নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংকট ও সমাধানের পথ

সাধারণত যেসব দেশের গণতন্ত্র সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত সেসব দেশে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে মাথাব্যথা নেই, দলীয় সরকারের অধীনেই — যদিও নির্বাচনের সময় সরকার শুধুমাত্র রুটিন কাজ করে — নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু আমাদের মত দেশে রাজনৈতিক দলগুলো মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও গণতন্ত্রের চর্চা কম। গণতন্ত্র নিয়ে সোচ্চার থাকলেও বিশেষ করে নির্বাচনে প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতায় যাওয়াই দলগুলোর মূল লক্ষ্য। এছাড়া আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একের অপরের উপর বিশ্বাস ও আস্থা একেবারেই কম। তাই দেখা যায়, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকে। প্রতিবার ভোটের মৌসুমের আগে জনগণের মধ্যে দেখা দেয় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। সহিংসতার আশঙ্কায় জনগণের মধ্যে নির্বাচনের উৎসবমুখর ভাবটি গত কয়েক বছর ধরে আর দেখা যাচ্ছে না।

স্বাধীনতার পর থেকেই সামরিক সরকারগুলো নির্বাচনের সময় ব্যাপক হস্তক্ষেপ চালিয়েছে। যে কারণে ১৯৯১ সালে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের গণআন্দোলনের মুখে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নির্দলীয় সরকারের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যাতে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান করে তিন মাসের নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে উপদেষ্টা পরিষদ বা সরকার গঠনের বিধান রাখা হয়। এ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনকে স্বাধীন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো। যদিও পরাজিত দল নির্বাচনকে কারচুপির নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেছিল ভোটের পরপরই। ২০০০ সালে ইউএনডিপি তাদের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নতুন গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ জয়যাত্রারূপে (an important advance in new democracy) আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে, নিজেদের পছন্দ মত বিশেষ ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তৈরির প্রেক্ষাপটে ২০০৬ সালের নির্বাচন নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে বিষয়টিকে আরও বিতর্কিত করে তোলেন। যার ধারাবাহিকতায়  ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

১০ মে, ২০১১ সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় দেন। আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধানের মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে তা বাতিল ঘোষণা করেন। তবে আদালত বলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে আগামী দুটি সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। একইসঙ্গে বিচার বিভাগকে এর সঙ্গে না জড়ানোর পক্ষে মত দেয়। পরে এ রায়ের আলোকে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান থেকে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে চালু করা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর দশম নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। দেখা যায়, নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপিসহ ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দল ঐ নির্বাচন বর্জন করে। ৩৯টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণে করে মাত্র ১২টি দল। পরে নজিরবিহীন একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার গঠন করা হয়। ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা প্রশ্ন ওঠে।

এদিকে একাদশ সংসদ নির্বাচন আসন্ন। এ অবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বাংলাদেশে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। গত ১২ জানুয়ারি সরকারের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার হবে। কিন্তু তিনি সাথে সাথে এও বলেছেন যে, সেই নির্বাচনকালীন সরকার হবে সংবিধান অনুযায়ী। তাঁর কথার মানে দাঁড়ায়, এই (দলীয়) সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। কাজেই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংকটের যে আশঙ্কা জনমনে বিরাজ করছিল তার কোনো সুরাহা হলো না। বরং তাঁর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়াতে বিরোধী দল যে অভিমত ব্যক্ত করেছে তাতে মনে হচ্ছে এই সরকারি সিদ্ধান্ত সংকটকে আরও প্রকট করবে। কাজেই এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হতে পারে এ নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে আলাপ ওঠা দরকার।

পৃথিবীর অনেক দেশেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটাও বলা হয় যে, নির্দলীয় সরকার গণতান্ত্রিক ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। এ যুক্তিগুলো সঠিক। কিন্তু শুধুমাত্র এমন যুক্তির ভিত্তিতেই বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার দরকার নেই, এমন সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। কারণগুলো পয়েন্ট আকারে বলা যেতে পারে:

১. প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অসীম। বাংলাদেশ এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পুরো পুলিশ বাহিনী তার অধীনে থাকে। তাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা নির্বাচনে অশুভ প্রভাব ফেলতে পারে।

২. বাংলাদেশের সরকার একইসঙ্গে দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব হলো- ‘ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বর্শবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করা’। অথচ দলীয় প্রধান হিসেবে সাধারণত তিনি দলের লোকদের সুবিধা দেখবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই নির্বাচনের সময় স্বার্থের সংঘাত হবে, এটাও স্বাভাবিক।

৩. বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। দু’ ভাগে বিভক্ত হয়ে কেউ সরকারের অনুগত থাকে, আবার কেউ সরকারের বিরোধী থাকে। তাই যতদিন পর্যন্ত না আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণ বন্ধ হবে ততদিন পর্যন্ত নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা থাকবে।

৪. বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণু নয়। এর ফলে দলগুলো নির্বাচনকে প্রভাবিত করে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতে তৎপর থাকে। সুতরাং উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা উদার রাজনৈতিক দল ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

৫. সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের অগাধ ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু কমিশন তার ক্ষমতা সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারে না। একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে প্রায় ১৫ লাখ জনশক্তির (কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) দরকার হয়। কিন্তু এরা কমিশনের কর্মকতা নন। সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। এদের পরিচালনা করা এবং এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা কমিশনের অত্যন্ত সীমিত। এ রকম একটি অবস্থায় দেশে এমন সরকার থাকা আবশ্যক, যারা নির্বাচন কমিশনের সাথে একযোগে অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচন করতে চায়।

এই অবস্থায় রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটাতে ড. আকবর আলি খান তাঁর ‘অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ গ্রন্থে তাত্ত্বিকভাবে চার ধরনের নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে মত দিয়েছেন:

১. অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

২. সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

৩. নির্বাচন ঘোষণার সময়ে যে সরকার ক্ষমতায় ছিল, সেই সরকার কর্তৃক নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন।

৪. নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার জন্য সরকার ও বিরোধীদল কর্তৃক মনোনীত মন্ত্রীদের দেশ পরিচালনা করা।

এর মধ্যে বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতরে থেকেই চতুর্থ নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার জন্য সরকার ও বিরোধীদলের মনোনীত মন্ত্রীদের দ্বারা অথবা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্যের ভিত্তিতে দশজন প্রতিনিধি নিয়ে দেশ পরিচালনা করা যেতে পারে, যাতে নির্বাচনকে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় এবং নির্বাচনের মাঠে সবার জন্য সমতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

যেহেতু সংসদে কার্যত কোনো বিরোধী দল নেই (যদি সরকার মনোনীত দলকে বিরোধী দল না বলি)। তাই উপরের সবগুলো পরামর্শ হয়তো আমলে নেয়া সম্ভব হবে না। তার পরেও সংসদের বাইরেও বিরোধী দলের মতামত ও পরামর্শ নিয়ে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা তৈরি করা সম্ভব। আামাদের মনে রাখতে হবে এই সংকটের সহজ সমাধান হলো, একদলের সিদ্ধান্তের বদলে, বহু দলের মতামতের প্রতিফলনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সংবিধানের কথা উঠানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ জনগণের ইচ্ছের বাইরে সংবিধান চাইলেই কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার রাজনৈতিকভাবে থাকে না। তখন সংকট আরও প্রকট হয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আপোষের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক বাতিল না হওয়ায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। কারণ বর্তমান সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যেই পরবর্তী মেয়াদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং তা বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই। এই বিধান বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’ বা সবার জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা যাবে না।

সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে প্রতিযোগিতামূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। অতীতে যে কয়টি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে তার সবগুলোতেই ক্ষমতাসীন দল জয়লাভ করেছে। এ ব্যবস্থায় সরকার বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। আর যে কয়টি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সবগুলোই সর্বশেষ ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হয়েছে। তাই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হওয়া জরুরি, যাতে নির্বাচনি মাঠের সমতল ক্ষেত্র তৈরি হয় এবং একটি উইন উইন সিচুয়েশন তৈরি হয়। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আমরা কোনো আশার বাণীর দেখতে পাই না। তিনি ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ এই শব্দ দুটি শুধু ব্যবহার করেছেন। আর বাকি সবকিছু দলীয় প্রভাব বলয়ের ভেতরেই থাকছে। অনেকের স্মরণ থাকতে পারে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও ২০০৬ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে বলে একধরনের বক্তব্য রেখেছিলেন। বাকিটা ইতিহাস। কাজেই একতরফা কোনো নীতির মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হবে না। সবাইকে নিয়ে বসে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে যে কোনো উপায়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে ক্ষমতায় যাওয়ার সংষ্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের ভেবে দেখতে হবে নিজেদের স্বার্থে দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি করে সহিংসতার পথ সুগম করলে আদতে গোটা রাজনৈতিক পরিবেশই নষ্ট হয়। ক্ষমতায় যাওয়ার চেয়ে একটি রাজনৈতিক দলের জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি করার সক্ষমতা তৈরি অনেক বেশি জরুরি। কাজেই শুধু ক্ষমতামুখী নির্বাচন নয়, বরং গণতন্ত্রমুখী, জনকল্যাণমুখী নির্বাচনের পথে আমাদের হাঁটতে হবে।

প্রকাশ: ০৫ মে ২০১৮

Leave a Reply

Your email address will not be published.