বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা: বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়


স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করছে বাংলাদেশ। এ সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও রাষ্ট্র আকারে আমাদের সার্বিক অর্জন অনেক ক্ষেত্রেই আশাপ্রদ। এ সময় দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে, বেড়েছে মাথাপিছু আয়, দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে মানব উন্নয়ন সূচকে। বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রায় সাত শতাংশ। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ নাম লিখিয়েছে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায়। তাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও বাড়িয়ে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়োজন জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে বাংলাদেশ কি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের দিকে এগুচ্ছে?

বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ইভিনিং পিক টাইমে গড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। এর বিপরীতে গড়ে উৎপাদন হচ্ছে ১১ হাজার মেগাওয়াটের মতো। উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল তারিখে দেশে রেকর্ড সর্বোচ্চ ১৪,৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২২ অক্টোবর ২০২২ তারিখে ইভিনিং পিক টাইমে ১২,৯৫২ মেগাওয়াট চাহিদা বিপরীতে এ দিন সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১২,৩১৮ মেগাওয়াট। পাওয়ার ডিভিশনের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা ২৫,৭৩০ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ), যদিও পিডিবির ওয়েবসাইটে উৎপাদন সক্ষমতা (ইন্সটল্ড ক্যাপাসিটি) দেখানো হয়েছে ২২,৫১২ মেগাওয়াট।

উপরোক্ত তথ্যানুযায়ী সক্ষমতা থাকলেও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবাহর করতে পারছে না সরকার। এক্ষেত্রে সরকারের ভাষ্য হলো জ্বালানি সাশ্রয়, তথা এ খাতে ভর্তুকী কমানো, তথা ডলার সাশ্রয়, তথা আমদানি ব্যয় কমিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ধরে রাখা। এ লক্ষ্যে সরকার গত ১৯ জুলাই থেকে দেশে পরিকল্পিত লোডশেডিং শুরু করে। প্রথমে দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কথা বলা হয়েছিল, যদিও তা পুরোপুরি মানা হয়নি। গত সেপ্টেম্বর মাসে ধীরে ধীরে হলেও লোডশেডিংয়ের মাত্রা কমে আসছিল। তখন বলা হয়েছিল অক্টোবর থেকে দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের পরিমাণ কমে আসবে। কিন্তু লোডশেডিং কমেনি, বরং ক্রমেই বেড়েই চলেছে।

পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান-২০১০ অনুযায়ী বছরভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা
সাল/বছর পিক চাহিদা (মেগাওয়াট)
২০১০ ৬,৪৫৪
২০১৫ ১০,২৮৩
২০১৮ ১৪,০১৪
২০২০ ১৭,৩০৪
২০২৩ ২১,৯৯৩
২০২৫ ২৫,১৯৯
২০২৮ ৩০,১৩৪
২০৩০ ৩৩,৭০৮

উল্লেখ্য, পিএসএমপি-২০১৬ ও চলমান বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সালে বিদ্যুতের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ চাহিদা হবে ১৯,৯০০ মেগাওয়াট, এর বিপরীতে সম্ভাব্য নেট উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৩২,৯৩৩ মেগাওয়াট।

গ্রিডভিত্তিক বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা (জ্বালানি অনুযায়ী)
জ্বালানির বিবরণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা (টি) স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা (মেগাওয়াট) শতকরা হার বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা (মেগাওয়াট) শতকরা হার
কয়লা ৩ ১,৭৬৮ ৮% ১,৬৮৮ ৮%
প্রাকৃতিক গ্যাস ৬৭ ১১,৪৭৬ ৫২% ১১,১৬২ ৫১%
ফার্নেস অয়েল ৬৪ ৬,৩২৯ ২৮% ৫,৯২৫ ২৭%
ডিজেল ১০ ১,২৯০ ৬% ১,২৮৬ ৬%
হাইড্রো ১ ২৩০ ১% ২৩০ ১%
অন-গ্রিড সৌর ৯ ২৫৯ ১% ২৫৯ ১%
বিদ্যুৎ আমদানি ১,১৬০ ৫% ১,১৬০ ৫%
সর্বমোট/ঞড়ঃধষ ১৫৪ ২২,২৫২ ২১,৭১০
তথ্যসূত্র: পিডিবি’র ওয়েবসাইট

গ্রিডভিত্তিক বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা (মালিকানা অনুযায়ী)
খাত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা (টি) স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা (মেগাওয়াট) শতকরা হার বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা (মেগাওয়াট) শতকরা হার
সরকারি ৫৮ ১০,১৩০ ৪৫% ৯,৭৬০ ৪৫%
যৌথ উদ্যোগ ১ ১,২৪৪ ৬% ১২৪৪ ৬%
বেসরকারি ৯৫ ৯,৯৭৮ ৪৪% ৯৫৪৬ ৪৪%
বিদ্যুৎ আমদানি ১,১৬০ ৫% ১,১৬০ ৫%
সর্বমোট/ঞড়ঃধষ ১৫৪ ২২,২৫২ ২১,৭১০
তথ্যসূত্র: পিডিবি’র ওয়েবসাইট

আমরা যদি একটু পেছনে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব যে ২০০৯ সালে যখন দেশের ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার, তখন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল মাত্র ৪,৯৪২ মেগাওয়াট। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার পাঁচ বছরে (২০০১-০৬ সাল) সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বিদ্যুতের নতুন উৎপাদন ক্ষমতা যোগ করেছিল মাত্র ১,১৮৫ মেগাওয়াট। মূলত প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতে না পারা এবং সিদ্ধান্তহীনতাই ছিল সে সরকারের অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারার কারণ। এ বিষয়ে বর্তমান নিবন্ধের লেখকের সঙ্গে আলাপকালে সে সময়কার বিদ্যুৎ সচিব আ.ন.হ আখতার হোসেন বলেন, ‘প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবেই তখন বিদ্যুতের মোট উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়নি। তাছাড়া জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পূর্বে যেসব প্রকল্পগুলো আর্থিকভাবে চূড়ান্ত করে গেছে তার বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পরবর্তীতে চালিয়ে নেয়া হয়নি।’

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ অঙ্গীকার করেছিল যে, তারা ক্ষমতায় আসলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২০১৩ সালের মধ্যে ৭,০০০ মেগাওয়াট ও ২০২১ সালের মধ্যে ২০,০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করবেন। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথে কোনো ধরনের অগ্রগতি ছাড়া কেটে যায় মহাজোট সরকারের প্রথম বছর। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ৫ দিন আগে অর্থাৎ ২০০৮ সালের শেষদিন ৩১ ডিসেম্বর সান্ধ্য পিক আওয়ারে বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ৩,৮৮২ মেগাওয়াট। আর এক বছরের ব্যবধানে ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে সান্ধ্যকালীন পিক আওয়ারে উৎপাদন নেমে আসে ৩,৬৯০ মেগাওয়াটে।

এরপর বিদ্যুৎ সংকট সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার কথা বলে ২০১০ সালের শুরুর দিক থেকে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে সরকার; আর এই চুক্তির পুরো প্রক্রিয়া শেষ হয় অনিয়মতান্ত্রিকভাবে Ñ অনেক ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই এবং অস্বাভাবিক তাড়াহুড়া করে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নতুন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা ভাড়াভিত্তিক কোম্পানিগুলোকে ডিজেলে ১০ টাকা আর ফার্নেস তেলে ৭ টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ডিজেল ও ফার্নেস তেলে নতুন ভাড়াভিত্তিক কোম্পানিগুলো থেকে সরকার প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ কিনে যথাক্রমে ১৪ ও ৮ টাকায়। অর্থাৎ ভাড়ার এসব প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ পড়ছে সরকারিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় সাত গুণ।

যেহেতু দরপত্র ছাড়াই এবং অস্বাভাবিক তাড়াহুড়া করে এসব প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়, তাই ভবিষ্যতের অভিযোগকে পাশ কাটানো তথা দায়মুক্তি দেয়ার জন্য সরকার ৩ অক্টোবর ২০১০ সরকার সংসদে পাশ করে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) বিল-২০১০’। এ আইনটি প্রণয়নে সরকারের ভাষ্য ছিল, দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকট যে আকার ধারণ করেছে, তাতে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জরুরি ছিল এ ধরনের একটি আইন করা। এই আইনের মাধ্যমে দরপত্রের ঝামেলা এড়ানো এবং ভাড়ার কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে সময় কমিয়ে আনা যাবে। অথচ এ আইন প্রণয়ন ছাড়াই সরকার দরপত্রের দীর্ঘসূত্রতা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় জরুরি বিবেচনায় মালয়েশিয়ার মত একই ধরনের উদ্যোগ নিতে পারত। মালয়েশিয়ায় সব সাংবাদিক, ঠিকাদার, বিতরণকারী এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ডেকে প্রকাশ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দামের প্রস্তাব করা হয়। যারা সবচেয়ে কম দামে রাজি হতো, তাদেরকে কাজ দেয়া হতো। এভাবে করলে দরপত্রের দীর্ঘসূত্রতা বা দুর্নীতির সুযোগ কম থাকে।

এ বিষয়ে বর্তমান নিবন্ধের লেখকের সঙ্গে আলাপকালে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পাওয়ার সেল-এর সাবেক মহাপরিচালক বি.ডি. রহমতুল্লাহ বলেন, ‘গ্রাহকদের স্বার্থে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ আসেনি। কিছু উচ্চাভিলাষী ব্যবসায়ীদের স্বার্থে এসেছে। এ ধরনের বিদ্যুৎ হয় সাধারণত যুদ্ধাবস্থায়, যেখানে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম এই ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে। ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে মার্কিন বেসরকারি কিছু কোম্পানি জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। এরকম পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় বলে উৎপাদন খরচের সঙ্গে ঝুঁকি যোগ করে, এবং বাজার মূল্যের চেয়ে সাত-আট গুণ দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করে।’

মহাজোট সরকার পরবর্তীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান ২০১০’ প্রণয়ন করে। এ পরিকল্পনায় দেশের সব মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনার জন্য স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকার। সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, যেমন পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি), রেন্টাল পাওয়ার প্রডিউসার (আরপিপি) ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্লান্ট (আইপিপি) নির্মাণকে উৎসাহিত করার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেশীয় এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কয়লার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য রামপালের মতো বড় এবং আরও কিছু ছোট আকারের কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করে এবং বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রায় ৪,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সরকার রাশিয়ার সাথে পাবনার রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন চুক্তি স্বাক্ষর করে।

সরকারের এসব পরিকল্পনার অনেকগুলোই বাস্তবায়িত হয়েছে। এরফলে বেড়েছে উৎপাদন সক্ষমতা। দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সেবার আওতায় এসেছে। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারিকরণের কারণে বেড়েছে এ খাতে ভুর্তকির হার এবং উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে গ্রাহক পর্যায়ে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। পিডিবির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগে পিডিবি বছরে যে পরিমাণ লোকসান গুণত, এখন এক মাসেই তার কাছাকাছি পরিমাণ লোকসান হচ্ছে। বিগত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার মোট যা লোকসান করেছে, শুধু আগামী দু বছরেরই তার চেয়ে বেশি লোকসান করবে (মূলত ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে, পাশাপাশি আছে জ্বালানি মূল্যের কারণে)। আমরা জানি, বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের একটা বড় অংশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের। তারা সরকারের কাছে এখনই চার বিলিয়ন ডলার ক্যাপাসিটি চার্জের বকেয়া পায়, আগামী এক বছরে পাবে আরও ৫-৬ বিলিয়ন ডলার।

সরকার এখন উচ্চমূল্যে জ্বালানি তেল না কিনে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কথা বলছে। সরকার বলছে করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বেড়েছে এবং ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ হতে পারে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সরকার মূলত আমদানি কমিয়ে রিজার্ভ ধরে রাখার জন্য এমনটা বলছে। কারণ আমরা জানি, আন্তর্জাতিক বাজারে যুদ্ধের কারণে তেলের দাম বেড়েছে গড়ে ১২-১৫ শতাংশ, অথচ বাংলাদেশে বেড়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। তাছাড়া বাংলাদেশ রাশিয়া বা ইউক্রেন থেকে তেল কিনে না। সরকার তেল কিনে ওপেন (স্পট) মার্কেট থেকে। বাস্তবতা হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দাম বেড়েছে সেখানে। কিন্তু দলীয় লোকদের কমিশন সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সরকার তো জেনে বুঝেই জিটুজি (রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি) জ্বালানি আমদানি না করে ওপেন মার্কেটে গিয়েছে। কিন্তু সরকার সে দায় নিচ্ছে না। সরকার টেকসই ও সার্বভৌম জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত তৈরির পদক্ষেপ নেয়নি। অভ্যন্তরীণ গ্যাস কূপ সংস্কার করেনি, গ্যাস ফিল্ড সংস্কারের ফাইল টেবিলেই রেখে দিয়েছে, সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান করেনি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। এসব না করে বরং সরকার এখন জনগণকে দুর্ভিক্ষের ভয় দেখাচ্ছে, তাদেরকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হতে বলছে।

বর্তমান নিবন্ধের লেখকের সঙ্গে আলাপকালে ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির’ সদস্য সচিব ড. আনু মুহাম্মদ বলেছিলেন, ‘বিদ্যুৎ যেহেতু একটি স্পর্শকাতর বিষয়, তাই একে এভাবে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো।’

আমরাও তাই মনে করি, বিদ্যুৎ ও খাতের ওপর জাতীয় সক্ষমতা তৈরি করা দরকার, দরকার এ খাতের নির্মোহ পর্যালোচনা, জনবান্ধব, স্বচ্ছ ও সাশ্রয়ী নীতি প্রণয়ন। আর না হলে আমরা আমাদের জ্বালানি সম্পদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাব না, এ খাতকে টেকসই ভিতের ওপর দাঁড় করাতে পারবো না।

(নিবন্ধটি র আ ম উবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী সম্পাদিত ‘মত ও পথ’ পত্রিকার ২০২২ সালের অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল)

Leave a Reply

Your email address will not be published.