স্থানীয় সরকারের সাম্প্রতিক নির্বাচন: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

বিগত বছরের শেষভাগে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই অনুষ্ঠিত হয় রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এতে নাগরিক মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এসেছিল। প্রায় সকল পর্যবেক্ষকের মতেই রংপুরে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন তার সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে পেরেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসন তথা সরকার দায়িত্বশীল আচরণ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও সদাচারণ করেছে। একইসঙ্গে এ নির্বাচনে গণমাধ্যম এবং ‘সুজন’-সহ নাগরিক সমাজও ব্যাপক সক্রিয়তা প্রদর্শন করেছে।

মূলত রংপুর সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী সাইকেল শুরু হয়েছিল, যা শেষ হবে চলতি বছরের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে।

রংপুরের নির্বাচনের পর নাগরিকদের মধ্যে এই প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল যে, নির্বাচন কমিশন একইভাবে অন্যান্য নির্বাচনগুলোও আয়োজনে সফলতার পরিচয় দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টো। কারণ রংপুরের পরে দুই দফায় পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ ও কয়েকটি উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে।

প্রথম দফায় ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ পৌরসভা, ইউনিয়ন ও জেলা পরিষদে ১২৭টি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সহিংসতা, কেন্দ্র দখল ও জালভোট-সহ নানা অনিয়মের মধ্য দিয়েই নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়। অনিয়মের অভিযোগে কুমিল্লায় বিএনপির ১২ চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ভোট বর্জন করেন (মানবজমিন, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭)।

অনেকে দাবি করেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেষ্ট উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও ভোটকেন্দ্রগুলো চলে যায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে। অনেক ভোটারই কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। তাদের বলা হয়েছে যে, তাদের ভোট আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। নির্বাচন যথাযথ তদারকি না করা ও নির্বাচনে সংঘটিত অনিয়মের তদন্ত না করার অভিযোগ ওঠে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে।

দ্বিতীয় দফায় ২৯ মার্চ ২০১৮, ১২৭টি (৩৪টিতে সাধারণ ও ৯৩টিতে উপ-নির্বাচন) ইউনিয়ন পরিষদ ও নয়টি (চারটিতে সাধারণ নির্বাচন ও পাঁচটিতে উপ-নির্বাচন) পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পর ৩১ মার্চ ২০১৮ তারিখে ‘এ কেমন নির্বাচন?’– এমন শিরোনামে প্রথম আলো’র এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘সংঘর্ষ, অস্ত্রের মহড়া, জাল ভোট, প্রাণহানি, ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টাসহ নানা অঘটনের মধ্য দিয়ে …অনুষ্ঠিত হলো বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বলতে যা বোঝায় তার উল্টোটা দেখা গেছে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে। এখন বাংলাদেশে নির্বাচন হয়ে দাঁড়িয়েছে পেশিশক্তির লড়াই।’ এ থেকে সুস্পষ্ট যে, রংপুর নির্বাচনের পর থেকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোর মান ক্রমান্বয়ে নেমে এসেছে।

গত ৩১ মার্চ ২০১৮, গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ১৫ মে উক্ত দুই সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া আগামী কয়েক মাসে আরও কয়েকটি সিটি করপোরেশন (রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সম্প্রতি ময়মনসিংহকে পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হয়েছে। তাই আইনানুযায়ী চলতি বছরেই এই সিটিরও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

কিন্তু দুই দফায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর মান নিম্নমুখী হওয়ায় উপরোক্ত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। এই অবস্থায় উপরোক্ত নির্বাচনগুলো কেন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতে পারলো না, কমিশন তার সুস্পষ্ট কারণ খুঁজে বের করবে, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেবে এবং ভবিষ্যতে যাতে প্রতিটি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে আমরা আশা করি।

আমরা মনে করি, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের ভূমিকাই সর্বাধিক। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারা শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের ওপরই নির্ভর করে না, এর জন্য আরও প্রয়োজন সরকার তথা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদিচ্ছা, রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীলতা এবং নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সক্রিয়তা। বস্তুত, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা, নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য হলেও, যথেষ্ট নয়। এরজন্য আরও প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট অন্য সবার সদিচ্ছা ও অবদান। আমাদের সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ ১১৮ অনুচ্ছেদের ৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবে এবং কেবলই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবে।’ এছাড়া আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম মামলার (ডিএলআর ৪৫, ১৯৯৩) রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেছেন, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করা করণীয়, তার সবই করতে পারবে, এমনকি আইন ও বিধি-বিধানের সংযোজনও করতে পারবে।

তাই আমরা আশা করি, ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলো যাতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয় সেজন্য নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে জনগণ তাদের ভোটের অধিকার পায়, নির্বাচনে জনরায়ের প্রতিফলন ঘটে, জনগণের প্রতিনিধিরাই দেশ পরিচালনা করতে পারেন এবং গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৯

Leave a Reply

Your email address will not be published.