নির্বাচন ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড

স্বাধীনতার পর থেকেই সামরিক সরকারগুলো নির্বাচনের সময় ব্যাপক হস্তক্ষেপ চালিয়েছে এবং দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। যে কারণে ১৯৯১ সালে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের গণআন্দোলনের মুখে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনকে স্বাধীন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো। ২০০০ সালে ইউএনডিপি তাদের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নতুন গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ জয়যাত্রা রূপে আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকার বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে, নিজেদের পছন্দমতো বিশেষ ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করে তোলে। 

পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট এক সংক্ষিপ্ত রায়ে শর্তসাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেন। আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে বলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে আগামী দুটি সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। একই সঙ্গে বিচার বিভাগকে এর সঙ্গে না জড়ানোর পক্ষে মত দেন। যদিও সংক্ষিপ্ত রায়ের ১৬ মাস পর আদালত তার পূর্ণাঙ্গ রায়ে তত্ত্বাবধায়ক রাখার ব্যাপারে সংসদের অনুমতির শর্ত জুড়ে দেন, যা ছিল সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে সর্বসম্মত সুপারিশ করে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কমিটির বৈঠকের পর পাল্টে যায় সে সুপারিশ। এক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে বলা হয় যে আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন, যা ছিল আদালতের সংক্ষিপ্ত রায়ের ভুল ব্যাখ্যা। দেখা যায়, সে সময় রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াই সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর দশম নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। দেখা যায়, নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপিসহ ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচন বর্জন করে। ৩৯টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে মাত্র ১২টি দল। পরে নজিরবিহীন একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হয়। ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালে সব দলের অংশগ্রহণে সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ভোটের মাঠ ছিল ক্ষমতাসীনদের দখলে এবং নির্বাচনের ফলাফলও ছিল একতরফা, যার ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায় স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনেও। যদিও নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ওপর আস্থা রেখে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। 

বর্তমান সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যেই পরবর্তী মেয়াদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং তা সংসদ বহাল রেখেই। এ বিধান বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সবার জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা যায় না। 

অতীতে যে সাতটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে তার সবগুলোতেই ক্ষমতাসীন দল জয়লাভ করেছে। কারণ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দল বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। আর যে চারটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সবগুলোই সর্বশেষ ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হয়েছে। তাই অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে বিদ্যমান কাঠামো সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিরাট প্রতিবন্ধকতা। কারণ এ কাঠামোয়:

১. বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অসীম। বাংলাদেশ এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পুরো পুলিশ বাহিনী তার অধীনে থাকে। তাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে।

২. বাংলাদেশে সাধারণত সরকারপ্রধান তথা প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব হলো ‘ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করা।’ অথচ দলীয় প্রধান হিসেবে সাধারণত তিনি দলের লোকদের সুবিধা দেখবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই নির্বাচনের সময় স্বার্থের সংঘাত হবে, এটাও স্বাভাবিক।

৩. বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। দুভাগে বিভক্ত হয়ে কেউ সরকারের অনুগত থাকে, আবার কেউ সরকারের বিরোধী থাকে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ একটি দলের প্রতি আমলাদের সমর্থন ও নিরঙ্কুশ আনুগত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই যত দিন পর্যন্ত আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণ বন্ধ না হবে, ততদিন পর্যন্ত নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা থাকবে।

৪. বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণু নয়। এর ফলে দলগুলো নির্বাচনকে প্রভাবিত করে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতে তৎপর থাকে। সুতরাং উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা উদার রাজনৈতিক দল ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

৫. সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের অগাধ ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু কমিশন তার ক্ষমতা সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারে না। একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে প্রায় ১৫ লাখ জনশক্তির (কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) দরকার হয়। কিন্তু তারা কমিশনের কর্মকর্তা নন, তারা সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। এদের পরিচালনা করা এবং এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা কমিশনের অত্যন্ত সীমিত। এ রকম একটি অবস্থায় দেশে এমন সরকার থাকা আবশ্যক, যারা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে একযোগে অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচন করতে চায়।

আমরা মনে করি, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচনী মাঠের সমতা তথা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। যেমন একটি ফুটবল খেলা নিরপেক্ষভাবে আয়োজনের জন্য একজন নিরপেক্ষ রেফারির পাশাপাশি মাঠকেও সমতল রাখা হয়, যাতে কোনো একটি দল বিশেষ সুবিধা না পায়। এছাড়া অতিরিক্ত বাতাসের প্রবাহ ও পারিপার্শ্বিক কারণে কোনো একটি দল যাতে বাড়তি সুবিধা না পায় সেজন্য ৪৫ মিনিট পর পার্শ্ব পরিবর্তন করা হয়। তাছাড়া খেলায় ফাউল করলে শাস্তিস্বরূপ রেফারি কর্তৃক লাল ও হলুদ কার্ড দেখানো, অফসাইড হলে গোল বাতিল ও সাম্প্রতিক সময়ে গোল বাতিলে প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হচ্ছে। 

দ্বিতীয়ত, বিদ্যমান কাঠামো পরিবর্তন তথা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি যে আন্দোলন পরিচালনা করছে সেক্ষেত্রে তারা যদি ব্যর্থ হয় এবং নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক, বিশ্বাসযোগ্য তথা গ্রহণযোগ্য হবে না। বস্তুত যে নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক নয়, সেটিকে নির্বাচনই বলা যায় না। কারণ এতে জনগণের সম্মতি অর্জন হয় না ও বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প থাকে না।

‘নির্বাচন’ শব্দের অর্থ ও এর উদ্দেশ্য কী? মেরিয়াম ওয়েবস্টার অভিধান অনুযায়ী, নির্বাচন হলো ‘Right, power or privilege of making a choice’ অর্থাৎ বেছে নেয়ার ক্ষমতা, অধিকার ও বিশেষ সুযোগ। তাই যেখানে বিকল্প থাকে না, সেখানে বেছে নেয়ার সুযোগও থাকে না। ফলে কোনো ভোটের আয়োজনের ক্ষেত্রে যদি বিকল্প প্রার্থী না থাকে, তাহলে সেটিকে নির্বাচন বলা সংগত নয়।

তাই ব্যক্তিকে বাছাই করার ক্ষমতা, অধিকার ও সুযোগ দিতে হলে বিকল্পগুলো সমপর্যায়ের হতে হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, বিকল্প বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে, যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ থাকে এবং বিকল্পগুলোর মধ্য থেকে যেকোনোটি বেছে নেয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য নির্বাচনের মাঠে বিএনপি না থাকলে ভোটারদের বিকল্প প্রার্থীর মধ্য থেকে বেছে নেয়ার সুযোগ থাকবে না। ফলে এ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও গ্রহণযোগ্য হবে না এবং জনগণের সম্মতির শাসনও প্রতিষ্ঠিত হবে না।

তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশনের হাতে অগাধ ক্ষমতা থাকলেও কমিশন তা প্রয়োগে অনীহা প্রদর্শন করে। তাছাড়া সম্প্রতি জাতীয় সংসদে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) যে সংশোধনী সংসদে পাস হয়েছে তার মাধ্যমে কমিশনকে আরো দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। কমিশন এখন আর ভোটগ্রহণের দিনের আগে নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না। এছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও পুরো আসনের (সংসদীয়) ফলাফল স্থগিত বা ভোট বাতিল করতে পারবে না ইসি। শুধু যেসব ভোট কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ থাকবে, সেসব ভোট কেন্দ্রের ফলাফল চাইলে স্থগিত করতে পারবে ইসি। 

পরিশেষে, গত দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে সংসদকে বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে ভবিষ্যতের নির্বাচনও অগ্রহণযোগ্য হতে পারে এবং এর ফলে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চরম হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক তথা গ্রহণযোগ্য করতে হলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তোলা আজ জরুরি। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে যা থাকতে পারে তা হলো: ১. নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে ঐকমত্য, ২. সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার, ৩. জাতীয় সংসদ, নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা, কার্যকারিতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, ৪. আইনের শাসন নিশ্চিত করা ও মানবাধিকার সংরক্ষণ, ৫. রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এবং একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন।

(নিবন্ধটি ২৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে বণিকবার্তায় প্রকাশিত হয়েছিল। লিংক: https://bonikbarta.net/print-news/351912)

(বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে সংগ্রহ করুন নেসার আমিনের লেখা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ও ফলাফল’। ৯২৮ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। প্রচ্ছদ মূল্য: ৩,২০০ টাকা। লিংক: www.rokomari.com/book/331587/bangladesher-nirbachoni-bebostha-o-folafol)

Leave a Reply

Your email address will not be published.