ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিনিময়: আশঙ্কার কতিপয় দিক

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সে দেশ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে তা নিজ দেশের মাটিতে করলে বিদ্যুতের উৎপাদন ও সাশ্রয় অনেক বেশি হতো বলে অনেকই মনে করেন। তারা মনে করেন, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিমাণ যখন তিন হাজার মেগাওয়াট কিংবা তারচেয়েও বেশি তখন ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে বিরাজমান সমস্যার খুব একটা সমাধান হবে না। বাংলাদেশ সরকার ভারত থেকে শুধু বিদ্যুৎ আমদানি করার কথাই বলছে না, বাংলাদেশও ভারতকে বিদ্যুৎ আমদানির সুযোগ দেবে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে ভারত থেকে বিদ্যুৎ কেনা বাংলাদেশের জন্য তখনই সম্ভব হবে যদি বাংলাদেশ বিনিময়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎ রফতানি করতে রাজি হয়। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশ শুধুই ঠকে যেতে পারে। ভারত অল্প পরিমাণ বিদ্যুৎ রফতানি করে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের গ্রিডলাইন ব্যবহার করে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে কানেকটিভিটি নিতে চায়।

ভারতের অনেক শহর রয়েছে যেখানে নিয়মিত বিদ্যুৎ নেই। এর ওপর দেশটিতে শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটছে, উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের পাওয়ার ট্যারিফ বেশি। এ অবস্থায় ভারত বাংলাদেশের মূল্যে কোন যুক্তিতে বিদ্যুৎ বিক্রি করবে তা স্পষ্ট নয়।

ভারত বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ রফতানি করে শুধু বেশি দামই আদায় করবে না, তার সঙ্গে অনেক বেশি ফায়দা তুলে নিতে পারে। ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, মনিপুরে ২০২০ সালের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যাচ্ছে।

আঞ্চলিকভাবে এই বিদ্যুতের ১০ থেকে ২০ শতাংশের বেশি চাহিদা উত্তর-পূর্ব ভারতে নেই। ভারত এই অঞ্চলে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় শিল্পোন্নত রাজ্যগুলোতে নিতে চাচ্ছে। ভারতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও বেশি, যে কারণে তার নিজস্ব বিদ্যুৎ চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে। কিন্তু উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ পশ্চিমাঞ্চলে সরবরাহ করতে হলে যে ট্রান্সমিশন লাইন এবং সংযোগ প্লান্ট করতে হবে তা বাংলাদেশের মধ্য দিয়েই করতে হবে। সঙ্কীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরে সেটা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ যদি ভারতকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করে তাহলে সেটা হবে ভারতকে কার্যত বিদ্যুৎ করিডোর দেয়া। এই বিদ্যুৎ করিডোর পেলে ভারতের জন্য কত বড় পাওয়া হবে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। ভারতকে এই সুযোগটি দেয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কোনো প্রকার ভাড়া দাবি করছে কি? এটা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের বিষয়। এর পাশাপাশি কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ যদি কখনও বর্তমানে অনুসৃত দিল্লিমুখী পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন ঘটায় তাহলে ভারতের আচরণ কী হবে? সেক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ বঞ্চিত করে জিম্মি করে ফেলতে পারে বলেও অনেকে মনে করেন।

এদিকে ভারতের সঙ্গে আসন্ন বিদ্যুৎ বিনিময় চুক্তির বিভিন্ন দিক ও ভারত কর্তৃক অতীতে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তি লঙ্ঘনের উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের ন্যাশনাল গ্রিডকে ভারত ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যেই এগোচ্ছে। সাবেক বিদ্যুৎ সচিব আ.ন.হ. আখতার হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের অতীত চুক্তির রেকর্ডগুলো ভালো নয়। বিভিন্ন বিষয়ে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের যত চুক্তি হয়েছে তার সবই ভারত ভঙ্গ করেছে। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করার ব্যাপারে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। ভারতের সীমান্ত এলাকা বহরমপুর, জলপাইগুড়ি ও বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, জলপাইগুড়ি এলাকা নির্ধারণ করে ভারতের সঙ্গে চুক্তি হলে বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটান থেকেও বিদ্যুৎ আমদানির সুযোগ পাবে। এজন্য বাংলাদেশকে চুক্তি করতে হলে ওই বিষয়টিও উল্লেখ করা দরকার। কিন্তু জলপাইগুড়ি বাদ দিয়ে ভারত বরাবরই বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা দিয়ে বিদ্যুৎ রফতানির ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।’ তিনি বলেন, ‘ভারত আগামী ২০২০ সালের মধ্যে তাদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে হাইড্রোলিক পাওয়ার প্লান্টসহ বিভিন্ন প্লান্টের মাধ্যমে কম খরচে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। উৎপাদিত বিদ্যুতের ২০ ভাগও তাদের ওইসব অঞ্চলে চাহিদা নেই। ফলে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ তারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তাদের পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে নিতে আগ্রহী। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিনিময় চুক্তির উদ্দেশ্য যদি এটাই হয় তাহলে ভারত বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করবে। এ থেকে বাংলাদেশ কোনো সুবিধা পাবে না।’

ভারতের প্রতিশ্র“ত ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশকে ২০১২ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর এই বিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হবে এক হাজার এক শ’ কোটি টাকা। বিদ্যুতের দাম পড়বে ইউনিট প্রতি পাঁচ টাকার ওপরে। এছাড়া ভারতীয় সহায়তায় খুলনায় একটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারেও সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলেও এর নিয়ন্ত্রণ থাকবে ভারতের হাতে। এ কেন্দ্র স্থাপনে তিন বছর সময় লাগবে।

এই বিদ্যুৎ আমদানির জন্য আগামী দু বছরের মধ্যে এক আন্তঃদেশীয় গ্রিড লাইন স্থাপন করতে হবে। ভারতের বহরমপুর থেকে বাংলাদেশের ভেড়ামারায় ১৩০ কিলোমিটারের এই গ্রিড লাইনটি হবে। বাংলাদেশের অংশে ৪৫ কিলোমিটার ও ভারতের অংশে ৮৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন হবে। দু দেশের সঞ্চালন ব্যবস্থার পার্থক্যের কারণে বাংলাদেশের ভেড়ামারায় একটি বিশেষ সাব-স্টেশন স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশের ৪৫ কিলোমিটার অংশে বিদ্যুৎ লাইন স্থাপনে ব্যয় হবে এক হাজার এক শ’ কোটি টাকা, আর ভারতের ৮৫ কিলোমিটার অংশের ব্যয় হবে দু শ’ কোটি টাকা।

তবে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির অর্থ এটা নয় যে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি এ আমদানির মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা সম্ভব। কারণ, অনেক বিদ্যুৎ জোনেই বিদ্যুতের চাহিদা এককভাবে দু শ’ মেগাওয়াট বা তার কাছাকাছি। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ময়মনসিংহে ২০০ মেগাওয়াট, সিলেট জোনে ১৯৮ মেগাওয়াট এবং রংপুর জোনে ৭৫ মেগাওয়াট বিদুতের চাহিদা রয়েছে। সুতরাং এ চুক্তি বাংলাদেশের অনুকূলে নয়। তাই প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিনিময়ের ব্যাপারটি যত সহজ মনে হয় ততটা সহজ বা স্বাভাবিক নয়।

রাজনৈতিক ডটকম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১০

Leave a Reply

Your email address will not be published.