বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ সংক্রমণ ব্যাধি করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯। করোনার প্রভাবে আজ মানুষের জীবন ও জীবিকা দুটোই হুমকির সম্মুখীন, যাকে ভাবা হচ্ছে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ (!) হিসেবে। ১২ এপ্রিল পর্যন্ত করোনার সংক্রমণে সারা বিশ্বে ১১ লাখ ১৪ হাজার ১৮৫ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে, সংক্রমিত হয়েছেন ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৫০৩ জন। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও আজ নিরাপদ নয়। রাজধানী শহর থেকে বিভিন্ন জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ৬২১ জন ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩৪ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, যদিও এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি (প্রথম আলো, ১২ এপ্রিল ২০২০)।
বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ০৮ মার্চ। এরপর ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এ সংক্রমণে আক্রান্তের সংখ্যা। প্রথমদিকে ঢাকার মধ্যে ও ঢাকার বাইরে করোনার নমুনা পরীক্ষা কম করা হয় বিধায় রোগীর সংখ্যাও কম ধরা পড়ে। কিন্তু নানান মহলের চাপে সরকার যখন ঢাকার বাইরেও পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ায়, তখন সমানতালে বাড়তে থাকলে রোগীর সংখ্যাও। ১২ এপ্রিল একদিনেই দেশে ১৩৯ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। অনেকে মনে করেন, ১৭ মার্চ মুজিববর্ষ পালনের জন্য ১৭ মার্চে আগে দেশে করোনাভাইরাস আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ুক সরকার এটি চায়নি, যে কারণে সরকার ব্যাপকহারে করোনা পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়নি এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের আগমন রোধ করেনি ও তাদের জন্য বাধ্যতামূলক ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা করেনি।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ প্রস্তুতি নেয়ার জন্য অনেকদিন সময় পেয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার না করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বারবার আশ্বস্ত করা হয় যে, সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন যে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের প্রস্তুতি সবচেয়ে ভালো! একইভাবে ২০ মার্চ তারিখে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু করোনা ব্যাপক হারে (সামাজিক পর্যায়ে সংক্রমণ) ছড়িয়ে পড়ার পর জনগণের সামনে সরকারের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় ও জনমনে সরকারের কার্যক্রমে অসন্তোষ পরিলক্ষিত হয়।
শনাক্তকরণের হার না বাড়ানো
দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও সংস্থা থেকে বারবার বলা হয়েছে যে, শনাক্তকরণের হার বাড়াতে হবে। কিন্তু দীর্ঘদিন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বাইরে আর কোথাও পরীক্ষা চালু করা সম্ভব হয়নি। বিভাগীয় ও বড় জেলা শহরে করোনা পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আইইডিসিআর-এর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনার ভাষ্যমতে, প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন মাত্র এক হাজার জনের করোনা পরীক্ষা করতে পারে। ৬ই এপ্রিল সিঙ্গাপুরের স্ট্রেইটস টাইমস পত্রিকায় বলা হয়, ইন্দোনেশিয়া ও ইথিওপিয়ার পর, বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের বিপরীতে টেস্ট করার হার বিশে^ সর্বনিম্ন! আর মৃতের হার সর্বোচ্চ (মানবজমিন, ৭ এপ্রিল ২০২০)!
অপর্যাপ্ত পিপিই
সরকার প্রথম থেকেই বলে আসছিল দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক পিপিই রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পর্যাপ্ত পিপিই না থাকার কারণে অনেক চিকিৎসক সাধারণ রোগীদের দেখা থেকে বিরত থেকেছেন। ফলে করোনা আক্রান্ত না হয়েও শুধু চিকিৎসার অভাবে অনেকে সাধারণ রোগে মারা গেছেন। মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসকরা নিজ উদ্যোগে পিপিই ও মাস্ক সংগ্রহ করেছেন।
বিভিন্ন বেসরকারি মহল থেকে সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিপুল সংখ্যক পিপিই সংগ্রহে সহায়তা করার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ওসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানায় যে, তাদের হাতে পর্যাপ্ত পিপিই রয়েছে। দেশীয় বিভিন্ন কারখানা থেকে ক্রয়াদেশ দিয়ে পিপিই নেয়া হয়েছে। কিন্তু ৫ই এপ্রিল জাতিসংঘের ঢাকাস্থ কার্যালয় থেকে একটি সিচুয়েশন রিপোর্টে উঠে আসে ভিন্ন চিত্র। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম) কর্তৃপক্ষকে জানায় যে, বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী প্রতি মাসে রোগীদের জন্য ৫ লাখ মাস্কসহ ১২ লাখ পিপিই সেট প্রয়োজন। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন এন৯৫ মাস্ক।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাড়ে ৩ লাখের মতো পিপিই সংগ্রহ করতে পেরেছে। বিতরণ শেষে আর হাতে আছে মাত্র ৪২-৪৩ হাজার। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু মানের অর্থাৎ লেভেল ৩-এর পিপিই আছে মাত্র ১০ হাজার! স্থানীয় বিভিন্ন কারখানা থেকে যেসব পিপিই কেনা হয়েছিল, আর ফলাও করে সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল, সেগুলো সব লেভেল ১-এর পিপিই। এসব পিপিই’র কার্যকারিতা অনেক কম। যারা সরাসরি রোগীর আশেপাশে যাবেন, পরিচর্যা করবেন, তাদের অবশ্যই লেভেল-৩ পিপিই পরতে হয়। এসব স্বাস্থ্যকর্মীকে অবশ্যই এন৯৫ মাস্ক পরতে হয়। কিন্তু চীন সরকার ও জ্যাক মা ফাউন্ডেশন থেকে যেই ৪৫ হাজার এন৯৫ মাস্ক দেওয়া হয়েছে, তা দিয়ে চলবে মাত্র ১০ দিন (মানবজমিন, ৭ এপ্রিল ২০২০)।
অপর্যাপ্ত আইসিইউ বেড ও ভেন্টিলেটর
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশে হাসপাতালের রোগীদের জন্য যতগুলো বেড আছে তার কমপক্ষে ১০ শতাংশ আইসিইউ বেড থাকা উচিত। সেটি না থাকলে ন্যূনতম ৪ শতাংশ বেড থাকতেই হবে। বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে বেডের সংখ্যা ৩১ হাজার ২০০। কিন্তু দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে এই কয়েকদিন আগেও বেড ছিল ২২১, এদের অনেকগুলোতেই আবার ভেন্টিলেটর নেই।
করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশে শ্বাস-প্রশ্বাসের কৃত্রিম যন্ত্র ভেন্টিলেটরের অপর্যাপ্ততার ব্যাপারে উদ্বেগ জানায় ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’। ০৭ এপ্রিল সংস্থার এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও ভেন্টিলেটরের সুবিধা রাজধানীসহ কয়েকটি প্রধান শহরে রয়েছে। ফলে, প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে এগুলোর সুবিধা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়বে। উল্লেখ্য, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ১ হাজার ৭৬৯টি ভেন্টিলেটর রয়েছে অর্থাৎ প্রতি ৯৩ হাজার ২৭৩ মানুষের জন্য ভেন্টিলেটর আছে গড়ে একটি। কিন্তু করোনা মোকাবিলার জন্য সরকার পর্যাপ্ত সময় পেলেও করোনা আক্রান্তদের জন্য আইসিইউ সুবিধা-সহ বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নেয়নি।
প্রবাসী ফেরতদের জন্য অপর্যাপ্ত কোয়ারেন্টিন
করোনা প্রতিরোধে জাতীয় কমিটির প্রথম সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ইতালি থেকে প্রথম দফায় আসা ১৬৪ জনকে হজ ক্যাম্পে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখা হবে। এজন্য হজ ক্যাম্প প্রস্তুত করে রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয় ধর্ম মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রবাসীরা। পরে তাঁদের বেশির ভাগকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকিদের গাজীপুরের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। প্রবাসীদের ঠিকানা অনুসারে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান নিশ্চিত করার ব্যাপারে নির্দেশনা আসে দেরিতে। এতে প্রবাসীরা এলাকায় খুশিমতো ঘুরে বেড়াতে থাকেন, যার ফলে করোনা গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। পরে অবশ্য নানা উদ্যোগের ফলে অনেককে কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়।
সমন্বয়হীনতা
বর্তমানে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় গোটা সরকারব্যবস্থা যুক্ত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ ১৫টি মন্ত্রণালয় এখন এই কাজে যুক্ত। তথাপিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক রাজধানীর মহাখালীতে পেশাজীবীদের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে ১ মার্চ তাঁকে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কমিটির প্রধান করা হলেও তিনি অনেক কিছু জানেন না। কবে কারখানা খোলা হবে, কিংবা খোলা রাখা হবে কিনা, মসজিদে নামাজ কীভাবে হবে, কখন রাস্তা খুলে দেয়া হবে বা বন্ধ রাখা হবে কিনা এসব বিষয়ে কমিটির সঙ্গে আলোচনা করা হয় না বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন। (বিবিসি বাংলা, ০৬ এপ্রিল ২০২০)। জাহিদ মালেকের উপরোক্ত বক্তব্য সমন্বয়হীনতার ইঙ্গিত দেয়।
করোনা প্রতিরোধে জাতীয় কমিটিতে পুলিশের মহাপরিদর্শকে (আইজিপি) রাখা হয়নি। ফলে জাতীয় কমিটির কোনো সিদ্ধান্ত আইজিপি জানতেন না। এতে করে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের তিনি কোনো নির্দেশনাও দিতে পারতেন না। অবশ্য বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা কমিটিতে পুলিশকে রাখা হয়।
তথ্যগত বিভ্রান্তি
সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলে আসছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। কিন্তু দিনের পর দিন একটি ছোট কক্ষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করে আসছিল রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। ২১ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কক্ষে দেড় শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিকের সামনে কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ঠাসাঠাসি পরিবেশ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন সাংবাদিকেরা।
৩ এপ্রিল পেশাজীবীদের এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশে নতুন ২৯ জন আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছে। আর মারা গেছে ৪ জন। কিন্তু দেড় ঘণ্টা পর আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা নিয়মিত ব্রিফিংয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ভিন্ন তথ্য দেন। ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকেরা জানতে চান, কার তথ্য ঠিক, জাহিদ মালেকের নাকি মীরজাদী সেব্রিনার। এরপর থেকে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ বন্ধ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে বুলেটিন হিসেবে তথ্য দেয়া শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কিছু পদক্ষেপ বিভ্রান্তি ও বিতর্কের সৃষ্টি করে। গত ২৫ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, ‘যদি কোনো রোগীর কোভিড-১৯-এর লক্ষণ থাকে, তবে প্রথমে চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দেবেন এবং প্রয়োজনে পিপিই পরিধানকৃত দ্বিতীয় চিকিৎসকের কাছে প্রেরণ করবেন এবং তিনি পিপিই পরিহিত অবস্থায় রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করবেন।’ কিন্তু সমালোচনার মুখে আদেশটি স্থগিত করা হয়। একই দিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরেক আদেশে কেউ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হলে সেনাবাহিনীর তল্লাশিচৌকি বা থানার ওসিকে জানানোর কথা বলা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন গণপদত্যাগের হুমকি দেয়। সমালোচনার মুখে সেই আদেশও বাতিল করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম তখন বলেছিলেন, আদেশটি তাঁকে না জানিয়ে করা হয়েছিল (প্রথম আলো, ০৯ এপ্রিল ২০২০)।
গণমাধ্যম তদারকি করার বিতর্কিত আদেশ জারি
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো ‘গুজব’ ছড়াচ্ছে কি না, তার তদারকি করতে আদেশ জারি করেছিল তথ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এর কয়েক ঘণ্টা পর সমালোচনার মুখে তা বাতিল করা হয়। উল্লেখ্য, ২৬ মার্চ দেশের ৩০টি বেসরকারি টেলিভিশন ‘মনিটরিং’ করতে মন্ত্রণালয়ের ১৫ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় উক্ত আদেশ জারি করেছিল (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২৬ মার্চ ২০২০)।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা নিয়ে বিভ্রান্তি
প্রতিটি উপজেলায় দুটি করে কোভিড-১৯ এর পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা নিয়েও বিভ্রান্তি দেখা যায়। ২ এপ্রিল অনলাইন ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) শাখার পরিচালক হাবিবুর রহমান জানান, দেশে করোনাভাইরাসের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিতে প্রতি উপজেলা থেকে অন্তত দুটি করে নমুনা পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অধিদফতর জানায় ওই তথ্য সঠিক নয়, বরং বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
একদিকে যোগাযোগ চালু, অন্যদিকে ছুটির ঘোষণা
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার প্রথমে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। কিন্তু এমন ঘোষণার সময় ২৩ মার্চ যোগাযোগব্যবস্থা পুরোপুরি চালু ছিল। তাই এই ছুটির ঘোষণায় হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছাড়ে। বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে এবং রেলস্টেশনে ঘরমুখী মানুষের ভিড় শুরু হয়। ফলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়ে। অবস্থা সামাল দিতে পরে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করার ঘোষণা আসে। ২৬ মার্চ থেকে পুরোপুরিভাবে গণপরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়।
তৈরি পোশাক কারখানা খোলা রাখার বিতর্কিত সিদ্ধান্ত
সাধারণ ছুটি ঘোষণা হলেও তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ রাখতে চাননি মালিকেরা। ২৬ মার্চ বিজিএমইএ কারখানা বন্ধ রাখতে সংগঠনের সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানায়। এক দিন পর বিকেএমইএও অনুরোধ জানায়। তাতে বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে সরকারের প্রথম দফার ছুটি বাড়ানো হয়। কিন্তু ১ এপ্রিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মালিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পোশাক কারাখানা চালু রাখা যাবে। এরপর বিভিন্ন কারখানার পক্ষ থেকে শ্রমিকদের কাছে বার্তা পাঠিয়ে বলা হয় ৫ এপ্রিল থেকে কারখানা খোলা হবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই বেতন ও জীবিকার টানে শ্রমজীবী এই মানুষগুলো আগের দিন পরিবহন বন্ধের মধ্যেও হেঁটে বা যে যেভাবে পারেন ঢাকা ও আশপাশের শিল্প এলাকায় আসতে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে ৪ এপ্রিল রাতে বিজিএমইএ-এর অনুরোধে আবার কারখানা বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ থাকায় নিজ বাড়ি ফিরতে আবারো বিপাকে পড়েন শ্রমিকরা।
সাদুল্লাপুর ‘লকডাউন’ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ধোঁয়াশা
২২ মার্চ গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর ‘লকডাউন’ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। এ দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লকডাউনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জেলা প্রশাসক জানান এমন একটি চিঠি এলেও তিনি গ্রহণ করেননি। সে সময় একটি বিয়েতে দু’জন বিদেশফেরত করোনা রোগীর উপস্থিতির পর এলাকা লকডাউন চাচ্ছিলেন এলাকাবাসী। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের অস্পষ্ট সিদ্ধান্তে ধোঁয়াশায় পড়ে যান উপজেলাবাসী (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ২২ মার্চ ২০২০)।
চিকিৎসা নিয়ে ভোগান্তির অভিযোগ
হাসপাতালগুলোতে করোনা পরীক্ষা এবং চিকিৎসা নিয়েও ভোগান্তির নানা অভিযোগ উঠে আসছে। সম্প্রতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তির পর মারা যাওয়া একজন ব্যক্তির পরিবার সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, ওই ব্যক্তিকে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে খাবার এবং কোনো চিকিৎসা দেয়া হয়নি (বিবিসি বাংলা, (১২ এপ্রিল ২০২০)। এমনকি অনেক জায়গায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে সেবা দিতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য-কর্মীদের অস্বীকৃতি জানানোরও অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি এই অভিযোগে ছয়জন ডাক্তারকে বহিষ্কার করা হয়।
লকডাউন পালনে শিশিলতা
লকডাউনের সময় মানুষকে যে ঘরে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে প্রথমদিকে অনেক জায়গায় শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীতে সরকার এক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করলেও রাজধানীর অনেক জায়গায় শুধু নোটিশ আর রাস্তা বন্ধ করেই যেন প্রশাসনের দায়িত্ব শেষ। নেই যথাযথ তদারকি। কিছু এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকরা দায়িত্বপালন করলেও তারাও খাচ্ছেন হিমশিম। কোথাও কোথাও স্থানীয় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই কোনো কোনো এলাকা ‘লকডাউন’ করে দিয়েছে স্থানীয় অতি-উৎসাহী কিছু লোক।
আশার কথা হলো, কিছুটা দেরিতে হলেও সরকার এখন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নানান ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার বাইরে করোনা পরীক্ষা করা ও আক্রান্তদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য বিশেষ ইউনিট গঠন করা হয়েছে, যদিও জনসংখ্যার তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয় এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরজ্ঞামের অভাব রয়েছে। স্থবির অর্থনীতিকে সচল রাখতে এবং সব মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনতে ৭২,৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের জন্য ৫ শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে করোনা ভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় যেসব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন, তাদের পুরস্কৃত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারা ছাড়াও এই বিপদের সময়ে সাধারণ মানুষের সেবায় মাঠে থেকে দায়িত্ব পালন করে চলা মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মচারীর জন্য বিশেষ বিমার ব্যবস্থা করার ঘোষণাও দেন তিনি। এছাড়াও করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জনগণকে অবশ্যপালনীয় হিসেবে ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, আমরা সবাই সচেতন হলে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে, বিত্তবানরা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ালে এবং রাষ্ট্র ও সরকার দায়িত্ব নিলে আমরা করোনাভাইরাসের এই বিপর্যয় এড়াতে সক্ষম হবো। আর তা সম্ভব হলে ভালো থাকবো আমরা সবাই, ভালো থাকবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।
(উল্লেখ্য, প্রতিবেদনটি তৈরি করতে ০৯ এপ্রলি ২০২০ প্রথম আলোতে প্রকাশিত করোনা মোকাবলিায় আরও সমন্বয় জরুরি শীর্ষক প্রতিবেদনের সহায়তা নেয়া হয়েছে)
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২০