বাংলাদেশের নির্বাচনে ইভিএম: প্রাসঙ্গিক আলোচনা

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তথ্য-প্রযুক্তি মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে নানানভাবে প্রভাবিত করেছে। স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনি প্রক্রিয়াতেও এর প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে তুলনামূলক সহজ পন্থা হিসেবে বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ভোট গ্রহণের জন্য ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, যদিও কিছু নেতিবাচক দিকের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশই ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে আসছে।

বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সংক্ষিপ্ত পরিসরে এবং সিটি করপোরেশন-সহ বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু বৃহৎ পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করার বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক, সন্দেহ ও অবিশ্বাস চলমান রয়েছে। এর প্রধান কারণ মূলত তিনটি; ১. ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকা; ২. যন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশের ইভিএমের দুর্বলতা; ৩. নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনি ব্যবস্থার ব্যাপারে ভোটারদের আস্থাহীনতা।

ইভিএম কী
ইভিএম-এর পূর্ণরূপ হলো ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন। ভোট প্রয়োগে মেশিন বা ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় বিধায় সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম নামে পরিচিত। একে ই-ভোটিং-ও বলা হয়। মূলত আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করে নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে আরও গ্রহণযোগ্য, সহজ, কার্যকরী ও স্বচ্ছ করার লক্ষ্যেই সারাবিশ্বে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণের প্রচলন শুরু হয়েছে।

ইভিএম-এর সংজ্ঞায় এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় বলা হয়েছে: ইলেক্ট্রনিক ভোটিং হলো কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত ভোটগ্রহণের একটি পদ্ধতি, যেখানে ভোটাররা কম্পিউটারের সাহায্যে তাদের প্রার্থী নির্বাচন করে।

উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে: ইলেক্ট্রনিক ভোটিং (ই-ভোটিং নামেও পরিচিত) হলো একটি ভোটদান পদ্ধতি, যেখানে ভোটগ্রহণ ও ভোট গণনা করতে ইলেক্ট্রনিক উপায় (যন্ত্র) ব্যবহার করা হয়।

ইভিএম যেভাবে ব্যবহার করা হয়
বাংলাদেশে ব্যবহৃত ইভিএম কয়েকটি ইউনিটে ভাগ করা থাকে। ইউনিটগুলো হলো:
১. ব্যালট ইউনিট: ব্যালট ইউনিটটি থাকে বুথের ভেতর। এর মাধ্যমে ভোটার তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন।
২. কন্ট্রোল ইউনিট: কন্ট্রোল ইউনিট বা ডেটা যাচাই করার যন্ত্র থাকে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সামনের টেবিলে।
৩. ডিসপ্লে ইউনিট: ইভিএমের সঙ্গে একটি বড় ডিসপ্লে ইউনিট রাখা হয়েছে, যা এমন স্থানে রাখা হয় যাতে বুথের ভেতর ভোট-সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টিগোচর হয়।
৪. ব্যাটারি ইউনিট: এই মেশিন চালাতে দরকার হয় ১২ ভোল্টের একটি ব্যাটারি। ব্যাটারিতে মেশিনটি প্রায় ৪৮ ঘণ্টা চলতে পারে। ফলে বাড়তি কোনো বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় না।
৫. স্মার্ট কার্ড ও মাস্টার কার্ড: একটি ভোটিং মেশিন পরিচালনা করার জন্য সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে একটি করে স্মার্ট কার্ডভিত্তিক আইডি কার্ড দেওয়া হয়, যে কার্ডটি ছাড়া কন্ট্রোল ইউনিট পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। ইউনিটগুলো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থাকলেও তারের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে।

উপরোল্লেখিত কন্ট্রোল ইউনিটটি কাজ শুরু করে দুটি অ্যাকসেস কোডের মাধ্যমে। এর একটি থাকে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে, অন্যটি সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কাছে একটি পিন নম্বর থাকে, তা ব্যবহারের মাধ্যমে ভোটারের সংরক্ষিত তথ্য জানা যায়। মেশিনটির একটি অংশে ভোটারের আঙুলের ছাপ দেওয়ার জায়গা আছে। সেখানে আঙুলের ছাপ দেওয়া হলে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত হয়। আঙুল ছাড়াও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর এন্ট্রি দিয়ে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। ভোটার পরিচয় নিশ্চিত হলে তা মনিটরে দেখা যাবে। মনিটরটি ভোটকক্ষের এমন স্থানে স্থাপন করা হয়, যেখান থেকে ভোটারের পরিচয় সম্পর্কে রিটার্নিং কর্মকর্তা, উপস্থিত বিভিন্ন দলের পোলিং এজেন্ট ও ভোটার নিজে দেখতে পান। ভোটার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলে ভোটারকে ভোট দেওয়ার গোপন কক্ষে পাঠানো হয়। সেখানে প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য ব্যালট যন্ত্র থাকে, যেখানে বিভিন্ন প্রার্থীর নাম ও প্রতীক দেখা যায়। মূলত, ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরই ব্যালট যন্ত্র সক্রিয় হয়, অন্য সময় এই যন্ত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে।

ব্যালট যন্ত্রে প্রত্যেক প্রার্থীর নাম ও প্রতীকের পাশে আলাদা সাদা বোতাম থাকে। বোতামে চাপ দিলে যন্ত্র থেকে স্বয়ংক্রিয় বার্তায় বলা হয়, ‘আপনার পছন্দের প্রতীক নিশ্চিত হলে সবুজ বাটন চাপুন’। এরপর নিচে থাকা সবুজ বোতাম চেপে ভোটারকে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হয়।

তবে কোনো ভোটার যদি ভুলে অন্য প্রতীকের পাশের বোতামে চাপ দিয়ে ফেলেন, তাহলে সবুজ বোতাম না চেপে তৎক্ষণাৎ সঠিক বোতাম চাপতে পারেন। এভাবে নিশ্চিত হওয়ার আগে দুবার বদলানোর সুযোগ পাওয়া যায়। তবে তৃতীয়বার যে প্রতীকের পাশের বোতাম চাপা হবে, ভোট সেই প্রার্থীকে দেওয়া হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

ভোটার যখন ভোট দিতে কক্ষের ভেতরে থাকেন, তখন বাইরের মনিটরে লেখা থাকে, ‘ভোট গ্রহণ চলছে’। ভোট দেওয়া সম্পন্ন হলে বাইরের মনিটরে, মোট ভোটারের সংখ্যা এবং যতজন ভোট দিয়েছেন, তাদের সংখ্যা দেখা যায়। ফলে এর বাইরে কোনো ভোট এলে পোলিং এজেন্ট সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝতে পারেন। একই ভোটার যদি আবার ভোট দেওয়ার চেষ্টা করেন, তবে যন্ত্র জানাবে যে তার ভোটটি ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, ইভিএম যদি ভোটারের আঙুলের ছাপ পড়তে না পারে, উপস্থিত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ইভিএমকে ওভাররাইড করতে পারেন। অর্থাৎ ভোটারের পরিচয় শনাক্ত করে তাকে ভোটদানের সুযোগ দিতে পারেন।

উল্লেখ্য, একটি ইভিএমে প্রায় চার হাজারটি পর্যন্ত ভোট দেয়া যায়। একটি যন্ত্রে সর্বোচ্চ ৬৪ জন প্রার্থীর তালিকা থাকে। ভোটারের পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর ইভিএমের বাটন চাপ দিয়ে অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যক্তিও ভোট দিতে পারেন। একটি ভোট দিতে আনুমানিক ১৪ সেকেন্ড সময় লাগে।

যেসব প্রতিষ্ঠান ইভিএম তৈরি করে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার অন্যতম উপকরণ ইভিএম তৈরি করে থাকে। বাংলাদেশেও ইভিএম তৈরি হয়। অন্যরকম গ্রুপের একটি সহযোগী সংগঠন ‘পাইল্যাব বাংলাদেশ’ ইভিএম তৈরি করে থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য ইভিএম প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো হলো: ১. ভারত ইলেক্ট্রনিকস্ লিমিটেড, ভারত; ২. ডোমিনিয়ন ভোটিং সিস্টেমস্, কানাডা; ৩. ইলেক্ট্রনিকস্ করপোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড, ভারত; ৪. ইএসএন্ডএস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; ৫. হার্ট ইন্টারসিভিক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; ৬. নেড্যাপ, নেদারল্যান্ডস; ৭. প্রিমিয়ার ইলেকশন সল্যুশনস্, (সাবেক ডাইবোল্ড ইলেকশন সিস্টেমস্) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; ৮. সিকোইয়া ভোটিং সিস্টেমস্, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; ৯. ভোটেক্স বা টিএম টেকনোলোজিস্ ইলেকশনস্ ইনকর্পোরেট, কানাডা। এছাড়াও আকুপোল, এডভান্সড্ ভোটিং সল্যুশনস্, মাইক্রোভোট, স্মার্টম্যাটিক, ইউনিল্যাক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলো ইভিএম প্রস্তুতকারক হিসেবে খ্যাত।

বাংলাদেশে ইভিএমের বিকাশের ধারা
২০০৭ সালে এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন গঠিত হওয়ার পর থেকে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। সে সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আইআইসিটি বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ড. এস এম লুৎফর কবির ইভিএম তৈরির প্রকল্প প্রস্তাবনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে জমা দেন। ‘পাইল্যাব বাংলাদেশ’ নামে একটি ইভিএম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান প্রকল্প প্রস্তাবনার সঙ্গে জড়িত ছিল। মূলত সে বছর ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের কার্যকরী সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম ইভিএমের ব্যবহার শুরু হয়। উক্ত নির্বাচনে ইভিএমের সফল ব্যবহারের কারণে তারা সরকারের কাছে আবেদন করেন যেন এই পদ্ধতিতে দেশের সকল নির্বাচনে ভোটগ্রহণ করা হয়। কিন্তু তখন ছবি সংবলিত ভোটার তালিকা তৈরির কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি।

এরপর নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ১৪টি ভোট কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করে ভোটগ্রহণ করা হয় এবং এতে সফলতা আসে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কাছ থেকে ইভিএমগুলো নেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু পরবর্তীতে কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন কমিশন ইভিএমগুলো রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যবহার করতে গেলে বিপত্তি বাঁধে। একটি মেশিনে হঠাৎ ত্রুটি দেখা যায়। প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এই ত্রুটির সমাধান বের করতে পারেনি। ফলে প্রায় ১,২৫০টি ইভিএমকে বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন বিদেশ থেকে ইভিএম ক্রয় করে এবং দাবি করে যে এই মেশিনগুলো আগের চেয়ে অধিক কার্যকরী। ফলশ্রুতিতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে রংপুর ও ২০১৮ সালের মে মাসে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

২০১৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) বেশকিছু সংশোধনী আনা হয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম-এর ব্যবহারকে আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। এর ফলে প্রচলিত ব্যালট পেপারভিত্তিক ভোটের পাশাপাশি নির্দিষ্ট নির্বাচনি এলাকায় ইভিএম ব্যবহারেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রচলিত ব্যালট পেপারের পাশাপাশি ইভিএম-এর মাধ্যমে ভোট গ্রহণ প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়। এর ভিত্তিতে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। সেই নির্বাচনের আগে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার ইভিএম কেনা হয়েছিল ।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে। বর্তমান আউয়াল কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য ছাড়াই বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় এবং নতুন করে আরও ২ লাখ ইভিএম কেনার জন্য ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত করে । কিন্তু দেশের বিরাজমান আর্থিক সংকটের কারণে নির্বাচন কমিশনের উক্ত প্রকল্প পাস হয়নি । তাই ৫০-৭০টি আসনে কমিশনের হাতে থাকা ইভিএম দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটগ্রহণ করা হতে পারে।

ইভিএম ব্যবহারে ভারত-সহ অন্য দেশের অভিজ্ঞতা
ইভিএম পদ্ধতি প্রথম চালু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ১৯৬০ সালে। এর ৪ বছরের মধ্যেই ৭টি রাজ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিসট্যান্সের পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্বের ১৭৮টি দেশের মধ্যে যেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, বর্তমানে মাত্র ২৮টি দেশের জাতীয় নির্বাচনে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে, ১৩টি দেশে সম্পূর্ণরূপে ই-ভোটিং ব্যবহার করা হচ্ছে।

অনেকগুলো দেশ নিরাপত্তা, সঠিকতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং যাচাইকরণ সংক্রান্ত ত্রুটি ও দুর্বলতার কারণে ইভিএমকে নিজ নিজ দেশে নিষিদ্ধ করেছে। জার্মানি ও আয়ারল্যান্ড ইভিএম নিষিদ্ধ করেছে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ইভিএম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। ইতালি ইভিএমে পাইলট প্রজেক্ট সম্পন্ন করার পর ব্যালট পেপারেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র পেপার ট্রেইল ছাড়া ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় ৮৫ ভাগ দেশেই এই পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে। তবে এই ব্যর্থতার পেছনে মেশিন যতটা না দায়ী ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক ও অন্যান্য কিছু সমস্যা।

ভারতে ইভিএম চালুর পর থেকেই এ নিয়ে বির্তক দেখা দেয়। দেশটিতে প্রথম ইভিএম ব্যবহার হয় ১৯৮২ সালে, কেরালা রাজ্যের একটি স্থানীয় নির্বাচনে, ৫০টি কেন্দ্রে । নির্বাচনে কংগ্রেস নেতা এ সি জোসে কমিউনিস্ট পার্টির এন সিভান পিল্লাইয়ের কাছে হেরে গেলে কেরালা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে ওই ৫০টি আসনে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে পুনর্নির্বাচন হলে জোসে জয়লাভ করেন। তবে ভারতে বর্তমান প্রজন্মের আধুনিক ইভিএমে ‘ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল-ভিভিপিএটি’ (VVPAT) সংযুক্ত রয়েছে, যাতে ভোটারের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে ভোটদানের স্লিপ বা নথি চলে আসে, যেন ভোটদানের প্রকৃত অবস্থা নিশ্চিত হওয়া যায় এবং ভোটের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ভোট পুনর্গণনা করা যায়। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভোটের স্বচ্ছতা ও সঠিকতা নিশ্চিত করার জন্য ইভিএমের সঙ্গে ভিভিপিএটি (VVPAT) ব্যবহারের নির্দেশ দেয়।

ইভিএম ব্যবহারের সুবিধা
ইভিএম ব্যবহারের বেশকিছু সুবিধা রয়েছে:
১. ইভিএম তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর হয় বলে এতে দ্রুত ভোট গণনা করা সম্ভব হয় এবং ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত করা সহজ হয় এবং নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দেওয়া নিশ্চিত করা সম্ভব হয় বলে ভোট বাতিল হবার আশঙ্কা অনেক কমে আসে (ব্ল্যাঙ্ক, ২০০৭ )।
২. ভোটার কম সময়ে ভোট দিতে পারেন।
৩. ভোট নষ্ট বা বাতিল হয় না। ব্যালট পেপারে অনেক সময়স ঠিক জায়গায় সিল পড়ে না, কখনও কখনও ব্যালট ভাঁজ করার ফলে সিলের দাগ অন্যদিকে পড়ে, ফলে ব্যালট/ভোট বাতিল হয়। কিন্তু ইভিএমে এ সমস্যা থাকে না। তাছাড়া ভোটের তথ্য মেশিনে প্রায় দশ বছর ধরে অবিকৃত অবস্থায় থাকবে।
৪. ব্যালট পেপারে একজন আরেকজনের ভোট দিতে পারলেও ইভিএমে আঙুলের ছাপ না মিললে ভোট দেওয়া যায় না এবং একাধিক ভোট দেয়া যায় না। তাই এর মাধ্যমে জাল ভোট ঠেকানো যায়।
৫. ইভিএম ভেঙে ফেললেও বা পানিতে ডুবিয়ে দিলেও ব্ল্যাক বক্সের মাধ্যমে প্রদত্ত ভোটের হিসাব পাওয়া যায়। যদিও এ বিষয়ে কারিগরি ও প্রযুক্তিগণের ভিন্ন মতও রয়েছে।
৬. ইভিএম ব্যবহারের ফলে কোটি কোটি ব্যালট ছাপানোর খরচ, কাগজের খরচ, এগুলো পরিবহনের খরচ, ভোট গণনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকবলের খরচ সাশ্রয় হয়।
৭. ১২ ভোল্টের ব্যাটারী চালিত বিধায় ইভিএম ব্যবহারকালে ইলেক্ট্রিক শক খাওয়ার আশঙ্কা নেই।
৮. ভোটকেন্দ্রে কোনো গন্ডগোল হলে বা কেন্দ্র দখল হলে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার কন্ট্রোল ইউনিটের ক্লোজ বাটনটিতে চাপলেই কেন্দ্র দখলকারীরা কোনো ভোট দিতে পারবে না। তাছাড়া ইভিএমের স্মার্ট কার্ড সরিয়ে ফেললেও মেশিনটি চালু করা যাবে না। আবার প্রতি মিনিটে পাঁচটির বেশি ভোট দেওয়া যাবে না।
৯. একজন ভোটার ভোট দেয়ার পর ১০ থেকে ১২ সেকেন্ড ব্যালট ইউনিট স্বয়ংক্রিয়ভাবে অকার্যকর থাকে। ফলে সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ইচ্ছা করলেও একজন ভোটারকে একাধিক ভোট দানের সুযোগ করে দিতে পারবেন না।
১০. একটি মেশিন দিয়ে চার-পাঁচটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। চাইলে ইভিএম দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন বা উপ-নির্বাচনেও ব্যবহার করা যাবে। সেক্ষেত্রে শুধু মেশিনে নতুন করে প্রোগ্রাম প্রবেশ করাতে হয়।

ইভিএম ব্যবহারের অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতা
তথ্য-প্রযুক্তিবিদদের মতামত এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ইভিএম ব্যবহারের কিছু সুবিধা থাকলেও বাস্তবে এর গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে যেসব দেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার ক্ষেত্রে টানাপোড়েন চলছে, সেসব দেশের ক্ষেত্রে এটা সবচাইতে বেশি সত্য। সেসব দেশে ইভিএম-এর প্রয়োগ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক পর্যালোচনাতে এখন পর্যন্ত সেসব দেশে প্রচলিত পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের পক্ষেই বিশেষজ্ঞদের মতামত রয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে ভবিষ্যতেও এই প্রযুক্তি তার প্রত্যাশা পূরণ করবে না তেমনটা ভেবে নেওয়াও ঠিক হবে না।

ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে দাবি করা হয় যে, এর মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হলে তাতে ভোট গ্রহণের জন্য সার্বিক ব্যয় কমে আসে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে জটিল ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জামাদির মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার খরচ কম হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এছাড়া এই পদ্ধতির বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টিতে যেসব সহায়ক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয় (যেমন, ভোটের ফলাফলকে নিরীক্ষাযোগ্য করতে ডিজাইনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন) সেগুলোকে আমলে নিলে এই ব্যয় আরও বেড়ে যায়। অনেক পর্যবেক্ষক লক্ষ করেছেন যে, ইভিএম প্রবর্তনের ক্ষেত্রে তার ব্যবহারিক দিকগুলোর মতই সমান বিবেচনায় ছিল প্রযুক্তি ব্যবহারের মর্যাদার দিক। ফলে নির্বাচনি প্রক্রিয়াতে ইভিএম ব্যবহার করার মাধ্যমে সে দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আধুনিক মনে করা হবে— এই বিষয়টিও কাজ করে।

ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো ভোট জালিয়াতির নিরসনে এবং নির্বাচনের নির্ভরযোগ্যতা প্রতিষ্ঠায় এর ভূমিকা কী? যদিও দাবি করা হতো যে, ইভিএম এই ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, এখন পর্যন্ত নানা দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে বাস্তবে এই বিষয়টিতেই ইভিএম নিয়ে আস্থাহীনতা সবচাইতে প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে (ব্ল্যাঙ্ক, ২০০৭)। আর যেসব দেশে গণতন্ত্রের দিক থেকে তুলনামূলকভাবে নবীন, তাদের বেলাতে এটি আরও বেশি প্রযোজ্য। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সমাজকর্মী দুই তরফ থেকেই এই বিষয়টিতে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে (ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল ২০০৬ , পৃষ্ঠা ১)। এর মূল কারণ হচ্ছে, ইভিএম মূলত কম্পিউটার প্রোগ্রামের ওপর নির্ভর করে কাজ করে। কম্পিউটার প্রোগ্রামে যেমন অগোচরে ভুল থেকে যাওয়া সম্ভব, তেমনি ইচ্ছাকৃতভাবেও সেটাকে ভুলভাবে প্রোগ্রাম করা যায় (ব্ল্যাঙ্ক ২০০৭, ভেরিফাইড ভোটিং ২০১৯)। এই সমস্যার কারণে ইভিএম নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ভোট নিরীক্ষার সমস্যা ।

সুজন সচিবালয় কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এক প্রবন্ধে বাংলাদেশে ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধার ক্ষেত্র ও উদ্বেগ তুলে ধরা হয়েছে। নিম্নে সে নিবন্ধের আলোকে ইভিএম ব্যবহারের কিছু অসুবিধা ও উদ্বেগ তুলে ধরা হলো:

এক. ইভিএমে ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল না থাকা
বাংলাদেশে ব্যবহৃত ইভিএমে ‘ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল’ (ভিভিপিএটি) নেই, যার ফলে ভোটের ফলাফল পুনর্গণনা বা অডিট করা যায় না। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন যে ফলাফল দেবে তা-ই গ্রহণ করতে হবে। আর আমাদের ইভিএমের এ দুর্বলতার কারণেই ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গঠিত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির প্রধান বুয়েটের সাবেক উপাচার্য প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী বর্তমানে ব্যবহৃত ইভিএম কেনার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন (প্রথম আলো, ১৬ অক্টোবর ২০১৮)।

২০১৮ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যন্ত্রে ভোট নেওয়া হচ্ছে। তবে অভিযোগ আছে, চেষ্টা করা সত্ত্বেও যন্ত্রে ভোট দেওয়াকে সম্পূর্ণ নিরাপদ করা যায়নি। তাই এটি খুব সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। এখানে কেবল যন্ত্রের ব্যবহার রাখলে চলবে না। কাগজের ব্যবহার (ভিভিপিএটি) থাকতে হবে ।’ উল্লেখ্য, ইভিএমের এই দুর্বলতা কাটাতেই ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেখানকার ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করা হয়েছিল।

ইভিএম তৈরির কারিগরি কমিটির সুপারিশে ভিভিপিএটি অপশনটি রাখার দেওয়ার পরও কেন তা রাখা হয়নি? এ বিষয়ে কমিশনের ভাষ্য তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের ভাষ্য ছিল, ‘এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে, ঐ ফিচারটি রাখতে গেলে অন্য কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা হচ্ছে।’

ইভিএমে ভিভিপিএটি থাকা না থাকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ভেরিফাইড ভোটিং ফাউন্ডেশন’-এর মতে, ইভিএমে প্রোগ্রামিং ত্রুটি ও টেম্পার করার সুযোগ থাকে। ভোটার-যাচাইযোগ্য অডিট ট্রেইল না থাকলে ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনা বা ব্যবহার করা উচিত নয়। প্রসঙ্গত, আমাদের ব্যবহৃত ইভিএমের ডিজিটাল অডিট ট্রেইল ব্যবহার করতে হলে অসংখ্য মেশিনের ফরেনসিক এনালাইসিস লাগবে, যার সক্ষমতা আমাদের দেশে নেই।

বাংলাদেশে ব্যবহৃত ইভিএমে ভিভিপিএটি না থাকা-সহ আরও কিছু কারণ দেখিয়ে ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, আগামী জাতীয় নির্বাচনে (২০২৩) ইভিএম ব্যবহার না করার আহ্বান জানায় দেশের ৩৯ জন নাগরিক। তাঁরা সর্বোচ্চ দেড় শ আসনে ইভিএম ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের নেওয়া সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক হিসেবে আখ্যা দেন ।

২. কর্মকর্তাদের ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা
কর্মকর্তাদের ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা যদি ভোটারের উপস্থিতিতে নিজের আঙ্গুলের চাপ দিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য ইভিএম খুলে দিতে পারেন, তা হলে ভোটারের অনপুস্থিতিতেও তিনি নিজের ইচ্ছামত যে কোনো সংখ্যক ভোট তিনি দিতে পারবেন — কেউ তা দেখবে না এবং জানবে না — যার মাধ্যমে ভোটের ফলাফল বদলে দেওয়া সম্ভব। বিবিসির এক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২৫% ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদেরকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হলেও, সামান্য কয়েক শতাংশ ভোটের ব্যবধানেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়।

৩. ইন্টিগ্রেটেড রেজাল্ট তৈরির সুযোগ নেই; ভোটদান ডিজিটাল, কিন্তু ফলাফল তৈরি ম্যানুয়াল
সব কেন্দ্রের ইন্টিগ্রেটেড ফলাফল স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করতে বর্তমান ইভিএম সক্ষম নয়। একারণেই ইভিএমে ভোট হলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায় ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল পেতে। তাই, একটি কেন্দ্রের বা একটি পুরো আসনের ভোটদানের ফলাফল যদি ম্যানুয়ালি তৈরি করতে হয়ে, তাহলে এর অস্বচ্ছতা দিবালোকের মত স্পষ্ট।

৪. অন্য যেকোনো ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের মত প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে ইভিএমকে প্রস্তুত করতে হয়
ইভিএম একটি প্রোগরামেবল কম্পিউটিং যন্ত্র, যা সোর্স কোডের মাধ্যমে পরিচালিত। প্রস্তুতকারক কর্তৃক ইভিএম এমনভাবে প্রোগরাম্ড করা সম্ভব, যার ফলে যন্ত্রটি ভোটের প্রকৃত চিত্র অনেক উপায়েই বদলে দিতে পারে। সোর্স কোড পরীক্ষা না করলে এই ত্রুটি ধরা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ব্যবহৃত ইভিএমের সোর্স কোড হার্ডওয়্যারের সঙ্গে এমনভাবে সংযুক্ত যে আলাদাভাবে কোড পরীক্ষা করার জন্য তা সরবরাহ করা সহজ নয়।

৫. নির্বাচন কমিশনের কারিগরি টিম ভোটের ফলাফলও পাল্টে দিতে পারে
ইভিএম যন্ত্র নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং এর কারিগরি টিম ভোটের ফলাফল বদলে দিতে পারে। অনেকরই স্মরণ আছে যে, গত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্তত দুইবার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছিল, ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমেই যা সম্ভব হয়েছিল বলে অনেকের ধারণা। নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও এমন অভিযোগ উঠেছিল। এছাড়াও অনেক সময় ভোট শুরুর আগেই প্রার্থীর এজেন্ট থেকে রেজাল্ট শিটে দস্তখত নিয়ে নেওয়া হয়।

৬. একটি কেন্দ্রের সব বুথের মাস্টার ডেটাবেজ নেই
একটি কেন্দ্রের সব ভোটারের তথ্য সব পুলিং বুথে থাকে না। ফলে একটি বুথের ইভিএম কাজ না করলে, নষ্ট হলে বা ইভিএমে ভোটারের বায়োমেট্রিক শনাক্ত করা না গেলে, অন্য ইভিএমে তাদের ভোট নেওয়া যায় না।

৭. ইন্টারনেট সংযুক্ত না থাকলেও দূর থেকে ইভিএম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব
ইভিএম ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, তাই যন্ত্রটিকে ভার্চুয়ালি ম্যানুপুলেট করা অসম্ভব, এই ধারণাটিও সম্পূর্ণ সঠিক নয়। ইভিএম ইন্টারনেটে সংযুক্ত নয়, তবে কমিশনের নিজস্ব প্রাইভেট নেট বা ইন্ট্রানেটে বসে কোন বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষে ম্যালওয়ার ঢুকিয়ে কারসাজি করা সম্ভব। তাছাড়াও, মেশিনটির ভেতর প্রস্তুতকারক এমন ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ স্থাপন করতে পারে যা ইভিএমকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে এটিকে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য করে তুলতে পারে।

৮. বায়োমেট্রিকভিত্তিক ইভিএম নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ করে
বায়োমেট্রিকসের বা আঙ্গুলের চাপ দিয়ে ভোটার শনাক্তকরণে জটিলতা, ভোটারদের অসচেতনতা ও মেশিন হ্যাঙ কারণে ইভিএম ব্যবহার করলে ভোটের হার কমে যায়।

. ইভিএম একটি ব্ল্যাকবক্স, যার স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ থাকে
ব্যালট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভোটার নিজের হাতে সিল মেরে তা স্বচ্ছ ব্যালট বক্সে ফেলার পর তা প্রার্থীর এজন্টের সামনে বা প্রকাশ্যে গণনা করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াই স্বচ্ছ ও বহুলাংশে দৃশ্যমান। অন্যদিকে ইভিএমে ভোট প্রদান প্রক্রিয়া দৃশ্যমান নয়, ফলে ভোটারদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। এসব কারণে পৃথিবীর ১৭৮টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৩টি দেশ বর্তমানে সব ক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহার করে থাকে।

১০. ইভিএম আমাদের দেশের জন্য উপযোগী নয়
আমাদের আবহাওয়ায় অধিক পরিমাণের আদ্রতার কারণে দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকলে ইভিএম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ০৬ আগস্ট নির্বাচন কমিশনে আয়োজিত এক কর্মশালায় জানানো হয়, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের অভাবে মাঠপর্যায়ে থাকা ৯৩ হাজার ৪১০টি ইভিএমের ৩০ ভাগ এই মুহূর্তে অকেজো হয়ে গেছে, আর ঝুঁকিতে রয়েছে ৬৫ হাজার ।

১২. নিখুঁত এনআইডি এবং বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডার এখনো তৈরি হয়নি
সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের নিখুঁত বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডার সঠিকভাবে তৈরি হয়নি বলে নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বিষয়ক লাখ লাখ অভিযোগ উঠেছে। আরেকটি নতুন সমস্যা হলো প্রায় পাঁচ কোটি নাগরিকের জন্মনিবন্ধনের তথ্য হারিয়ে যাওয়া। ২০২৩ সালের মধ্যে কোটি কোটি নাগরিকের জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি তৈরি-সহ, বিদ্যমান এনআইডির কোটি কোটি ভুল শুধরানো অসম্ভব। তাই যেখানে নিখুঁত এনআইডি এবং বায়োমেট্রিক তথ্যভা-ারই তৈরি হয়নি, সেখানে অর্ধেক (১৫০) আসনে ইভিএমে ভোটের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

ভিএম ব্যবহারে করণীয়
নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের আগে উপরোক্ত অসুবিধা ও উদ্বেগের কারণগুলো দূর করা দরকার। তবে মোটাদাগে যে কয়টি বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার তার মধ্যে অন্যতম হলো:
১. ইভিএম ব্যবহারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি করা। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে ঐকমত্য না থাকার বিষয়টি খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালও স্বীকার করেছেন। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপকালীন তিনি বলেছিলেন, ‘অধিকাংশ দল ইভিএম বিশ্বাস করছে না।’ তাই ইভিএমের ব্যবহারের ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে, প্রযুক্তিক উৎকর্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণের আস্থার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
২. ইভিএম ব্যবহার করতে ভিভিপিএটি যুক্ত করা এবং একইসঙ্গে একাধিক স্থানে ভোটের রেকর্ড সংরক্ষণের ব্যবস্থা অর্থাৎ ডিরেক্ট রেকর্ড ইলেক্ট্রনিক (উজঊ) এর সাথে ইভিএম সমন্বিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে ভোট নিয়ে কোনো অসঙ্গতির অভিযোগ উঠলে সেটা যাচাই করার উপায় থাকবে। এই প্রক্রিয়ায় ভোটে ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি নিরসনে যেমন সাহায্য করতে পারবে, তেমনি ইভিএম-এর ওপর আস্থা বাড়াতেও সাহায্য করবে।
৩. নির্বাচনি ব্যবস্থা ও নির্বাচনের কমিশনের ওপর আস্থা তৈরি করা। কারণ ইভিএম পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। তাই ইভিএম যে সঠিকভাবে কাজ করবে তা প্রমাণ করা (বার্ডেন অব প্রুফ) এবং কমিশনের ওপর আস্থা তৈরি করার দায়িত্ব কমিশনের।
৪. ইভিএম ব্যবহারের আগে রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতি ঘটানো, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান-এর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ৩০ মে ২০২২, সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘গোপন কক্ষে একজন করে ‘ডাকাত’ দাঁড়িয়ে থাকে, এটাই ইভিএমের চ্যালেঞ্জ ।’ এ মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কারিগরি উৎকর্ষতাও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ভোটের নিশ্চয়তা দেয় না। ভোটার শনাক্তকরণের পরে যেখানে ডাকাতরা ‘বাটন’টি টিপে দেন, সেখানে প্রযুক্তিনির্ভর ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। অনিয়মের কারণে ১২ অক্টোবর ২০২২ তারিখে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচন বন্ধ করার মাধ্যমে এটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে। তাই ইভিএমের বিষয়টি শুধুই কারিগরি অক্ষমতার নয়, বরং বিষয়টি রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চারও।

(উপরোক্ত নিবন্ধটি ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিতব্য নেসার আমিনের লেখা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ফলাফল’ থেকে নেয়া হয়েছে)

Leave a Reply

Your email address will not be published.