেন ৫৫ জন (১৫.৭১%) এবং সর্বোচ্চ ৩৫.৪২% (১২৪ জন) প্রার্থীর বাৎসরিক আয়সীমা ৫ লক্ষ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা।

বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে অধিকাংশ (২২৬ জন বা ৬৪.৫৭%) সংসদ সদস্যের সম্পদ কোটি টাকার উপরে (বাৎসরিক ৫ লক্ষ টাকার কম স¤পদের মালিক মাত্র ১২ জন (৩.৪২%)। ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে মাত্র ৪৯ জন (১৪%) ঋণগ্রহীতা। আর ৩০০ জন সংসদ সদস্যের (সংরক্ষিত ছাড়া) মধ্যে ২৫৮ জন (৮৬%) করদাতা। মোট ৩০০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ১৫ জনের (৫.০৩%) বয়স ৩১-৪০ বছর, ৬৫ জনের (২১.৬৬%) বয়স ৪১-৫০ বছর, ৯৭ জনের (৩২.৩৩%) বয়স ৫১-৬০ বছর, ৯৭ জনের (৩২.৫৫%) বয়স ৬১-৭০ বছর, ২৫ জনের (৮.৩৯%) বয়স ৭১-৮০ বছর এবং ০১ জনের (০.৩৩%) বয়স ৮১-৯০ বছর। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলো ৫০-৭০ বছর বয়সীদের তাদের দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিল।

নির্বাচনী ব্যয় বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ব্যয় হয় ৩৩৩ কোটি ৭৭ লাখ ৬ হাজার ৯৬ টাকা। এর মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা ব্যয় ছিল ১১৩ কোটি ৭৩ লাখ ৩৭ হাজার ৩২৯ টাকা। উল্লেখ্য, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যথাক্রমে ৯১ কোটি এবং ৬৫ কোটি ৫০ হাজার ৬৮৭ টাকা ব্যয় হয়।’

নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে ভয়-ভীতি থাকায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু ভোটারদের উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য— নির্বাচনের পর এধরনেরই মন্তব্যই করে দেশীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো। তাদের মতে, বাংলাদেশে উৎসাহ-উদ্দীপনামূলক নির্বাচনের যে সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, উপরোক্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা ম্লান হয়েছে।

ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি) জানায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের পর্যবেক্ষণকৃত এলাকায় ভোট প্রদানের হার ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। ভোটকেন্দ্রের বাইরে মোট ৭২টি সহিংসতার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছে তারা। ‘ব্রতী’-এর পক্ষ থেকে বলা হয়, বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন, অবরোধ, হরতাল, নির্বাচনবিরোধী প্রচারণা আর প্রতিরোধের কারণে কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে। নিরাপত্তা প্রশ্নে নারী ও সংখ্যালঘু ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল সর্বনিম্ন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১০ শতাংশেরও কম ভোট পড়েছে বলে দাবি করে ‘ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স (ফেমা)’।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, কানাডা ও কমনওয়েলথ নির্বাচনে সহিংসতা ও ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং ভবিষ্যতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সমঝোতার তাগিদ দেয়।

নির্বাচনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। নির্বাচনের পর গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আবার আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে বিএনপিকে সন্ত্রাস ও সহিংসতা পথ পরিহার এবং জামায়াতের ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ করার শর্ত দেন তিনি।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের প্রতি সমঝোতায় পৌঁছানোর আহ্বান জানান। তবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সেই নির্বাচন হতে হবে বলে শর্ত দেন তিনি। একইসঙ্গে খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারের পদত্যাগও দাবি করেন।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এক বিবৃতিতে জানায়, দেশের জনগণ সরকারের একদলীয় প্রহসনের নির্বাচন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশে এমন দূরাবস্থার নির্বাচন অতীতে কখনো হয়নি। এ নির্বাচনের সাথে জনগণের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) জানায়, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার যুক্তি দেখিয়ে ‘একতরফা’, ‘পোকা খাওয়া’ ও ‘তামাশার’ নির্বাচনের ফলে দেশের রাজনৈতিক সংকট দূর হওয়ার বদলে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার বিপদ সৃষ্টি হয়েছে। দলটি অবিলম্বে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করার দাবি জানায়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের প্রেক্ষাপটে বিএনপি জোটের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেখা দেয় চরম অনিশ্চয়তা। এই ঘোষণার পর থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গুরুত্বের সাথে নিয়মিতভাবেই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেদন ও নিবন্ধ প্রকাশ করতে থাকে। বেশিরভাগ গণমাধ্যমই সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের পক্ষে মতামত প্রকাশ করে। নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উত্তাপহীন। এই সহিংস নির্বাচনের সংবাদও গুরুত্বের সাথে প্রচার করা হয়। সহিংসতার পাশাপাশি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি অনেক কম ছিল বলে বিদেশি গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়।

নির্বাচনের পরদিন বাংলাদেশের অধিকাংশ সংবাদপত্রই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কলঙ্কিত, একতরফা ও ভোটারবিহিন নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করে। এছাড়া প্রায় সব সকল সংবাদপত্রেই নির্বাচনে জাট ভোট দেওয়া ও সহিংসতার বিষয়টি উঠে আসে।

‘জাল ভোট, কলঙ্কিত নির্বাচন’ এই শিরোনামে প্রকাশিত প্রথম আলো’র প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘প্রথমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তারপর খালেদা জিয়া। এবার শেখ হাসিনা। গতকাল রোববার তৃতীয়বারের মতো একতরফা নির্বাচন দেখল বাংলাদেশ।’

উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। মূলত ঐসব আসনে একক প্রার্থী থাকায় তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। অথচ সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া … সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ-সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।’ সংবিধানের এ অনুচ্ছেদের বক্তব্য অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট এবং ৩০০ জন সংসদ-সদস্যের একক নির্বাচনী এলাকা থেকে জনগণের প্রত্যেক্ষ ভোটেই নির্বাচিত হতে হবে। যদিও আরপিও’র ১৯ ধারায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।

তাই সংসদীয় আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একক প্রার্থীকে নির্বাচিত করার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১৯ ধারা কেন সংবিধানপরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ একটি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। অধিকতর শুনানির জন্য আদালত অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুল ইসলাম, রফিক-উল হক, আজমালুল হোসেন কিউসি, রোকনউদ্দিন মাহমুদ এবং ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার-এর মতামত নেন। আদালত যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন ও মতামত গ্রহণ শেষে ১৯ জুন ২০১৪ আদালত উক্ত রিটটি খারিজ করে দেন। রায়ে আদালত বলেন, সংবিধানের সঙ্গে আরপিও’র সংশ্লিষ্ট ধারাটি সাংঘর্ষিক নয়। সংবিধানের সঙ্গে কোনো আইন সরাসরি সাংঘর্ষিক হলে, আদালত তা বাতিল করতে পারেন। আদালতে বলেন, বর্তমান আইনি কাঠামোতে ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই।

প্রতিবেদনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে একনজরে সুজন-এর কার্যক্রমসমূহ তুলে ধরা হয়। এ ভাগে বলা হয়: ‘জাতীয় সংসদ-সহ দেশের বিভিন্ন নির্বাচন উপলক্ষে নাগরিক সংগঠন ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’ নির্বাচনের আগে ও পরে ভোটারদের তথ্য দিয়ে ক্ষমতায়িত করার লক্ষ্যে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে অ্যাডভোকেসি করা-সহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক না হওয়ায় ‘সুজন’ ব্যাপকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় চারটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।’

প্রতিবেদনের শেষভাগে বলা হয়: ‘সপ্তদশ শতক থেকে আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি আবশ্যিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা হয় যে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের স্তম্ভ। মূলত, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট থেকে তার উত্তরসূরির হাতে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করতে নির্বাচন আবশ্যক, যে নির্বাচন হতে হবে শান্তিপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক। যেহেতু নির্বাচন মানে ‘চয়েজ’ বা প্রার্থী বাছাইয়ের একটি প্রক্রিয়া, তাই নির্বাচনে বিকল্প প্রার্থী থাকা জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপরোক্ত মানদ-ে উন্নীত হতে পারেনি।

নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নবিদ্ধ হিসাব মতে, যে ১৪৭টি আসনে নির্বাচন হয়েছে, তাতে ভোট পড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ বা এক কোটি ৭২ লাখ, যা সর্বমোট প্রায় নয় কোটি ২০ লাখ ভোটারের মাত্র ১৮.৬৯ শতাংশ। এ ধরনের ভোটার উপস্থিতি (অনেকের মতে, ভোটের হার আরও অনেক কম) এবং ১৫৩ আসনে প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়া কোনোভাবেই জনগণের সম্মতির পরিচায়ক নয়। এ নির্বাচনকে আইনগত দিক থেকে বৈধতা দেওয়া হলেও নৈতিকতার বিচারে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে না এবং এর দায় সরকার ও নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। আইনগত বৈধতাটিও প্রশ্নাতীত নয়। বরং এ আইনগত বৈধতা স্ব-আরোপিত বলে অনেকে মনে করেন।…

২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশে যে অস্বাভাবিকতা ও সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া জরুরি। আশা করি, আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদরা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন, সংলাপে নিয়োজিত হবেন এবং সমঝোতায় উপনীত হবেন। একইসঙ্গে তাঁরা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আলোকে পরস্পরের সঙ্গে সহাবস্থানের ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করবেন এবং জাতির আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবেন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.