জাহাজ নির্মাণ শিল্প হতে পারে দেশের বৃহৎ রফতানি খাত

তৈরি পোশাক শিল্পের পাশাপাশি দেশের রফতানি আয়ের অন্যতম প্রধান খাত হিসেবে স্থান করে নিতে চলেছে জাহাজ নির্মাণ শিল্প। সরবরাহের সময়সীমা ঠিক রাখায় এবং অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে মানসম্পন্ন জাহাজ নির্মাণের কারণে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ জাহাজের দিকে ঝুঁকছে। জাহাজ নির্মাণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সুযোগ তুলনামুলক বেশি। এমনকি ভারত, চীন, ভিয়েতনামের চেয়েও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ভালো। চীন ও ভিয়েতনামে শ্রমিকের মজুরি অনেক বেশি।

জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশে স্বল্প খরচে প্রচুর শ্রমিক পাওয়া যায়। ফলে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য বাংলাদেশ কৌশলগত দিক দিয়ে অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। শিল্পোন্নত জাহাজ নির্মাতা দেশগুলোর খরচ বেড়ে যাওয়ায় নিজ দেশে জাহাজ নির্মাণ না করে সস্তা শ্রমের দেশে নির্মাণের কার্যাদেশ (অর্ডার) দিচ্ছে। তাছাড়া বিশ্বের জাহাজ নির্মাণকারী দেশসমূহ তথা জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরে এত বেশি পরিমাণ জাহাজ তৈরির কার্যাদেশ রয়েছে যে তারা আর নতুন করে কার্যাদেশ নিতে ইচ্ছুক নয়। ২০০৮ সালেই এসব দেশের ২০১২ সাল পর্যন্ত অগ্রিম কার্যাদেশ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী জাহাজ ক্রেতারা বিকল্প দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে কার্যাদেশ দিচ্ছে।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক নৌ-সংস্থা আইএমও’র জারিকৃত আইএসপিএস কোডের কারণে ২৫ বছরের বেশি পুরানো জাহাজসমূহ আগামী বছর থেকে সমুদ্রে চলাচল করতে পারবে না। আইএমও’র এ নির্দেশনার কারণে শুধুমাত্র  ইউরোপীয় দেশগুলোকেই প্রায় তিন হাজার নতুন জাহাজ বাদ দিতে হবে এবং এর স্থলে নতুন জাহাজ যোগ করতে হবে। আর এ জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশ হতে পারে অন্যতম বিকল্প।

জাহাজ নির্মাণের বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনা
বিশ্বে এখন সমুদ্রগামী জাহাজের বাজার রয়েছে প্রায় ১১২ লাখ কোটি টাকার। কিন্তু প্রতি বছর জাহাজ নির্মাণ হচ্ছে এর ৭৫ শতাংশ অর্থাৎ ৮৪ লাখ কোটি টাকার। বাকি ২৮ লাখ কোটি টাকার যে যোগান স্বল্পতার বাজার রয়েছে সেখানে বাংলাদেশের মত নতুন জাহাজ নির্মাণকারী দেশের রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা। ফলে ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ শত কোটি ডলারেরও বেশি কার্যাদেশ পেতে পারে৷ ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে জাহাজ রফতানির কার্যাদেশ পেয়ে এখন ব্যস্ত নির্মাণ কাজে। এসব প্রতিষ্ঠান আগামী বছর এ খাত থেকে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি আয় করবে।

শ্রমের উচ্চমূল্যের কারণে উন্নত দেশগুলো ছোট জাহাজ তৈরিতে আর আগ্রহী নয়। অথচ এই ছোট জাহাজের বিশ্ব বাজার প্রায় ৪০ হাজার কোটি ডলারের। এর এক ভাগও যদি বাংলাদেশ ধরতে পারে, তার পরিমাণ হবে ৪ বিলিয়ন বা ৪ শ’ কোটি ডলার। বাংলাদেশ যদি জাহাজ নির্মাণের এ ধারা আরও বাড়াতে পারে তাহলে এ খাত থেকেই বছরে ১০০ কোটি ডলার আয় করতে পারবে। বাংলাদেশে দক্ষ শ্রমিক থাকার কারণে এটি সম্ভব হতে পারে। সিঙ্গাপুরে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে নিয়োজিত জনশক্তির আশি ভাগই বাংলাদেশি। এই শিল্পের বিকাশ ঘটলে দক্ষ জনশক্তি রফতানি করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে। ইতোমধ্যে জাহাজ রফতানি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানি প্রায় চার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। আগামী ছয় বছরের মধ্যে জাহাজ নির্মাণ শিল্প দেশের জিডিপি ৩ শতাংশ বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এজন্য দরকার জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে ‘অগ্রাধিকার খাত’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া।

জাহাজের ডিজাইন তৈরি করেও সম্ভব বিপুল টাকা আয় করা
বিশ্ব বাজারে জাহাজের ডিজাইন তৈরি করার মাধ্যমেও বাংলাদেশ আয় করতে পারে বিপুল পরিমাণ অর্থ। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপানসহ কয়েকটি দেশে ১০টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা সমুদ্রগামী জাহাজ ডিজাইন অনুমোদন দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের আটটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মত সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরির ক্ষেত্রে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে। বিদেশে একটি নকশা করতে খরচ হয় ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা, যা বাংলাদেশে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকায় করা সম্ভব। এর ফলে দেশের টাকা আর বিদেশ যাবে না। নিজের দেশে নকশা তৈরি করতে পারলে রফতানি মুল্যের শতকরা ১৫ ভাগ ব্যয় কমানো ও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। সমুদ্রগামী জাহাজের নকশা এখন বাংলাদেশে তৈরি হওয়ায় নির্মাণ খরচ অনেকটা কমে যাবে।

জাহাজ নির্মাণে যেসব কোম্পানি কাজ করছে
বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রফতানিমুখি জাহাজ নির্মাণ করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑ ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, আনন্দ শিপইয়ার্ড, হাইস্পিড শিপইয়ার্ড, খুলনা শিপইয়ার্ড, মেঘনা শিপ বিল্ডার্স, কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড, খান বিল্ডার্স এবং সিনহা শিপইয়ার্ড।

বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো যে সমস্যা মোকাবিলা করছে
বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিকাশে অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো এখানে ব্যাংক সার্ভিস চার্জ অনেক বেশি। জাহাজ নির্মাণের জন্য বিদেশ থেকে যে কাঁচামাল নিয়ে আসা হয় সেগুলোর জন্য ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হয়। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক রেটিং অনেক কম হওয়ায় বিদেশ থেকে ব্যাংকগুলো প্রত্যাখ্যাত হয়। তখন বিদেশি কোনো ব্যাংক থেকে এ গ্যারান্টি নিতে হয়। এ গ্যারান্টি বাবদ কমিশন অনেক বেশি। জাহাজ নির্মাণ যেহেতু একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যাংক ঋণ নিতে হয়। অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে যেখানে সুদ দিতে হয় ৭ থেকে ৮ শতাংশ, সেখানে এ শিল্পের জন্য সুদ দিতে হয় ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ, যা উদ্যোক্তাদের জন্য বড় সমস্যা। কাঁচামাল আমদানি করার সময় ডিউটি খরচও অনেক বেশি। ১০ মিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানি করতে ৩ থেকে ৪ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। এছাড়া ছাড়পত্রের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা।

এ শিল্পের বিকাশে সরকারের যা করা দরকার

২০১৫ সালের মধ্যে জাহাজ নির্মাণ শিল্প থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সরকার একটি স্পেশাল শিপ বিল্ডিং জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে সরকার থার্ড সেক্টরের (তৃতীয় খাত) স্বীকৃতি দিয়েছে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সমস্যাগুলো দূর করে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন এক্সপোর্ট প্রোমোশন ব্যুরো (ইপিবি) একটি স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করেছে। ইপিবি জাহাজ নির্মাণ শিল্প বিষয়ক বিভিন্ন জাতীয় সেমিনার আয়োজন করবে।

জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিকাশে বিশেষ সহায়তা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে ঋণের সুদের হার কমানো, সহজে ও দ্রুত ঋণ দেয়া এবং বড় অঙ্কের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। ঘোষিত মুদ্রানীতিতেও জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এ খাতে ঋণ দিতেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জাহাজ নির্মাণ খাতকে জোরদার করতে পূর্ণ অর্থায়ন প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ২ শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর খুব শিগগিরই পুনঃঅর্থায়ন প্রকল্প চালু করবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান।

জাহাজ নির্মাণ খাতের এখন যে অবকাঠামো আছে, তাতেই বছরে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। সরকার যদি তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের মত জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে সমানহারে সুবিধা দেয়, তাহলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে এ খাত থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। এরফলে এক সময় তৈরি পোশাক নয়, জাহাজ নির্মাণ খাতই বাংলাদেশের রফতানি তালিকার শীর্ষে উঠে আসবে।

বিশ্বের যেসব দেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্প রয়েছে তাদের প্রায় সবাই সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের কাছ থেকে ৩০ শতাংশ হারে ইনসেনটিভ/প্রণোদনা পেয়ে থাকে।  বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে ২৫ শতাংশ প্রণোদনা দেয়া হয়। অন্যান্য দেশের মত জাহাজ নির্মাণ খাতে সরকার যদি ৩০ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয় তাহলে এক বছরের মধ্যে কমপক্ষে ১৫ হাজার কোটি টাকার কার্যাদেশ আসতে পারে। জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ৭ শতাংশ সুদহারে ঋণদানের কথা বলছে। তাদের যুক্তি হলো বাংলাদেশ ব্যাংকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রচুর টাকা জমা রয়েছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে গ্যারান্টি দিতে পারে।

পরিশেষে, জাহাজ ভাঙা শিল্পে পরিবেশের ক্ষতি সাধন হলেও জাহাজ নির্মাণে পরিবেশের কোন ক্ষতি হয় না। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল সমুদ্রবেষ্টিত বিধায় এখানে জাহাজ নির্মাণের পরিবেশ রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে নদী তীরবর্তী এলাকায় অনেক জায়গা আছে। তাই এ রকম একটি অনুকূল পরিবেশে বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্প একটি বৃহৎ শিল্প আকারে দাঁড়াবে, অর্জিত হবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ – কিন্তু এজন্য দরকার বিশেষ সহায়তা এবং শিপইয়ার্ড গড়ে তুলতে আরও প্রচুর উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা।

রাজনৈতিক ডটকম, ৩ ডিসেম্বর ২০১০

Leave a Reply

Your email address will not be published.