একাদশ নির্বাচনে জয়লাভ করার মাধ্যমে টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। আগামী ০৭ ডিসেম্বর পূর্ণ হবে এই সরকারের এক বছর। তাই সময় এসেছে সরকারের অর্জন ও ব্যর্থতা পর্যালোচনা করার। যদিও মাত্র এক বছর সরকারের সামগ্রিক কার্যক্রম মূল্যায়নের জন্য উপযুক্ত সময় নয়।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশে যে অস্বাভাবিকতা ও সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে আমরা আশা করেছিলাম যে, একাদশ সংসদ নির্বাচনটি হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক। কিন্তু নির্বাচনের পূর্বে গণভবনে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সংলাপ অনুষ্ঠিত হলেও দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হয়নি। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে, ‘আমার ওপর আস্থা রেখে নির্বাচনে আসেন। অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে যারা জয়ী হবে, তারা ক্ষমতায় আসবে। নির্বাচনে কোনো হস্তক্ষেপ হবে না।’ তথাপিও আমরা দেখেছি যে, নানাবিধ কারণে বিএনপি-সহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্বাচনে অংশ নিলেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে সুস্থ প্রতিযোগিতার জন্য যে ধরনের অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন তা সৃষ্টি হয়নি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাঁর সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় নির্বাচনের ফলাফলও হয়েছে প্রায় একতরফা। তাই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেকের মনেই গুরুতর প্রশ্ন দেখা রয়েছে।
দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মানে অবনতি ঘটায় আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনঅনাস্থা প্রতিফলিত হচ্ছে। এছাড়া নির্বাচনের মানে অবনতি ঘটেছে এবং নির্বাচনের প্রতি ও ভোটদানে ভোটারদের অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিরোধী পক্ষগুলো অংশ না নেয়ায় সে নির্বাচন ছিল একতরফা এবং উপ-নির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটারের অনুপস্থিতি ছিল লক্ষণীয় বিষয়।
দশম সংসদ নির্বাচনের মতো একাদশ নির্বাচনও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় বর্তমান সংসদেও আমরা কার্যকর বিরোধীদল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছি। যদিও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পরিশীলিত করার জন্য সংসদে একটি কার্যকর বিরোধী দল থাকা অপরিহার্য। কিন্তু এখন বিরোধী দলের নামে সংসদে যা কিছু করা হয় তার অনেকটাই পাতানো খেলা। বর্তমানে আমাদের নির্বাহী বিভাগের প্রধান শুধু নির্বাহী বিভাগই পরিচালনা করেন না, তিনি সংসদ পরিচালনা করেন এবং বিরোধী দলও কীভাবে পরিচালিত হবে তাও অনেকটাই নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে ক্ষমতার বিভাজনের যে কাঠামো Ñ চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সÑ তা কার্যকর থাকছে না এবং আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রও সঠিকভাবে বিকশিত হচ্ছে না।
ক্ষমতার বিভাজনের কাঠামোর অভাবে তথা লাগামহীন ‘ক্রেনি ক্যাপিটালিজম’ বা ফায়দাতন্ত্রের বিস্তারের মাধ্যমে দেশে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের এবং বিদেশে অর্থ পাচারের লাগামহীন বিস্তার ঘটেছে। ধার করে অবকাঠামো উন্নয়নে বিরাট অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগের ফলে আমাদের ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আয়ের বৈষম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সর্বোপরি একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সুশাসনের অভাবে অর্জিত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
দলীয়করণের কারণে আমাদের প্রায় সকল সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান আজ জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কাঠামো নিজের থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে — এজন্য নির্ভর করতে হয় উপরের সবুজ সংকেতের ওপর। এছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান, বিশেষত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে অন্যায় ও অপরাধমূলক কার্যক্রমে ব্যবহারের ফলে, তারা নিজেরাই অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত হতে উৎসাহিত হয়ে পড়েছে, এমনকি অনেক সময় অপরাধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিন্ডিকেটও গড়ে তুলেছে। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতির কারণে দেশে বিগত কয়েক বছরে জি কে শামীম, স¤্রাট ও তুফান সরকারের মতো হাজার হাজার দুর্বৃত্ত সৃষ্টি হয়েছে।
দেশে আইনের শাসন তথা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নানানভাবে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার। উদাহরণস্বরূপ, দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ও শিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার, ভিন্ন মতের মানুষেরা গুম ও খুনের শিকার হচ্ছেন, বিপুল সংখ্যক মানুষ সামাজিক বৈষম্যের শিকার এবং মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আইন ও শালিস কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৩৬২ জন হত্যা ও ৮ জন গুমের শিকার হয়েছেন। সংস্থাটির তথ্যমতে, এই সময়ে ১৩৫১ জন নারী ধর্ষণ ও ৪৪৩ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছেন।
দমন-পীড়নের কারণে বর্তমানে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। সরকার আমাদের সিভিল সোসাইটি ধ্বংস করে দিয়েছে। দুয়েকজন ছাড়া সিভিল সোসাইটির অধিকাংশই অনুগত ও সুবিধাপ্রাপ্ত। দুর্ভাগ্যবশত দুয়েকটি গণমাধ্যম ছাড়া কেউ দায়িত্বও পালন করছে না। সেলফ সেন্সরশিপ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
অথচ আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে দেশে গণতন্ত্রিক চেতনা ও সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা, নাগরিকের জন্য আইনের আশ্রয় ও সহায়তা নিশ্চিত করা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা সুমন্নত করা, সর্বজনীন মানবাধিকার নিশ্চিত করা, দক্ষ, সেবামুখী ও জবাবহিদিহিমূলক প্রশাসন সৃষ্টিতে নানা কর্মপন্থা, জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুরক্ষা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল।
আমরা মনে করি, সরকার স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও জনকল্যাণমুখী না হলে রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা দুরাশা মাত্র। তাই সরকারের ভবিষ্যৎ আর নাগরিকের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য একই সুতায় গাঁথা; কারণ সরকারের যথেচ্ছাচারের মাশুল শুধু দলকেই নয়, সব নাগরিককেই গুনতে হয়। তাই সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আমাদের আশা যে, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী চার বছর সরকার তার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত করবে, দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে এবং ভোটাধিকার-সহ নাগরিকদের সব অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে।
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২০