জাতীয় মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় জ্বালানি সংকটের সমাধান

জ্বালানি খাতে বাংলাদেশে চলমান চরম উৎপাদন সংকটের সময় চলছে এখন। সেই প্রেক্ষিতে সরকার স্বল্পমেয়াদি ‘ভাড়া বিদ্যুৎ’ কিংবা দীর্ঘমেয়াদি ‘পারমাণবিক বিদ্যুৎ’ এর মত উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু সরকারের এসব উদ্যোগের বিরোধিতা করছে ‘তেল-গ্যাস খনিজ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’। এ কমিটি সদস্য সচিব ড. আনু মুহাম্মদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁদের এই বিরোধিতার পেছনের যুক্তি ও ন্যায্যতা।

তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম- পারমাণবিক  বিদ্যুৎ কেন্দ্র না করে যদি বাপেক্স ও পেট্রোবাংলার মত জাতীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে জ্বালানি খাতের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়, তবে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তারা বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে পারবে? এই প্রতিষ্ঠানগুলোর যে কারিগরি ও বিশেষজ্ঞ দক্ষতা থাকা দরকার তা কি আছে? এছাড়া প্রতিবছর যেখানে বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্গে যোগানের তারতম্য পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, শিল্পায়নের গতি বাড়ার কারণে প্রতি বছর বিদ্যুতের ঘাটতিও পাল্লা দিয়ে বাড়বে, সেক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কি? থাকলে সেটা কীভাবে সম্ভব? ‘তেল-গ্যাস খনিজ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ কি এ সম্পর্কে জাতির সামনে কোনো এমপিরিকাল স্টাডি দিতে পারবে?

উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়ার মাধ্যমে মূলত ড. আনু মুহাম্মদ জাতীয় মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় কীভাবে জ্বালানি সংকটের সমাধান করা যায় তার একটি রূপরেখা তুলে ধরেন। নিম্নে ড. আনু মুহাম্মদের মতামত ও যুক্তি তুলে ধরা হলো-

‘একটি দেশের জাতীয় সংস্থা কতটা পারবে এটি নির্ভর করে সে দেশে কোন ধরনের শাসক ক্ষমতায় আসীন রয়েছে। কারণ, শাসকরাই জাতীয় সংস্থার সক্ষমতা, ব্যাপ্তি এবং তার কর্মপরিধি নির্ধারণ করে। আর সক্ষমতা বলে তো অপরিবর্তনযোগ্য কিছু নেই। যারা বলে বাংলাদেশের সক্ষমতা নেই, তারা হয় ইতিহাস না জেনে হীনমন্যতায় আক্রান্ত অথবা বিদেশি কোস্পানির পক্ষে যুক্তি সাজানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত। সক্ষমতা কি স্থায়ী কিছু? আজকে যারা দুনিয়ায় বড় বড় তেল, বিদ্যুৎ বা গ্যাস কোম্পানি আছে ৫০ বা ১০০ বছর বছর আগে তো তাদের কোন সক্ষমতা ছিল না। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সক্ষমতা অর্জন করতে হয়। আর বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে নিজ দেশের তেল গ্যাস খনিজ সম্পদের মালিকানা রক্ষা করা এবং তার সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পারমাণবিক  বিদ্যুৎ কেন্দ্র অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ – এটি আজ প্রমাণিত। যে কারণে দুনিয়ার কোথাও নতুন করে আর পারমাণবিক  বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে না, বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে। কারণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে ধরনের বিপদ, সে বিপদ শিল্পোন্নত দেশে থাকলেও সেটি কমে না। এরমধ্যে কিছু কিছু দুর্ঘটনার কথা আমরা জানি, কিন্তু অনেকগুলো দুর্ঘটনার কথা আমাদের জানাই হয়নি। সেগুলোর কারণে প্রকৃতি ও পরিবেশের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আমাদের জীবন জীবিকার মধ্যে বিশেষ করে পানি সম্পদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশে পারমাণবিক  বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে সরকারের কোনো কোনো বিভাগ এই বিষয়ে দায়িত্বহীনভাবে কথা বলছে। তারা বলছে নতুন জিনিস আসবে। যে দেশের সরকারগুলোর সময়ে তৈরি পোশাক কারখানার ছোট ছোট দুর্ঘটনা মোকাবিলা করতে পারে না, সে দেশের সরকার বলছে এখানে কোনো দুর্ঘটনা হবে না। যে দেশে সাধারণ শিল্প দূষণে নদী, পানি প্রবাহ এবং কৃষি জমির সর্বনাশ হচ্ছে, সেখানে সরকার বলে যাচ্ছে সব দূষণ ঠেকানো হবে।

পারমাণবিক বিদ্যুতের একটি আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। কারণ এর মাধ্যমে একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। কিন্তু এর বিপুল ক্ষতির কথা চিন্তা করে জার্মানির মত দেশ এই উদ্যোগ থেকে পিছিয়ে আসছে। তারা বলেছে, ২০২০ সালের মধ্যে তাদের দেশের সব পারমাণবিক  বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেবে। এটি তো আর এমনিতে না। জাপানের এই ঘটনার পরে সারাবিশ্বেই বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশেগুলোতে পারমাণবিক  বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্প্রসারণ করাই কঠিন হবে। তাদের যেগুলো বন্ধ হবে সেগুলো নিয়েই তারা বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে এসে হাজির হবে।

পারমাণবিক  বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটলে পরিবেশের জন্য মহাবিপদ আকারে হাজির হয়। দুর্ঘটনা ছাড়াও এটার যেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা সেটা খুবই জটিল একটি বিষয়। সারা দুনিয়ায়ই এটি এখনো অমীমাংসিত বিষয়। এই বিপদের ঝুঁকিটা বাংলাদেশে আরও বেশি। কারণ হলো, পুরো ব্যবস্থার ওপর বাংলাদেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই বিষয়ে বাংলাদেশে যেহেতু কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠান নেই, তাই এ বিষয়ে কোনো জাতীয় সক্ষমতাও গড়ে ওঠেনি। কিংবা জিনিসটা ঠিক কী হবে বা কোনটি করলে বাংলাদেশের জন্য ভাল হবে এবং কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার মোকাবিলা কীভাবে করা হবে বা এর দায়ভার কে নেবে এইসব কোনো কিছুই স্পষ্ট করা হয়নি।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জাপানে যে ধরনের দুর্ঘটনা হয়েছে, সেখানে তাদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ,প্রতিষ্ঠান, নিজস্ব প্রযুক্তি ও যথেষ্ট সংগঠিত নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এ দুর্ঘটনা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের কোনোটিই নেই। বিদেশি একটি কোম্পানি বা রাষ্ট্র যখন কাজ করে, তখন তাদের তেমন কোনো ধরনের দায়-দায়িত্ব থাকে না। সুতরাং এটি একটি ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি করতে পারে। সরকার বলছে যে, দশ মাত্রার ভুমিকম্প সহনীয় করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হবে। এ ধরনের বহু প্রতিশ্র“তি সরকার অতীতে দিয়েছে, এগুলো তারা সহজেই বলে, কেননা কোনোটিই তারা করার জন্য বলে না। কোন সরকার এখনো পর্যন্ত টেংরাটিলা এবং মাগুরছড়ার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি, চেষ্টাও করেনি।

এ অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে যে, তাহলে কি আপনারা বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান চান না? আমাদের বক্তব্য হলো- বিদ্যুৎ পেতে হলে কি ধ্বংস ডেকে আনতেই হবে অনিবার্যভাবে? বিদ্যুৎ আমরা পাব এবং বিদ্যুৎ ব্যবহারে করে আমরা আমাদের সমৃদ্ধি ঘটাবো। বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয় আমাদের জীবনকে আরও গতিশীল ও স্বচ্ছন্দ করার জন্য, সর্বনাশ করবার জন্য নয়। সুতরাং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমাদের চিন্তা করতে হবে কোন কোন মাধ্যমে আমরা নিরাপদভাবে বিদ্যুতের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারি।

‘তেল-গ্যাস খনিজ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ মনে করে, ঝুঁকিপূর্ণ পারমাণবিক  বিদ্যুৎ কেন্দ্র না করে প্রথমত, প্রয়োজন হলো অনবায়নযোগ্য সম্পদকে ঠিকভাবে কাজে লাগানো। আমাদের যতটুকু গ্যাস আছে এবং যতটা গ্যাস পাওয়া সম্ভব তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। স্থলভাগে এখন যে পরিমাণ গ্যাস আছে, তারচেয়ে বেশি পরিমাণ গ্যাস আরও পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সমুদ্রবক্ষে তারও দু তিনগুণ বেশি পাওয়া সম্ভব। এগুলো যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে আগামী পঞ্চাশ বছরে যে পরিমাণ গ্যাস প্রয়োজন, তার কাছাকাছি পরিমাণ গ্যাস এখানে আছে। সেই গ্যাস সম্পদ আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগাতে পারছি না কিনা সেটিই হল প্রশ্ন।

যেমন সমুদ্রবক্ষে সরকার চুক্তি করছে, শতকরা আশি ভাগ গ্যাস বিদেশি কোম্পানি রফতানি করতে পারবে, এরকম বিধান রেখে। কনোকো ফিলিফস-এর সঙ্গে সরকার যে চুক্তি করছে, এ রকম চুক্তি যদি সরকার করতে থাকে, তাহলে তো আমরা গ্যাস সম্পদকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাজে লাগাতে পারব না। কারণ, চুক্তিটি করাই হচ্ছে এলএনজির মাধ্যমে গ্যাস রফতানি করবার সুযোগ দিয়ে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ ভাগের বেশি গ্যাসের মালিকই হতে পারবে না। বিশভাগ যদি পেট্রোবাংলা নিতেও চায়, তাহলে সেটা বাংলাদেশের স্থলভাগে পৌঁছানোর দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানি নিবে না। এজন্য বাংলাদেশকে নিজেদের দায়িত্বে পাইপ লাইন বসাতে হবে। এটি অর্থনৈতিকভাবে কোনক্রমেই যৌক্তিক হতে পারে না। আর বাংলাদেশ যদি পাইপ লাইন না বসাতে পারে তাহলে বাকি বিশভাগও রফতানি করতে বাধ্য করা হতে হবে। যদি কনোকো ফিলিফসকে এই সুযোগ দেয়া হয় তাহলে অন্যরাও তো একই মডেলে একই সুযোগ চাইবে। এভাবে দেখা যাচ্ছে যে, সমুদ্রবক্ষের একটি বিশাল গ্যাস কিন্তু আমরা হারাচ্ছি, যে গ্যাস দিয়ে বাংলাদেশের কয়েক দশকের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হত।

আমরা সবাই জানি যে, পারমাণবিক বা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনেক নিরাপদ এবং খরচও কম। সে হিসেবে আমাদের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে হলে রফতানিমুখী পিএসসি সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। সমুদ্রে যে পরিমাণ গ্যাস পাওয়া গিয়েছে, সেগুলো যদি বাংলাদেশের মালিকানায় বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ওঠানো হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের গ্যাসের কোনো ঘাটতি তৈরি হবে না।

স্থলভাগে বাপেক্স ও পেট্রোবাংলার সকল প্রতিষ্ঠান প্রমাণ করেছে যে, তারা গ্যাস উত্তোলনে সক্ষম। শতকরা পঞ্চাশভাগ গ্যাস এখনো আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই উত্তোলন করছে। কিন্তু তাদেরকে কোনঠাসা করে ফেলার চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে। স্থলভাগে বাপেক্স ও পেট্রোবাংলা তাদের দক্ষতা প্রমাণ করার পরও স্থলভাগে অনেকগুলো ব্লক বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে সরকারের প্রধান ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলার স্বার্থ রক্ষা করা।

কেউ কেউ বলতে পারেন যে, সমুদ্রবক্ষে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এক্ষেত্রে কথা হলো- স্থলভাগেও তো বাংলাদেশের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার পর তো প্রথমে পেট্রোবাংলা ও পরে বাপেক্স গঠন করা হয়েছে। তখন বিদেশি কোম্পানির কাছে তুলে দেয়া হয়নি। বাপেক্স প্রথমদিকে বিদেশি বিশেষজ্ঞ ভাড়া করে এনে কাজ করিয়েছে। কিন্তু আশি ও নব্বই এর দশকে বাপেক্স অসামান্য সফলতা দেখিয়েছে। সমুদ্রবক্ষেও বাপেক্সকে এ দায়িত্বটা দেয়া যেত। বিষয়টি মোটেই জটিল নয়। যেমন, কনোকো ফিলিফস যে দুটি ব্লকের মালিক হয়েছে সেখানে তো কনোকো ফিলিফস নিজে কাজ করবে না। সেখানে সাব কন্ট্রাকটর নিয়োগ দিয়ে কাজ করাবে। যেমন সানটোস বাংলাদেশের ব্লকের কর্তৃত্ব নিয়ে এখন ড্রিলিং করবার জন্য নরওয়ে’র একটি কোম্পানিকে সাব কন্ট্রাক্ট দিয়েছে। আমরা বলি যে, সমন্বয়ের কাজটি কনোকো ফিলিফস করছে সেই কাজটিই তো আমাদের বাপেক্স বা পেট্রোবাংলা করতে পারে। তাহলে তো আর গ্যাস রফতানি হয় না। নিজেদের কর্তৃত্বে কাজ পরিচালনা করলে আস্তে আস্তে আমাদের দক্ষতাও গড়ে ওঠবে। এটির জন্য দরকার জাতীয় স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকার। খুব বেশি অর্থ বিনিয়োগ করা লাগবে না। কনোকো ফিলিপস পাঁচ বছরে বিনিয়োগ করবে ১১০ মিলিয়ন ডলার বা ৭২৫ কোটি টাকা। এটি বাংলাদেশের জন্য কোন টাকা? এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বিনিয়োগ করতে পারে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে করলে শতভাগ গ্যাস আমাদের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারবো। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক থাকত। বাপেক্স কখনো দুর্ঘটনা ঘটায়নি, কিন্তু অক্সিডেন্টাল, নাইকো দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। কারণ তাদেও তো কোনো দায় দায়িত্ব নেই। সুতরাং গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ সমস্যার একটি বড় সমাধান করা সম্ভব।

দ্বিতীয় সমাধান হলোÑ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ। অনেকে বলে কয়লা কি আপনারা তুলতে দিবেন না? এক্ষেত্রে আমাদের কথা হলোÑ কয়লা মাটির নীচে রাখতে হবে এমনটি আমরা বলি না। বরং আমরা মনে করি কয়লা ওঠাতে হবে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থে। প্রথমত, দেখা গেল এমন পদ্ধতিতে কয়লা ওঠানো হল যেখানে দশ টাকার কয়লার জন্য একশত টাকার ক্ষতি হচ্ছে। সেটাতো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, এশিয়া এনার্জি চেয়েছিল খোলামুখ পদ্ধতিতে কয়লা ওঠাতে, যাতে বাংলাদেশ শতকরা ছয় ভাগের বেশি কয়লার মালিক হতে পারবে না। তারা শতকরা আশি ভাগ কয়লা রফতানি করে ফেলবে। শতকরা আশি ভাগ কয়লা যদি রফতানি হয়ে যায়, তাহলে তো তা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগবে না। এক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তাব হলো জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে খোলামুখ পদ্ধতি ছাড়া অন্য যে কোন পদ্ধতি যা আমাদের জন্য উপযুক্ত সে পদ্ধতিতে কয়লা ওঠাতে হবে।

সরকার যদি আড়াই বছর আগে এসে কয়লা ওঠানোর জন্য একটি জাতীয় সংস্থা গঠন করত, এতদিনে কয়লা ওঠানোর জন্য আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি হত। জাতীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে আমাদের দেশি-প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে যদি এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার ছিল। শুধুমাত্র বিদেশি কোম্পানিকে সুবিধা দেয়ার জন্যই সরকার জাতীয় সংস্থা গড়ে তোলেনি। মাঝেমাঝে এ কথাটা আসে যে আমাদের সক্ষমতা তৈরি করতে কত সময় লাগবে? ২০০৮ সালে যখন কয়লা নীতি প্রণয়ন করা হয়, তখন সরকার বলেছিল যে, আমাদের সময় নেই, জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে সময় লাগবে, অন্যদিকে আমাদেরকে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা লাগবে। অথচ তখন জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলে আজ আমাদের জাতীয় সক্ষমতা গড়ে ওঠত। ফলে আমরা বাছাই করতে পারতাম যে কোন পদ্ধতিতে কয়লা ওঠালে আমরা সবচেয়ে বেশি লাভবান হব।

বিদ্যুৎ উৎপাদন যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, তাহলে রফতানিমুখী কোনো চুক্তি করা যাবে না। একদিকে বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের জন্য বিপদজ্জনক পারমাণবিক  চুক্তি, অন্যদিকে আমাদের যেসব জ্বালানি আছে সেগুলো আমরা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। সুতরাং রফতানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করে অনবায়নযোগ্য সম্পদ থেকে আমরা বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি।

এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে নবায়নযোগ্য সম্পদ যেমন, সৌরশক্তি বা বায়ু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে আমাদেরকে নজর দিতে হবে। বিশ্বব্যাপী এবং বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের চাহিদা যেহেতু বাড়ছে, তাই এক্ষেত্রে একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এই সিন্ডিকেট সোলার প্যানেল ও ব্যাটারির দাম কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধি করেছে। এই জায়গাটি যদি না ভাঙ্গা যায়, তাহলে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করার সুবিধা আমরা অর্জন করতে পারবো না। সৌর বিদ্যুৎকে কীভাবে আমরা কম খরচে ব্যবহার করতে পারি সেজন্যও জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা আবশ্যক। জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠলে দেশেই সোলার প্যানেল ও ব্যাটারি তৈরি করে এগুলোকে সহজলভ্য করা যায়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে খুব বেশি তহবিলেরও প্রয়োজন পড়ে না। এর ফলে তরুণদের মধ্যে যারা এ বিষয়ে কাজ করতে চায় তারা উৎসাহিত হবে। সেক্ষেত্র সরকারকেই তৈরি করতে হবে।

জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে জাতীয় সক্ষমতা যদি তৈরি না হয় তাহলে আমরা আমাদের সম্পদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাব না। যেমন, বিদেশি কোম্পানি যদি বলে অমুক গ্যাসক্ষেত্রে এত পরিমাণ গ্যাস মজুদ আছে, কিংবা এই সোলার প্যানেলে এত খরচ হবে এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে কে? তেল ও গ্যাসের এই সব বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ করবে কে? যদি একটি দুর্ঘটনা ঘটে সেটিকে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করবো? যেমন, কয়লা খনিতে শুধুমাত্র কয়লা থাকে না, আরও অনেক ধরনের মূল্যবান খনিজ পদার্থ থাকে। অনেকে বলে যে, কয়লা হচ্ছে গৌণ বরং হীরা বা অন্যান্য মূল্যবান পদার্থ রয়েছে বলেই কয়লা ওঠানোর জন্য বিদেশি কোম্পানির এত উন্মাদনা দেখা যাচ্ছে। তাই এসব দেখভালের জন্যও তো জাতীয় সক্ষমতা প্রয়োজন। বিদেশি কোম্পানিকে উজাড় করে দেয়ার যে পরিকল্পনায় যে দেশের সরকার বসে আছে সেই দেশে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট দূর হওয়াতো দূরের কথা বরং ক্রমাগতভাবে পুরো দেশ আরও অধিকতর সংকটে পতিত হবে।

আমরা তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় চলমান বিদ্যুৎ সংকট কীভাবে দেশীয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় সমাধান করা যায় তা বারবার বলেছি। যেমন, কুইক রেন্টাল খ্যাত দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতে সরকার প্রতিবছর প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা ভর্তূকি দেবে। অথচ সরকার পাঁচশত কোটি টাকা খরচ করে স্বল্প মেয়াদে রাষ্ট্রীয় পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামত ও নবায়ন করলে এর চেয়ে বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়া সম্ভব হত। সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আমার এগুলো বলে আসছি। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যেখানে দু টাকারও কমদামে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ দিতে পারে, সেখানে তাকে গ্যাস না দিয়ে চার ছয়গুণ বেশি দামে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ সাত আট এমনকি বারো টাকায় উৎপাদন হওয়া বিদেশি কোম্পানিকে গ্যাস দেয়া হয়েছে।

তার মানে পুরো ব্যবস্থা বিশেষ করে জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয় আজ বিদেশি কোম্পানির হাতে। তারা যেভাবে চায় সেভাবেই সবকিছু বাস্তবায়ন করা হয়। এজন্য তাদের বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে তাদের স্বার্থে, তাদের স্বার্থেই তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির চুক্তি। এগুলোতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট কাটবে না, বরং বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে আরও বড় জালে আটকে যাবে। বিদেশি কোম্পানিগুলো আজ দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের পক্ষ হয়ে কথা বলার জন্য তারা অনেক আমলা ও বুদ্ধিজীবী তৈরি করেছে। কোম্পানিগুলো সভা ও সেমিনারের মাধ্যমে তাদের পক্ষে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করছে। আমাদের ব্যাপারে এমন একটি ভাবমূর্তি তৈরি করা হচ্ছে যে আমরা বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের বিরোধিতা করছি। তার জন্য জনগণের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে। বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত রক্ষার স্বার্থেই সম্মিলিতভাবে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।’

রাজনৈতিক ডটকম,  ২ জুলাই ২০১১

Leave a Reply

Your email address will not be published.