বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট: দরকার টেকসই সমাধান

বিগত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের প্রধানতম রাজনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে মতবিরোধ। আমরা দেখেছি, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি-সহ দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করায় বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল একতরফা ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন। চলতি বছর অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনটিও অংশগ্রহণমূলক হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস বাকি থাকলেও এখনো নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে মতবিরোধ রয়ে গেছে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে যে সম্ভাব্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা কাটিয়ে রাজনৈতিক সংকটের একটি স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে নাগরিক সংগঠন ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর পক্ষ থেকে একটি ‘নাগরিক সনদ’ তৈরি করা হয়। পরে ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সনদটি ‘সুজন’-এর পঞ্চম জাতীয় সম্মেলনে উত্থাপিত ও অনুমোদিত হয়।

আমরা মনে করি, উক্ত নাগরিক সনদটি এখনও প্রাসঙ্গিক। কারণ নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বের প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট প্রায় একই। তাছাড়া নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের এখনও সমাধান হয়নি, যদিও এর স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার এবং এজন্য দরকার রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা।

ভবিষ্যতের অনিশ্চিয়তা এড়াতে তথা রাজনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে ‘সুজন’-এর ‘নাগরিক সনদে’ মোটাদাগে তিনটি ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়— প্রথমত প্রয়োজন পরবর্তী নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে একটি ঐকমত্য, যা নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করবে। দ্বিতীয়ত প্রয়োজন নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা নিয়ে ঐকমত্য, যাতে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হয়। ঐকমত্যের অন্য ক্ষেত্রটি হতে হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত পরবর্তী সরকারের জন্য করণীয় সম্পর্কে। ঐকমত্যের প্রথম দুটি ক্ষেত্রে চিহ্নিত করণীয় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আশু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হলেও, নতুন সরকারের জন্য করণীয় বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচনের পরবর্তী সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই তিনটি ক্ষেত্রে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণীত ও স্বাক্ষরিত হতে পারে, যা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দূরীভূত এবং সামাজিক সম্প্রীতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবার এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পথ সুগম হবে।

নির্বাচনকালীন সরকার

সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়টি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার সব কয়টিতেই ক্ষমতাসীনরা বিজয়ী হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে এবং প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের মত গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহে দলতন্ত্রের ভয়াবহ প্রভাব বিস্তারের কারণে ভবিষতের নির্বাচনগুলোও যে কারচুপি ও কারসাজিমুক্ত হবে না — তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাই ভবিষ্যতের নির্বাচন যাতে দলীয় প্রভাবমুক্ত, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক হতে পারে সেই লক্ষ্যে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই মুহুর্তেই নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে একটি সমঝোতা হওয়া জরুরি।

প্রসঙ্গত, দলীয় সরকারের অধীনে আমাদের দেশে যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভবপর নয়, সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগসহ অনেকগুলো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবি উত্থাপন করা এবং ১৯৯৬-এর বিতর্কিত নির্বাচনের পর বিএনপি তা আমাদের সংবিধানে সংযোজন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মহাজোট সরকারের উদ্যোগে উচ্চ আদালতের একটি বিভক্ত রায়ের দোহাই দিয়ে তড়িঘড়ি করে ২০১১ সালে এই ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হয়, যদিও আদালত আরও দুই বার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দেন।

সংশ্লিষ্ট সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব হবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের (যেমন, ৯০ দিনের) মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের এবং কমিশনের সদস্যগণ যোগ্য ও নিরপেক্ষ না হলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশা করা দূরাশা মাত্র। তাই সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এ লক্ষ্যে অবশ্য কমিশনে নিয়োগদান সম্পর্কিত একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে, যে ব্যাপারে সুস্পষ্ট সাংবিধানিক (অনুচ্ছেদ ১১৮) বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এক্ষেত্রে হুদা কমিশনের রেখে যাওয়া আইনের একটি খসড়া কাজে লাগানো যেতে পারে। কমিশন পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে একটি অনুসন্ধান কমিটির সহায়তা নিতে হবে, যে কমিটি স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ দানের জন্য সুপারিশ করবে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কমিশনে নিয়োগ প্রদান করবেন।

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে। একটি সঠিক ভোটার তালিকা প্রণয়ন এ দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। ভোটার তালিকার সঠিকতা নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের প্রেক্ষাপটে হুদা কমিশনের মেয়াদকালে একটি ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন ছিলো জাতি হিসেবে আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন। কিন্তু বর্তমান কমিশনের অধীনে হালনাগাদ করা ভোটার তালিকা নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক প্রশ্ন উঠেছে, তাই আগামী নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকার সঠিকতা প্রতিষ্ঠা করা হবে পরবর্তী নির্বাচন কমিশনের অন্যতম করণীয়। এছাড়াও কমিশনকে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ ও একটি যুগোপযোগী আচরণবিধি প্রণয়ন করতে হবে। আচরণবিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ১৯৯০ সালে প্রণীত ও ‘তিনজোটের রূপরেখা’য় অন্তর্ভুক্ত আচরবিধিটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা

সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য শুধুমাত্র নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা এবং নির্বাচন কমিশনের দক্ষতাই যথেষ্ঠ নয়, এর জন্য নির্বাচনকালীন আইনকানুন ও বিধিবিধানও যথার্থ হতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও); ভোটার তালিকা আইন, ২০১০; নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন, ২০১০; জাতীয় সংসদ (সংরক্ষিত মহিলা আসন) নির্বাচন আইন, ২০০৪ — এগুলো নির্বাচন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন। এছাড়াও রয়েছে নির্বাচনী আচরণবিধি। বিদ্যমান আইনি কাঠমো বহুলাংশে গ্রহণযোগ্য হলেও, এগুলোতে কিছু সংস্কার আনতে হবে এবং নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে মোটাদাগের কিছু সংস্কারের ব্যাপারেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আরপিও’তে ‘না-ভোটে’র এবং দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের সুস্পষ্ট বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়াও নির্বাচনী ব্যয়ে লাগাম টানার লক্ষ্যেও আইনি সংস্কারের প্রয়োজন হবে।

আমাদের দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক অঙ্গনকে কলুষমুক্ত করতে হলে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার মানদণ্ড আরও কঠোর এবং আদালত-নির্দেশিত হলফনামার মাধ্যমে তাদের প্রদত্ত তথ্য নির্বাচন কমিশনের জন্য পদ্ধতিগতভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে হবে। যেহেতু আরপিও’র বিধান অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী হলফনামায় তথ্য গোপন করলে কিংবা এতে ভুল তথ্য দিলে সেই প্রার্থী সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য হবেন না এবং নির্বাচিত হলেও সংসদ সদস্য থাকতে পারবেন না, তাই হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য কঠোরতার সঙ্গে নিরীক্ষণ করলে অর্থলোভী অনেক বসন্তের কোকিলকেই নির্বাচনী অঙ্গন থেকে দূরে রাখা যাবে। প্রসঙ্গত, সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে কমিশনের হলফনামা নিরীক্ষণের, এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচনের খাতিরে আইনি বিধানের সঙ্গে সংযোজনেরও এখতিয়ার রয়েছে, যদিও কমিশনকে তা প্রয়োগ করতে দেখা যায় না।

নির্বাচন পরবর্তী সরকারের করণীয়

নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার এবং সেই সরকার কর্তৃক নিয়োগ দেওয়া একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারলেও, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজমান অসহিষ্ণুতা ও হানাহানি তথা দৈন্যের সমস্যা দূরীভূত হবে না। এর জন্য প্রয়োজন হবে নির্বাচন পরবর্তী সরকারের করণীয় সস্পর্কে একটি ঐকমত্য সৃষ্টি। আর তা করতে পারলেই আমরা সমস্যার টেকসই সমাধান আশা করতে পারি।

যথাযথ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের জন্য মোটাদাগে বাধ্যতামূলক করণীয় বিষয়গুলো হতে পারে:

(১)        যুদ্ধাপরাধের বিচার দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর করা, যাতে ইতিহাসের এ কালো অধ্যায় পেছনে ফেলে আমরা কলঙ্কমুক্ত হতে পারি।

(২)        জাতীয় সংসদকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, যাতে সংসদ যথাযথভাবে সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে। একইসঙ্গে সংসদ সদস্যদের সততা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাঁদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন এবং সংবিধান নির্দেশিত সংসদ ও সংসদ সদস্যদের জন্য একটি বিশেষ অধিকার আইন বা প্রিভিলেইজ অ্যাক্ট প্রণয়ন করা।

(৩)        রাজনৈতিক দলের সংস্কারের মাধ্যমে দলগুলোকে গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ করা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সকল স্তরে দলতন্ত্রের অবসান ঘটানো। কারণ যুগোপযোগী দল ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতা পরিহার করার এবং সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রবাদ ও সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্যও অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে তাদেরকে বিশ্বাসী হতে হবে।

(৪)        রাজনৈতিক দলসমূহের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বিলুপ্ত করা এবং লেজুড়ভিত্তিক শিক্ষক, ছাত্র ও শ্রমিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা।

(৫)        বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা। বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির মাধ্যমে উচ্চ আদালতে বিচারকদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা তদন্ত করে এসব ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিচার বিভাগের সত্যিকার পৃথকীকরণের মাধ্যমে নিম্ন আদালতের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকেও রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের অপসংস্কৃতি বন্ধের অঙ্গীকার করতে হবে।

(৬)        আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দানের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা, যাতে কমিশনের পক্ষে একটি সর্বোব্যাপী দুর্নীতি দমন অভিযান পরিচালনা করা সম্ভবপর হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে যুদ্ধাপরাপরাধের বিচার লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইবুনালের মত দুর্নীতি বিরোধী বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করা। একইসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন প্রভৃতি সংবিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোর প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং নিরপেক্ষ ও নির্ভিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দানের মাধ্যমে কার্যকর করা।

(৭)        একটি সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়ন, পুলিশ আইনের আধুনিকায়ন এবং সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সংস্কারের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে দৈনন্দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজের পরিবর্তে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য র‌্যাবকে সামরিক বাহিনীর অধীনে একটি কমান্ডো ইউনিট হিসেবে গড়ে তোলা।

(৮)        প্রশাসনিক ও আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে একটি বলিষ্ঠ কর্মসূচি গ্রহণ করা এবং এ লক্ষ্যে অন্তত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ন্যূনতম ৫০ শতাংশ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে ব্যয় করা। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপ তথা এমপিতন্ত্র ও দলতন্ত্রের অবসান ঘটানো এবং যথাসময়ে সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে নির্বাচন নিশ্চিত করা।

(৯)        সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা, যে কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে পরবর্তী সরকার উদ্যোগ নেবে। সংবিধান সংশোধনের সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো হতে পারে: রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা; প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদসীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া; মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীকে ‘সমদের মধ্যে প্রথম’ বা ফ্রার্স্ট এমাং দি ইকোয়েল করা; ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ রোধে একই ব্যক্তির একাধারে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলের প্রধান হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা; যোগ্য ব্যক্তিদের রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য গঠিত ‘ইলেক্টরাল কলেজে’ স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করে সংসদ সদস্যদের মত প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া; বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারের মাধ্যমে একক আঞ্চলিক এলাকাভিত্তিক নির্বাচন এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির সমন্বয়ে একটি মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতির প্রবর্তন করা; দুই-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করা; সংসদের ন্যূনতম এক তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত এবং এ সকল আসনে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা; সংবিধানকে প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রে ফিরিয়ে আনা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণসহ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা; রি-কল বা ভোটারদের অনাস্থা প্রদানের বিধান প্রবর্তন করা; আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা; গণভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করা ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ সংসদে অনুমোদনের পর তা গণভোটের মাধ্যমে সংবিধানে সংযোজন করা যেতে পারে।

(১০)      সরকারি ও বেসরকারি সকল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং নাগরিক সমাজের কাজের পরিধি যাতে সঙ্কুচিত না হয় সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। কারণ স্বাধীন গণমাধ্যম এবং নিরপেক্ষ ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ ছাড়া গণতন্ত্র কার্যকর হয় না।

(১১)      গুম, খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সংখ্যালঘুসহ সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখা।

(১২)      প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে ‘পলিটিক্যাল ফাইন্যান্স’ বা রাজনীতির অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা, যাতে নির্বাচনী ব্যয় ও রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের ওপর লাগাম টানা সম্ভবপর হয়। এর ফলেই হয়ত ‘বেস্ট ডেমোক্রেসি মানি ক্যান বাই’ বা টাকা দিয়ে কেনা যার এমন উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র হবার বদনাম আমরা ঘোচাতে পারবো।

(১৩)      একটি নতুন ‘সামাজিক চুক্তি’তে উপনীত হওয়া, যাতে সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সম্পদে তাদের ন্যায্য হিস্যা পেতে পারে। একইসঙ্গে পিছিয়ে জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।

(১৪)      পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে জাতিকে রক্ষা করার লক্ষ্যে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

২০১৪ গড়িয়ে এখন ২০১৮ সাল। কিন্তু প্রেক্ষাপট প্রায় একই। আমরা মনে করি, সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিরতা এড়াতে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া জরুরি। কিন্তু শুধু একটি নির্বাচন, এমনকি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং এর পরিণতিতে সৃষ্ট ভয়াবহ অনিশ্চয়তার সমস্যার টেকসইভাবে সমাধান করতে হলে উপরোল্লেখিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। আশা করি, আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদরা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন, সংলাপে নিয়োজিত হবেন, সমঝোতায় উপনীত হবেন এবং একটি ‘নাগরিক সনদে’ স্বাক্ষর করবেন। একইসঙ্গে তাঁর বহুদলীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আলোকে পরস্পরের সঙ্গে সহাবস্থানের ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করবেন এবং দেশকে এগিয়ে নেবেন।

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০১৮

¬

Leave a Reply

Your email address will not be published.