নাগরিকের নিরাপত্তা ও সরকারের দায়

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি যে, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণ করেছে দুর্বৃত্তরা। বুধবার বিকেল পৌনে তিনটার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশে ভূঁইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে অস্ত্রের মুখে দুর্বৃত্তরা তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।

অপহরণের ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলামসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ঢাকা থকে ঘটনাস্থলে ছুটে যান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও। ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিবেশকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, তাঁর জানামতে তাঁর স্বামীর কোনো শত্রু নেই। তাঁদের এমন কোনো টাকা-পয়সা নেই যে কেউ তাঁর স্বামীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করতে পারে। তবে প্রাথমিকভাবে তাঁর ধারণা, তাঁর পেশাগত কর্মকা-ে কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠী চরমভাবে ক্ষুব্ধ। তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে তাঁর স্বামীকে অপহরণ করতে পারে। তিনি বলেন, ‘স্বামীর মোবাইল ফোন দুটি গাড়িতেই ছিল। আমি আমার স্বামীকে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত চাই।’

গণমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অপহৃত আবু বকর সিদ্দিক হামিদ ফ্যাশন লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক। প্রতিষ্ঠানটির মালিক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। প্রতিমন্ত্রী বিপু ও আবু বকর সিদ্দিক ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। কারখানাটি জাতীয় শ্রমিক লীগ ফতুল্লা আঞ্চলিক শাখার সভাপতি কাউসার আহম্মেদ পলাশের নেতৃত্বে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কয়েক বছর বন্ধ ছিল। গত ফেব্রুয়ারি থেকে বন্ধ কারখানাটির পরিচালনার দায়িত্ব নেন আবু বকর সিদ্দিক (প্রথম আলো, ১৭ এপ্রিল ২০১৪)।

অপহরণের ঘটনার পর থেকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের চারটি দল, ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আবু বকর সিদ্দিককে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রাজধানীর উপকণ্ঠে প্রকাশ্য দিবালোকে সশস্ত্র ব্যক্তিরা যেভাবে তাকে (আবু বকর সিদ্দিক) অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে তাতে নাগরিক হিসেবে আমরা উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত। আমরা জনাব সিদ্দিকের স্বজনদের প্রতি পরিবারের এই দুঃসময়ে গভীর সহমর্মিতা জানাচ্ছি, একই সাথে তাঁকে সম্পূর্ণ সুস্থভাবে উদ্ধারে সকল প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগ করার জন্য সরকার ও প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। আমরা একইসাথে এ ঘটনার সাথে জড়িত দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার জোর দাবি জানাই।

প্রসঙ্গত, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে অপহরণ-গুমের ঘটনা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। এসব প্রতিবেদনে বলা হচ্ছেÑ অপহরণের শিকার হচ্ছেন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, ছাত্র-শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এক থানা বা জেলায় অপহরণের ঘটনা ঘটছে, লাশ পাওয়া যাচ্ছে আরেক থানা অথবা জেলায়, লাশ মিলছে খালে, বিলে, ডোবা-নালায়। আবার কারও খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না। এসব ঘটনায় কারা জড়িত-তার রহস্যও বের করতে পারছে না পুলিশ।

১২ এপ্রিল রাতে ঢাকা থেকে নিখোঁজ কলাবাগান থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি শেখ মোঃ মুনিম ফয়েজের লাশ পাওয়া যায় পরদিন গাজীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগড়া এলাকায়। নিখোঁজ হওয়ার তিনদিন পর ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক রাজিব আহসানের (৩৭) লাশ পাওয়া যায় রূপগঞ্জের বালু নদীতে (দৈনিক করতোয়া, ১৬ এপ্রিল ২০১৪)।

বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার দুই বছরেও কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। এছাড়া নিখোঁজের ৪ মাসেও খোঁজ মিলেনি লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরুর এবং একই উপজেলার পৌর বিএনপি সভাপতি হুমায়ুন কবিরের।

২৮ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন ঢাকা মহানগর (উত্তর) ছাত্রলীগের ভাটারা থানার সাংগঠনিক সম্পাদক তানভীর হাসান অঞ্জন। গত ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বারিধারা থেকে আসাদুজ্জামান রানা, মাজহারুল ইসলাম রাসেল ও আল আমিন নামে তিন ছাত্রদল কর্মী নিখোঁজ হন। এরকম আরও অনেক খুন-গুমের সংবাদ সংবাদপত্রের পাতায় লক্ষ করা যাচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালে অপহরণের ঘটনা ঘটে ৮৭০, ২০১১ সালে ৭৯২, ২০১২ সালে ৮৫০ এবং ২০১৩ সালে ৮৭৯টি ঘটনার মামলা রেকর্ড হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, ২০১৩ সালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৬৮। একই সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের (২০১৪) জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ৩৯ ব্যক্তি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের শিকার হন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে মুদ্রিত আছে, ‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ সংবিধানের এ বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। তাই দেশের নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারকে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করার জোর দাবি জানাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.