বিদ্যুৎ উৎপাদনে মহাজোট সরকারের উদ্যোগ ও বাস্তবতা

বর্তমানে দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষ মাথাপিছু গড়ে ১৪০ ইউনিট বিদ্যুৎ ভোগ করছে। এমন এক পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের প্রাক্কালে জনগণের কাছে মহাজোট প্রতিশ্র“তি প্রদান করেছিল যে, তারা ২০১১ সালের মধ্যে ৫ হাজার মেগাওয়াট, ২০১৩ সালের মধ্যে ৭ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০২১ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। কিন্তু গত প্রায় দেড় বছরেও এ লক্ষ্যে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। গুরুতর একটি জাতীয় সঙ্কট মোকাবিলায় সুনির্দিষ্টভাবে প্রাথমিক ধরনের কিছু ফলাফল হাতেনাতে তুলে দেয়ার জন্য একটি সদিচ্ছাসম্পন্ন দক্ষ সরকারের জন্য ১৫ মাস মোটেও খুব কম সময় নয়। কিন্তু সঙ্কটের তীব্রতা কমে আসার কোনো প্রক্রিয়া এখনো জনগণের সামনে দৃষ্টিগোচর হয়নি।

বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য বর্তমান সরকারও যথারীতি বিগত সরকারের কার্যক্রমকে দায়ী করছে। সরকার বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। চাহিদা ও সরবরাহ নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা নেই, দেশীয় পর্যাপ্ত দক্ষ লোক থাকা সত্ত্বেও বিদেশি পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে অর্থের অপচয়, আর্থিক সুবিধা গ্রহণের উদ্দেশ্যে বিতরণ লাইনের ভারসাম্যহীন বিস্তার, পিএমএমপির লঙ্ঘন, প্ল্যান্টের আকার, প্রকৃতি ও স্থান নির্ধারণ নিয়ে রাজনীতিকরণ করা ছাড়াও বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়, প্ল্যান্ট স্থাপনে নিম্নমানের যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং দুর্নীতি সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ খাতকে ধ্বংস করেছে।

লোডশেডিং মুক্ত দেশ গড়তে বর্তমান সরকার যে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে তা সময়মতো বাস্তবায়ন নিশ্চিত নয়। বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির সংকটও হয়ে উঠেছে তীব্র। এ অবস্থায় সরকার যে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে লোডশেডিংমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে, সে বিষয়েও সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের পর থেকে দেশে কোনো লোডশেডিং হবে না। এই সময়ের মধ্যে ৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে, যার জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকা। মহাপরিকল্পনায় বছরভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, চলতি বছর চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে পার্থক্য অর্থাৎ ঘাটতি ১ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। ২০১০ সালে ঘাটতি হবে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট, ২০১১ সালে ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট, ২০১২ সালে ১ হাজার ৮৫০ মেগাওয়াট, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট এবং ২০১৪ সালে ঘাটতি হবে ১ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। কিন্তু যদি গ্যাস না পাওয়া যায় তাহলে ২০১৪ সালে বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ হাজার মেগাওয়াট।

সরকার নতুন কেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়েরও বড় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সে অনুযায়ী দুটি পর্যায়ে সারা দেশের গ্রাহকদের মধ্যে বিনামূল্যে মোট দুই কোটি ৬৫ লাখ বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাল্ব বিতরণ করা হবে। এতে প্রায় ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে বলে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে।

জরুরি ভিত্তিতে ঘাটতি মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের প্রথম পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ হলো বেসরকারি খাতে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন। যদিও বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ই এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার কয়েকটি ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপও নেয়। তা সত্ত্বেও সরকার জরুরি ভিত্তিতে মোট ৫৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটি ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে এবং তা করেছে ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় নয় মাস পর। ইতোমধ্যে সেচ মৌসুম কাছে চলে আসায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়Ñ চার মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য ডিজেলচালিত কয়েকটি ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। বাকিগুলো হবে ফার্নেস তেলচালিত। ডিজেলচালিত কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে প্রায় ১৫ টাকা, যা ফার্নেস তেলচালিত কেন্দ্রের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য ওই সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও চলতি সেচ মৌসুমে এর এক ইউনিট বিদ্যুৎও পাওয়া যাচ্ছে না। দেশীয় উদ্যোক্তারা মনে করছেন, বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ দ্রুত না করে সরকার বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় ভাড়াভিত্তিক ছোট ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর যে পরিকল্পনা করছে তাতে বিদ্যুত সমস্যা কাটবে না। দেশীয় প্রযুক্তিনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে বর্তমান সংকটের সমাধান সম্ভব। অন্যথায় এ সংকট আরও বাড়বে।

শেষকথা, বাংলাদেশে বর্তমানে যে বিদ্যুৎ সংকট তৈরি হয়েছে তার কারণ হলো- বাংলাদেশে কখনোই সমন্বিত এনার্জি পরিকল্পনা বা কম্প্রিহেনসিভ এনার্জি পরিকল্পনা বা জ্বালানি নিরাপত্তা বা উন্নয়ন পরিকল্পনা নেয়া বা প্রণয়ন করা হয়নি। এ পর্যন্ত যা হয়েছে তা বিচ্ছিন্নভাবে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও জ্বালানি বিভাগের কাজের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তাই বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের কাছাকাছি। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা না হলে ৭ শতাংশে চলে যেত। তাই প্রবৃদ্ধির এই হার ধরে রাখতে হলে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

আজ পর্যন্ত বিদ্যুৎ মজুদ করে রাখার কোনো পন্থা বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেননি। অদূর ভবিষ্যতেও এ ধরনের কোনো পন্থা আবিষ্কারের সুযোগ নেই। তাই যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, তাই যোগান দেয়া হয়। অন্যদিকে চাহিদা এবং উৎপাদনের মধ্যে ব্যবধান যতো বেশি, লোডশেডিংয়ের পরিমাণও ততো বেশি। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে উৎপাদন না বাড়ায় লোডশেডিং বাড়ছে। তাই এ সংকটের সমাধান করতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

চিন্তা, ২৫ এপ্রিল ২০১০

বি:দ্র: পিডিবির ওয়েবসাইট অনুযাী বর্তমানে (০১-০৬-২০১৫) পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৬৩৩৮ মেগাওয়াট, অপপিক আওয়ারে ৭৭৮২ মেগাওয়াট।

Leave a Reply

Your email address will not be published.