বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোন পেশার লোকজনের আধিপত্য?

আপনাদের অনেকেরই মনে আছে, ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছিলেন, ‘আমাদের গ্রামে প্রবাদ আছে—গরিবের বউ নাকি সবারই ভাউজ (ভাবি)। রাজনীতিও হয়ে গেছে গরিবের বউয়ের মতো। যে কেউ যেকোনো সময় ঢুকে পড়তে পারেন, বাধা নেই।’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে তাকালে এ কথা অস্বীকার করার অবকাশ নেই। কারণ আমাদের রাজনীতি আজ বহুলাংশে (অ)রাজনীতিবিদদের করায়ত্তে। আরো ভেঙে বললে, আমাদের রাজনীতির নাটাই আজ বলতে গেলে ব্যবসায়ীদের হাতে।

বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৩৫ সাল অবধি পৌরসভা, স্থানীয় পর্যায়ের কমিটি ও বোর্ডে নির্বাচিত ও মনোনীত উভয় ক্ষেত্রেই জমিদারদের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। এমনকি ১৯৩৭ সালের নির্বাচনেও তাদের প্রভাব বজায় ছিল। এরপর নির্বাচনের ইতিহাসে রাজনৈতিক মেরুকরণের ধারা লক্ষ করা যায়। ১৯২০ সাল পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন ছাড়াই প্রার্থীরা ব্যক্তিগত ও স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। এমনকি ১৯৩৭ সালের বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচন দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। ২৫০ আসনের মধ্যে ৮১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন। পরবর্তী দশকে অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিরঙ্কুশভাবে পরাজিত করে। প্রায় ৩০০ প্রার্থী স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তাদের মধ্যে মাত্র আটজন নির্বাচিত হন। এভাবেই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনের যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। 

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর হিন্দুদের ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ, জমিদারি প্রথার বিলোপ এবং ১৯৫৬ সালে সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিধান প্রবর্তনের ফলে বিভাগপূর্ব নির্বাচন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ ও জেলা বোর্ড নির্বাচনে তুলনামূলকভাবে নবীন ও অনাবাসিক আইনজীবীরা প্রাধান্য বিস্তার করেন। ’৫৪-এর পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনের পর সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব মাত্র ৪ শতাংশ। কিন্তু ষাট ও সত্তরের দশকে এ প্রক্রিয়ার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে এবং তখন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে পেশাদার রাজনীতিক ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতার বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করে। 

’৫৪-এর সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব মাত্র ৪ শতাংশ হলেও ১৯৭৩ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১৩ শতাংশ, ১৯৭৯ সালে ৩৪ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৪৮, ২০০১ সালে ৫১ ও ২০০৮ সালে ৬৩ শতাংশ। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা দেখেছি, সুজনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী ৫৪৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বেশির পেশা ছিল (৫২ দশমিক ৩ শতাংশ বা ২৮৪ জন) ব্যবসা। আর নির্বাচিত ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে অধিকাংশই (১৭৫ জন বা ৫০ শতাংশ) ব্যবসায়ী।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী মোট ১ হাজার ৮৪৮ জন প্রার্থীর পেশা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৫৩ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রার্থীর পেশা ব্যবসা। এছাড়া আইন পেশায় ৮ দশমিক ৯৮, কৃষিতে ৬ দশমিক ৯৩, চাকরিতে ১৬ দশমিক ৪৫, গৃহিণী শূন্য দশমিক ৯২ ও অন্যান্য পেশায় যুক্ত আছেন ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রার্থী। অন্যান্য পেশার মধ্যে শিক্ষক, রাজনীতিক, সমাজসেবক, চিকিৎসক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা ইত্যাদি পেশা উল্লেখযোগ্য। পেশাগত বিশ্লেষণে প্রায় সব দলেই ব্যবসায়ী প্রার্থীর আধিক্য লক্ষ করা যায়। সুজনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ওই নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই (৬১ দশমিক ৭ শতাংশ) পেশায় ব্যবসায়ী।

উল্লেখ্য, পেশায় ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও অনেকে তাদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেয়া হলফনামায় ব্যবসার পরিবর্তে অন্য কিছুকে পেশা হিসেবে ঘোষণা দেন। এছাড়া কেউ কেউ সংসদ সদস্য হওয়ার পর ব্যবসায়ী হয়ে যান। আমাদের জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের অধিক্যের কারণে এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের বর্ধিত অংশ বলে অনেকে আখ্যায়িত করেন।

রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রবেশে কেন এমন ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি? এর অন্যতম কারণ হলো, আমাদের দেশে রাজনীতিই ক্রমাগতভাবে ব্যবসায়ে পরিণত হয়ে গেছে এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো হয়ে পড়েছে বহুলাংশে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটে। সংসদ সদস্য হতে আগ্রহীরা কোটি কোটি টাকা ‘বিনিয়োগ’ করেন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর তার বহুগুণ কামাই করেন তাদের পদ-পদবিকে কাজে লাগিয়ে। আমাদের বর্তমান ও নিকট অতীতের সংসদ সদস্যদের অনেককেই মাত্র পাঁচ বছরের মেয়াদকালেই বিরাট অর্থ-বিত্তের মালিক হতে দেখা গেছে। 

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের ভাষায়, ‘রাজনীতি আর এখন জনসেবা নয়—এটি এখন অনেকটাই ব্যক্তি-গোষ্ঠী-কোটারি সেবার উত্তম উপায়। অতীতের ত্যাগী নেতাদের অনেকেই এখন রাজনীতি থেকে হয় বিতাড়িত হয়েছেন, না হয় নিজেরাও রাজনৈতিক ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছেন। ‘গ্রেসামস ল’ আমাদের রাজনীতিতেও কাজ করছে—খারাপ রাজনীতিবিদরা ভালো রাজনীতিবিদদের ক্রমাগতভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিতাড়িত করছেন। এ প্রক্রিয়ায় রাজনীতি হয়ে পড়েছে বহুলাংশে নীতি-আদর্শ বিবর্জিত একটি স্বার্থান্বেষী কার্যক্রম। বস্তুত আমাদের দেশে আদর্শিক রাজনীতির মৃত্যু ঘটেছে।’ তাই তো রাজনীতিতে যুক্ত হতে ব্যবসায়ীরা, বিশেষত কালো টাকার মালিক ব্যবসায়ীরা উন্মুখ হয়ে থাকেন। কারণ রাজনৈতিক মুখোশ পরলে অতিসহজেই কালো টাকা সাদা করা যায়।

রাজনীতি ক্রমাগতভাবে ব্যবসায়ে পরিণত হওয়ার এবং রাজনীতিতে অধিক হারে ব্যবসায়ীদের প্রবেশের কারণে আমাদের দেশে শুধু রাজনীতির ব্যবসায়ীকরণই হয়নি, ব্যবসায়েরও রাজনীতিকরণ হয়েছে। ফলে রাজনীতি এবং ব্যবসা কোনোটাই সঠিকভাবে চলছে না। এ প্রক্রিয়ায় আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমাগতভাবে কলুষিত হয়েছে। একইভাবে আমাদের জাতীয় সংসদ হয়ে পড়েছে বহুলাংশে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। আমাদের নীতিনির্ধারণও হয়ে পড়েছে ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত, যার মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের এবং অন্য অনেক শ্রেণীর স্বার্থহানি হয়।

রাজনীতিতে নগ্ন টাকার খেলা আমাদের কলুষিত রাজনীতিরই ফসল। বর্তমানে মনোনয়ন বাণিজ্য আমাদের দেশে একটি বিরাট সমস্যা। শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও এখন মনোনয়ন বাণিজ্য অনুপ্রবেশ করেছে। আর টাকার খেলা সহিংসতার জন্ম দেয়, যা তরুণ ও নারীদের রাজনীতি বিমুখ করে। আর আমাদের গণতন্ত্র আজ হয়ে পড়েছে ‘বেস্ট ডেমোক্রেসি মানি ক্যান বাই’ (টাকা দিয়ে কেনা যায় এমন উন্নত গণতন্ত্র), যা কোনো গণতন্ত্রই নয়।

রাজনীতিতে নগ্ন টাকার খেলার ফলে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার থাকলেও তারা প্রতিনিধিত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত। অর্থাৎ আমাদের সাধারণ নাগরিকরা জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচনে ভোট দিতে পারলেও তাদের পক্ষে এখন সংসদ সদস্য হওয়ার পথ পরিপূর্ণভাবে রুদ্ধ। ফলে এখন গণতন্ত্রের সেই কালজয়ী সংজ্ঞা ‘গভমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল এবং ফর দ্য পিপল’-এর (জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য সরকারের) ধারণা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে। ‘সিটিজেন লেজিসলেটর’-এর নাগরিক প্রতিনিধির কথা আর আমরা কল্পনাও করতে পারি না।

আমরা মনে করি, ব্যবসায়ীদেরও রাজনীতিতে প্রবেশ করা ও সংসদ সদস্য হওয়ার অধিকার আছে। তবে সেই অধিকার প্রয়োগ হতে হবে ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির পরিবর্তে জনকল্যাণের লক্ষ্যে। আর জাতীয় সংসদ হতে হবে সমাজের সব ক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্বের সমন্বয়ে, শুধু ব্যবসায়ীদের নিয়ে নয়, যাতে রাষ্ট্র পরিচালনায় ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে সব নাগরিকের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।

আমরা রাজনীতিতে নতুনদের প্রবেশেরও বিপক্ষে নই। আমরা মনে করি, রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করার জন্য রাজনীতির শিরা-উপশিরায় নতুন রক্ত সঞ্চালন করা দরকার। আর নতুনদের প্রবেশাধিকার প্রদানের মাধ্যমেই তা নিশ্চিত করা যাবে। 

তথ্যসূত্র: বণিক বার্তা, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

লিংক: https://bonikbarta.net/home/news_description/352911/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%A8-%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%95%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF?)

Leave a Reply

Your email address will not be published.