আমরা সবাই বর্তমানকে পৃথিবীকে জানতে চাই, জানতে চাই আমাদের ভবিষ্যত পৃথিবীর স্বরূপ কেমন হবে? আর বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারকেন্দ্র সম্পর্কে জানতে হলে আমাদেরকে অতীতের ইতিহাস জানা দরকার। কারণ আমরা জানি, অতীতের নানা ঘটনাই বর্তমান ও ভবিষ্যতের রাজনীতি ও মানচিত্র নির্ধারণ করে দেয়। তাই বর্তমান বিশ্ব সম্পর্কে জানতে হলে আমাদেরকে বিশেষ করে বিংশ শতাব্দির নানা ঘটনা সম্পর্কে জানতে হবে। আমরা আজকে ১৯১০-১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই সময়কার বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে জানবো। কারণ এই সময়ই ঘটে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের ফলে ক্ষমতার ভারকেন্দ্র পরিবর্তিত হয়। দুই বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে গঠন করা হয় জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও ন্যাটোর মত সংগঠন।
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একনজরে ১৯১০-১৯৫০ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো সম্পর্কে জেনে নেই– ১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) ২. বলশেভিক বিপ্লব (১৯১৭) ৩. ভার্সাই চুক্তি (১৯১৯) ৪. তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের উত্থান (১৯২০) ৫. ১৯৩০ এর বিশ্বমন্দা ৬. ভারতে গান্ধীর অহিংস আন্দোলন (১৯২০-৪০) ৭. হিটলারের ক্ষমতায় আরোহন (১৯৩৩) ৮. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫) ৯. জাতিসংঘ গঠন (১৯৪৫) ১০. বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ গঠন (১৯৪৫) ১১. ট্রুম্যান ডকট্রিন (১৯৪৭) ১২. মার্শাল পরিকল্পনা পেশ (১৯৪৮) ১৩. ভারত-পাকিস্তানের জন্ম (১৯৪৭) ১৪. ন্যাটো গঠন (১৯৪৯) ১৫. চীনে কম্যুনিস্ট বিপ্লব (১৯৪৯) ১৬. সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হয় (১৯৪৯) ১৭. পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি নামে দুটো রাষ্ট্রের জন্ম (১৯৪৯)।আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলনীতি:আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কিছু সুনির্দিষ্ট মূলনীতি রয়েছে, যা আলোচনাকে বোঝার জন্য আমাদের জানা দরকার। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো স্থায়ী শত্রু বা মিত্র নেই, আন্তর্জাতিক রাজনীতি’র মূলনীতিই হলো- ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতা এবং ‘ব্যালেন্স অব পাওয়ার’! মানে, কোনো রাষ্ট্রই আসলে চায় না অন্য কোনো একটি রাষ্ট্র এতটা শক্তিশালী হোক, যে রাষ্ট্র আগামীতে সে দেশের জন্য হুমকির কারণ হবে। এই যে অপর রাষ্ট্র থেকে হুমকি সম্মুখীন হওয়া, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই কিন্তু রাষ্ট্রগুলো নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং অন্য রাষ্ট্রের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তোলে। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দির বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গেলে আমরা সে চিত্রই দেখতে পাবো।
উনবিংশ শতাব্দির কিছু ঘটনা:
আমরা যদিও বিংশ শতাব্দির প্রথম ভাগ নিয়ে আলোচনা করবো। কিন্তু আলোচনার ধারাবাহিকতার জন্য আসুন প্রথমে উনবিংশ শতাব্দির একটি চিত্র দেখে নেই। উনবিংশ শতাব্দিতে ব্রিটেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড, স্পেন ও পর্তুগাল তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি ও শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ করার জন্য দক্ষিণ এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকাতে তাদের সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটায়। যে কারণে ১৮৭০ সাল থেকে ১৯১৪ সালের সময়সীমাকে ‘Age of Imperialism’ বলা হয়। এছাড়া এ সময় ইউরোপে ব্যাপক শিল্পায়ন হয়, শিল্পায়নের ফলে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিস্তার ঘটে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন দেশ কর্তৃক কট্টর জাতীয়তাবাদী নীতি গ্রহণ বিংশ শতাব্দির রাজনীতিকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়। উগ্র জাতীয়তাবাদের বিস্তার দেখি আমরা জার্মানিতে। ১৮৯৭ সাল থেকে দেশটি যে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে তার উদ্দেশ্য ছিল জবরদস্তি করে নিজেকে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করা। এর অংশ হিসেবে জার্মানি নৌ-শক্তি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিলে ব্রিটেন শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এরফলে ব্রিটেন জার্মানির সাথে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং নিঃসঙ্গতা পরিহার করে ফ্রান্সের সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে ১৯০৭ সালে রাশিয়া-ফ্রান্স-ব্রিটেন মিলে ‘ট্রিপল আঁতাত’ গড়ে উঠে।এখানে নেপোলিয়ন সম্পর্কে একটু আলোচনা না করলেই নয়। ১৮১৫ সালে ওয়াটার লুলুর যুদ্ধে পরাজয়ের আগে নেপোলিয়ন ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোকে নিজের দখলে নিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। নেপোলিয়নের বিদায়ের পর ১৮৭১ সালে জার্মানি একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রিন্স বিসমার্ক ছোট ছোট রাজ্যগুলোকে একত্র করে জার্মান সাম্রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা চালান। তিনি অস্ট্রিয়া ও ইতালি মিলে ত্রিশক্তির মৈত্রী গড়ে তোলেন। আমরা একটু আগে ফ্রান্সের নেতৃত্বে যে ‘ট্রিপল আঁতাতে’র কথা বলেছিলাম তা ছিল তারই পাল্টা প্রতিক্রিয়া। এই দুই জোটের পরস্পর বিরোধী কর্মকাণ্ডই প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপট বা তৎকালীন ক্ষমতার চিত্র:ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ১৮৭১ সাল থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত বড় কোনো যুদ্ধ হয়নি। তাই এ সময়কালকে শান্তিপূর্ণ যুগ বলা হয়। কিন্তু এ সময়ই বিভিন্ন রাষ্ট্র গোপনে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। যেমন, বিসমার্কের নেতৃত্বে জার্মানি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিসমার্কের পর ১৮৯৮ এ ক্ষমতায় এসেই উচ্চাকাঙ্খী সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলহামের মনে ইউরোপের বাইরেও সাম্রাজ্য স্থাপনের খায়েশ জাগে। এ সময় জার্মান মনীষীগণ উগ্র জাতীয়তাবাদে ইন্ধন যোগান। জার্মান পিতৃভূমি সকল দেশের শ্রেষ্ঠ এবং জার্মান জাতি অপরাপর জাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ- এই ধারণা জার্মানদের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করে।অপরদিকে রাশিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের এলাকায় নিজ প্রভাব বিস্তারের দিকে নজর দেন। কারণ অস্ট্রিয়ার সূত্র ধরে সার্বিয়ায় জার্মান উপস্থিতি রাশিয়া একটি নিশ্চিত হুমকিস্বরূপ দেখে। দ্বিতীয় নিকোলাসের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ায় তৎকালীন কম্যুনিস্ট বিপ্লব থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো।অন্যদিকে ব্রিটেন ছিল শক্তিশালী নৌ-শক্তির অধিকারী। এ নৌ-শক্তি দ্বারা তৎকালীন সময়ের অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথে একক আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এর উপনিবেশগুলোর সাহায্যে তৎকালীন বিশ্বে ব্রিটেন ছিল একক পরাশক্তি। আমরা জানি, ফ্রান্সের সাথে ব্রিটেনের ছিল ঐতিহাসিক শত্রুতা। এ কারণে বৃটেন প্রথমদিকে জার্মানীর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলো। কিন্ত জার্মানী যখন ব্রিটেনের সাথে নৌ-প্রযুক্তিতে পাল্লা দিতে শুরু করে তখন এ সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। আর অস্ট্রো-হাঙ্গেরী ও অটোমান সাম্রাজ্য দুটিও শক্তিশালী অবস্থানে ছিল। কিন্তু সেইসময় পতনের মুখে থাকায় তারা জার্মানির সাহায্যে হারানো ক্ষমতা ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখতে থাকে। অন্যদিকে ফ্রান্স তখন আফ্রিকায় তার উপনিবেশ থেকে প্রাপ্ত সম্পদের কারণে বেশ ভাল অবস্থায় ছিল। কিন্তু একটি শক্তিশালী জার্মানি মানেই তাদের ভয়াবহ ক্ষতি– ব্রিটেনের মত তারাও এটাও অনুধাবন করে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এবং ভৌগোলিক ও সামরিক শক্তি ব্যাপক থাকলেও ১৮২৩ সালের ‘মনরো ডকট্রিন’ অনুযায়ী তাদের নীতি ছিল যে কোনো ইউরোপিয়ান ঝামেলার বাইরে থাকা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮): এই রকম একটি অবস্থায় ১৯১৪ সালের ২৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রানৎস ফার্ডিনান্ড এক সার্বিয়ান আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারে অস্ট্রিয়া কিছু শর্ত বেঁধে দেয়। কিন্তু সার্বিয়া সব শর্ত মানতে অস্বীকার করলে ওই বছরের ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ সময় জার্মান সম্রাট উইলহেইম অস্ট্রিয়াকে সম্পূর্ণ সমর্থন দেয়।অস্ট্রিয়া সার্বিয়া আক্রমণের পরপরই জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্স ও রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আগের একটি চুক্তি অনুযায়ী অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে জার্মানি নিরপেক্ষ বেলজিয়াম আক্রমণ করলে পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঘোষণা করে। যুদ্ধ শুরু হয় পুরো ইউরোপজুড়ে, যা চলে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত। যুদ্ধের পূর্বে জার্মানির ধারণা ছিল যে, সার্বিয়ার বিরুদ্ধে একটি সংক্ষিপ্ত ও আঞ্চলিক যুদ্ধে বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তারা অস্ট্রিয়াকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সার্বিয়ায় হামলা করার অনুমুতি দিয়ে দেয়, যা ছিল বিরাট ভুল।যুদ্ধের প্রথমদিকেই যোগ দেয়া রাশিয়া এবং ফ্রান্সকে ভালভাবেই মোকাবিলা করছিল জার্মানি। কিন্তু যুদ্ধে ব্রিটেনের যোগদান ছিল জার্মানির জন্য বিরাট হুমকি। অন্যদিকে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক (কম্যুনিস্ট) বিপ্লব হয়। অনেকটাই পরাজিত হয়ে রাশিয়া এ যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। ইতিমধ্যেই তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধে এবং শীতকালে রাশিয়ার অভ্যন্তরে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয় জার্মান সেনাবাহিনী। এ সময় ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে রসদ যোগান দেয়ার অভিযোগে জার্মান সাবমেরিন যখন সাতটি মার্কিন জাহাজ ডুবিয়ে দেয় তখন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়। এরপর সম্মিলিত আক্রমণের ফলে জার্মানির পরাজয় নিশ্চিত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল:
১. যুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে পরাজিত জার্মানিকে ২৬৯ বিলিয়ন ‘গোল্ড মার্ক’ জরিমানা করা হয়, ১৮৭২’র যুদ্ধে জার্মান দখলকৃত ‘আলসাক-লরেন’ এলাকা ফ্রান্স নিয়ে নেয়। জার্মানিকে অস্ত্রহীন করে ফেলা হয় এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যকে একদম খণ্ড খণ্ড করে ফেলা হয়। ২. এ যুদ্ধের পর চারটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। রোমান সাম্রাজ্য ১৯১৭ সালে, জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য ১৯১৮ সালে এবং অটোমান সাম্রাজ্য ১৯২২ সালে। ৩. অস্ট্রিয়া, চেক স্লোভাকিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুনিয়া এবং তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। ৪. অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য বেদখল করা হয় এবং তুরস্কের নানা অংশ দখল করার লক্ষ্যে ব্রিটেন-ফ্রান্স-ইটালী-গ্রিস তুর্কী ভুখণ্ডে ঢুকে যায় (যদিও কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্ক নিজেদের ভূমি রক্ষা করতে সক্ষম হয়)। ৫. ১৯২২ সালে ফ্যাসিস্টরা ইতালির ক্ষমতায় আরোহন করে। আরেকটি বড় ফলাফল হলো- মনরো ডকট্রিন থেকে সরে এসে যুদ্ধের শেষ দিকে যোগ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মুল নায়কের আসনে বসে যায়। যুদ্ধের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের নেতৃত্ব শুরু হয় দুনিয়ায় নতুন ধরনের রাজনীতি। আর উইলসন ছিলেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গণতন্ত্র ও লিবেরালিজমের প্রবক্তা ও বাস্তবায়নের অন্যতম নায়ক।যুদ্ধ পরবর্তীকালীন বিশ্বনেতারা সবাই এই মর্মে একমত হন যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুদ্ধ একটি অভিশাপ। তাই ভবিষ্যতে সরকারব্যবস্থায় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্বচ্ছতার নিশ্চিত করার জন্য গড়ে তোলা হয় ‘লীগ অব নেশন’। অর্থাৎ রাষ্ট্রগুলো ‘রিয়েলিজম’ বা বাস্তববাদের বদলে বিশ্বব্যাপী ‘লিবারেলিজম’ বা উদারতাবাদ গ্রহণে পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু মার্কিন নেতৃত্বে পুরো দুনিয়া বদলে দেবার স্বপ্ন দেখিয়ে ইউরোপ থেকে দেশে ফেরার পর মার্কিন কংগ্রেস উইলসনের সমস্ত পরিকল্পনা খারিজ করে দেয় এবং নিজেদেরকে ইউরোপিয়ান ঝামেলা থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, যা নতুন বিশ্বব্যবস্থা সফল করার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে যায়।
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কাল: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দশ বছর পেরিয়ে যায়। তখনো নির্দিষ্ট যোগ্য কোনো নেতৃত্ব না থাকায় দেশগুলো ‘নিও লিবারেলিজম’ ঠিকমত আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়নি। ফলে ‘লীগ অব নেশন’ কার্যত কাজ করতে পারছিল না। এছাড়া রাষ্ট্রগুলো নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষা করার নীতি গ্রহণ করায় ধীরে ধীরে এ সংস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী ব্রিটেন বা ফ্রান্স আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে এবং নিজ নিজ হিসাব ঠিক রাখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফ্রান্সের লক্ষ্যে ছিল জার্মানির ভবিষ্যত যুদ্ধ করার ক্ষমতা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে, কিন্তু ব্রিটেন হয়তো ‘নেপোলিয়ান’ যুগের কথা স্মরণ করে ‘ব্যালেন্স অব পাওয়ার’ ঠিক রাখার জন্যই জার্মানির সামরিক উপস্থিতির সমর্থন করে। এরফলে জার্মানি আবার নিজেদের সামরিক বাহিনী গঠনের অনুমুতি পায়। এর মাধ্যমে জার্মানির আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ফিরে আসার পথ উন্মুক্ত হয়। এরই মাঝে ১৯৩০ সালের দিকে বিশ্বজুড়ে দেখা দেয় ‘অর্থনৈতিক মহামন্দা’। এ রকম একটি সময়ে ইতালিতে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি এবং জার্মানিতে আবির্ভাব ঘটে এডলফ হিটলারের। অন্যদিকে এশিয়ার শক্তি জাপানও তখন ফ্যাসিস্ট নীতি গ্রহণ করে। এই তিন দেশই মনে করতো, তৎকালীন ব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন এবং ফ্রান্সেরই সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করছে, অন্যদের ঠকাচ্ছে ঐ ব্যবস্থা। প্রথম আগ্রাসী হয় জাপান। তারা ১৯৩১ সালে চীনের মাঞ্চুরিয়া এবং ১৯৩৭ সালে চীনের মূল ভূখণ্ড দখল করে। ইতালি ১৯৩৫ সালে আবিসিনিয়া এবং ১৯৩৯ আলবেনিয়া দখল করে। অন্যদিকে হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি ১৯৩৮ সালে অস্ট্রিয়া দখল করে এবং ১৯৩৯ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় বসবাসরত জার্মানদের নিরাপত্তার অজুহাতে চেকোস্লোভাকিয়াও দখল করে ফেলে।
এখানে হিটলার সম্পর্কে একটু না বললেই নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানিকে যে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপুরণের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় তা জার্মানরা কখনো মেনে নিতে পারেনি। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি তার সম্পদ, সম্মান এবং ক্ষমতার প্রায় সবটুকুই হারিয়ে বসে। এ রকম একটি অবস্থায় হিটলার ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় এসেই ভার্সাই চুক্তির শর্ত ভেঙ্গে ভেতরে ভেতরে জার্মানির সামরিক শক্তিকে সুসজ্জিত করে তোলেন। একইসঙ্গে জার্মানবাসীকে উগ্র জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করেন, তার নাৎসীবাদ প্রচার করতে থাকেন এবং ইহুদী বিরোধী তথা এন্টি সেমিটিজম প্রচারণা অব্যাহত রাখেন। হিটলার লক্ষ করেন, জার্মানির ব্যবসা-বাণিজ্য-সহ অনেক কিছুই ইহুদীরা নিয়ন্ত্রণ করে। তার মতে, জার্মানরা সুপিরিয়র জাতি, তাই তাদের অধিকার রয়েছে বিশ্বকে শাসন করার। এ লক্ষ্য অর্জনে হিটলার চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে জার্মানিকে পুনরায় একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে।এখানে বলে রাখা দরকার যে, হিটলার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারেননি। তাই তিনি ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য জন্য বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করতে এবং তার মতের স্বপক্ষে জনগণকে আনার জন্য বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেন। এরমধ্যে অন্যতম ছিল গোস্টেপো নামের এক পুলিশ বাহিনী গঠন করা, যাদের কাজ ছিলো সক্রিয় নাৎসীবিরোধীদের দমন করা। এছাড়া হিটলার তার প্রপাগান্ডা/প্রচার মন্ত্রী হিসেবে জোসেফ গোয়েবলসকে নিয়োগ দেন। গোয়েবলস হিটলারের পরামর্শে বিরোধীদের সব পত্রিকা বন্ধ করে দেন এবং হিটলারের বক্তব্য শোনানোর জন্য জনগণকে কম দামে রেডিও দেয়ার ব্যবস্থা করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই এই রেডিও জার্মানীকে গ্রাস করে ফেলে। বাইরের জগত, সুস্থ-স্বাভাবিক চিন্তাধারা, মুক্তচিন্তা, সঙ্গীত এসবকিছু বাদ দিয়ে মানুষ বাধ্য হলো শুধু তাদের ফুয়েরার হিটলারের ভাষণ শুনতে। চোখ-কান নিয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক দেহে জন্ম নেয়া জার্মান নাগরিকরা পরিণত হতে থাকলো অন্ধ-বোবা-কালা জাতিতে। গোয়েবলসের নীতি ছিল- মিথ্যা কথাও যদি দশবার বলা হয় তা সত্যে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের আগ মুহূর্তে হিটলার এই গোয়েবলসের হাতেই ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে গোয়েবলস মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ না করে ছয় সন্তানকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিষপ্রয়োগ করে নেতা হিটলারের মতোই আত্মহননের পথ বেছে নেন।আমরা আবার মূল আলোচনায় ফিরে আসি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অর্থাৎ চল্লিশের দশকে পাশ্চাত্য শক্তির সাথে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈরী সর্ম্পক তৈরি হয়। এরফলে সোভিয়েত সরকার ক্রমেই পাশ্চাত্য শক্তি ও নীতির ওপর আস্থা হারাতে থাকে। ১৯৩৮ সালের মিউনিখ চুক্তি অনুযায়ী বৃটেন, ফ্রান্স ও ইতালি যখন হিটলারকে চেকোশ্লাভিয়া অধিকার করার সুযোগ করে দেয় তখন সোভিয়েত সরকার বুঝতে পারে যে, ইউরোপীয় শক্তিগলো তাদের স্বার্থ আদায়ে ব্যস্ত। এমনকি সেই সময় পাশ্চাত্য তোষণনীতি ছিল হিটলার যেন রাশিয়া আক্রমণ করে। এমতাবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ফ্রান্স ও বৃটেনের সাথে সন্ধির মাধ্যমে ত্রিশক্তি গঠনে আগ্রহ প্রকাশ করলেও উভয়ই দেশই অনীহা প্রকাশ করে। সুতরাং সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির আক্রমণ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে ২৩ আগস্ট ১৯৩৯ জার্মানির সাথে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা দেখে পুরো বিশ্ব স্তব্দ হয়ে যায়। এ চুক্তি অনুযায়ী, স্বাক্ষরকারী উভয় পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে কোনোরূপ শক্তি প্রয়োগ ও আক্রমণ থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫):
সোভিয়েতের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যাবার পর ব্রিটেন এবং ফ্রান্স তেমন এখন কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না এমন চিন্তা করে জার্মানি উপরোক্ত চুক্তির একসপ্তাহ পরই ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ড আক্রমণ করে। সাথে সাথে পোল্যান্ডের পক্ষ নিয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করে। হিটলার তার সেনাবাহিনীকে বলকান অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম ইউরোপ অভিমুখে যাত্রা করায়। ফ্রেঞ্চ-ব্রিটিশ সব প্রতিরোধ উড়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে জার্মানি পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ ও হল্যান্ড দখল করে নেয় এবং অনাক্রমণ চুক্তি অনুযায়ী দখলিকৃত দেশগুলো জার্মানি ও সোভিয়েত ভাগ করে নেয়। অন্যদিকে ইতালি জার্মানির সাথে মিত্রজোট গঠন করে এবং জার্মানির পক্ষ হয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়। জার্মান বাহিনী ১৯৪০ সালেই জুলাই মাসের মধ্যে প্যারিস পর্যন্ত দখল করে এবং ব্রিটেনের ওপর ভয়াবহ বিমান হামলা চালায় ফেলে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে জার্মানির কাছে ফ্রান্সের পতন ঘটে। এরপরই হিটলার তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করে বসেন। ১৯৪১ সালে কোনো এক অজানা কারণে হিটলার ব্রিটেন সম্পূর্ণ দখল না করেই সদ্য মিত্ররাষ্ট্র ও বিশাল ভূ-খণ্ডের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসেন (প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় একই ভুল করেছিলেন জার্মান কাইজার দ্বিতীয় উইলহেইম)। হিটলার ভেবেছিলেন রাশিয়া অধিকার করতে পারলে সমগ্র ইউরোপ তার পদানত হবে। জার্মানরা প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলে মস্কোর দিকে। রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করলেও শীত আসতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল জার্মানরা। তারা পিছু হটতে শুরু করল। এই সুযোগে রুশ গেরিলা বাহিনী আঘাত হানতে থাকে। তবে শীত শেষ হতেই জার্মানরা নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলে। রাশিয়ার দক্ষিণে ককেশাস তেলক্ষেত্র-সহ বহু অঞ্চল দখল করে দেয়। তারা রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর প্রান্তে এসে পৌঁছায়, কিন্তু রুশ বাহিনীর মরণপণ সংগ্রাম করে টিকে থাকে।একদিকে যখন সোভিয়েতের সাথে যুদ্ধ চলছে, অন্যদিকে বিশ্বজয়ের স্বপ্নে হিটলার আফ্রিকায় আরেকটি ফ্রন্ট খোলেন। এ সময় জাপান জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। তারা ৭ ডিসেম্বর ১৯৪১ সালে আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দরের ওপর বোমা বর্ষণ করে বন্দরটি বিধ্বস্ত করে ফেলে। এটিও ছিল জার্মান জোটের জন্য আরেকটি বিরাট ভুল। তখন একঘরে নীতি বাদ দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট ব্রিটেন ও সোভিয়েত বাহিনীর সাথে মিত্রতা করে যুদ্ধে যোগ দেয়। জার্মান বাহিনীর সবচেয়ে বড় পরাজয় হয় রাশিয়ার স্ট্যালিনগ্রাদে। দীর্ঘ ছয় মাস যুদ্ধের পর রাশিয়ান লাল ফৌজ লাল ফৌজ স্বদেশভূমি থেকে জার্মান বাহিনীকে সম্পূর্ণ উৎখাত করে ১৯৪৪ সালে একের পর এক অধিকৃত পোল্যান্ড, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া মুক্ত করতে করে এবং জার্মানির মূল ভূখণ্ডে এসে প্রবেশ করে। অন্যদিকে ইংরেজ আর মার্কিন সৈন্যরাও জার্মানির অভিমুখে এগিয়ে চলে।চারদিক থেকে যতই পরাজয়ের সংবাদ আসতে থাকে হিটলার উন্মত্তের মতো হয়ে ওঠেন। ১৯৪৫ সালের ২৯ এপ্রিল হিটলারের শেষ ভরসা স্টেইনের সৈন্যবাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তার অধিকাংশ সঙ্গীই তাকে পরিত্যাগ করে মিত্রপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠায়। হিটলার বুঝতে পারেন তার সব স্বপ্ন চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গেছে। বার্লিনের প্রান্তে রুশ বাহিনীর কামানের গর্জন শোনা যাচ্ছে। হিটলার তার বারো বছরের সঙ্গিনী ইভাকে বার্লিন ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইভা তাকে পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। দুজনে সেদিনই বিয়ে করেন। বিয়ের পর হিটলার উপস্থিত সঙ্গীদের সাথে একসঙ্গে শ্যাম্পেন পান করেন। তারপর দুটি চিঠি লিখলেন। একটি চিঠিতে সবকিছুর জন্য ইহুদিদের অভিযুক্ত করেন। অন্য চিঠিতে নিজের সব সম্পত্তি পার্টিকে দান করেন।৩০ এপ্রিল ১৯৪৫। চারদিক থেকে বার্লিন অবরোধ করে ফেলে লাল ফৌজ। হিটলার বুঝতে পারেন আর অপেক্ষা করা উচিত নয়। যে কোনো মুহূর্তে লাল ফৌজ এসে তাকে বন্দি করতে পারে। তিনি তার ড্রাইভার ও আরো একজনকে বললেন, মৃত্যুর পর যেন তাদের এমনভাবে পোড়ানো হয়, দেহের কোনো অংশ যেন অবশিষ্ট না থাকে। বিকেল সাড়ে তিনটার সময় তিনি নিজের ঘর থেকে বের হয়ে তার অফিসারদের সাথে করমর্দন করে নিজের ঘরে ঢোকার পরপরই গুলির শব্দ শোনা যায়। হিটলার নিজের মুখের মধ্যে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। আর এর আগেই তার সদ্য বিবাহিত বউ ইভা বিষপানে আত্মহত্যা করেন। অন্যদিকে ইতালিতে মুসোলিনিকে বন্দি করা হয় এবং ফ্যাসি বিরোধী জনগণ তাকে প্রকাশ্যে রাস্তায় হত্যা করে। মিত্রশক্তি জাপানকে আত্মসমর্পণ করতে বললে জাপান তা অস্বীকার করে। তখন ৬ ও ৯ আগস্ট ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমানবিক বোমা হামলা হয়। এরপর জার্মানির আত্মসমর্পণের তিন মাস পর মিত্রশক্তির কাছে জাপানের নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ কর। এর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়।এই ভয়াবহ যুদ্ধে আনুমানিক ৬ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ মারা যায়, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল রাশিয়ার নাগরিক। এছাড়া জার্মানিতে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয়, যার একটি বড় অংশ ছিল ইহুদী। বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদী নিহত হয়।
এক নজরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা:১. এই যুদ্ধের ফলে বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আত্মপ্রকাশ করে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশের স্থান হয় দ্বিতীয় সারিতে। ২. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট দল আত্মপ্রকাশ করে। একে কেন্দ্র করে আবার পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহ বিশেষ করে ইউরোপ দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। একদিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি এবং তাঁদের মিত্র দেশগুলোতে, আর অন্যদিকে রাশিয়া, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ। তবে কয়েকটি দেশ নিরপেক্ষ থেকে যায়, ভারত ও যুগোশ্লাভিয়া যার অন্যতম। এভাবে দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের মধ্যে শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ। ৩. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্যবাদী আদর্শ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। চীন (১৯৪৯), পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া ও পূর্ব জার্মানি ইত্যাদি দেশ সাম্যবাদী আদর্শ গ্রহণ করে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ৪. ইতালিতে ফ্যাসিবাদী সরকারের জায়গায় প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। জার্মানি দ্বিখন্ডিত হয়ে পূর্ব জার্মানি এবং পশ্চিম জার্মানি দুটি দেশে বিভক্ত হয়। ৫. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে পরাধীন দেশগুলোতে শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতার লড়াই। বিশেষ করে ব্রিটিশ শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ায় ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকস্তিান স্বাধীনতা অর্জন করে, যদিও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ভারতের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারছিলেন না। ৬. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হয়। ৭. ১৯৪৯ সালে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি নামে দুটো রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ৮. যুদ্ধ এড়িয়ে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ সৃষ্টি হয়।জাতিসংঘ সৃষ্টির বিষয়ে একটু বিস্তারিতভাবে বলা দরকার- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যেই বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার মহান ব্রত নিয়ে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া শুরু হয়। যেমন, লন্ডন ঘোষণা। ১৯৪১ সালে নাৎসিবাহিনীর বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত আর বিমান-আক্রমণের সতর্কতামূলক ধ্বনিতে আতঙ্কগ্রস্ত লন্ডন শহরের জেমস প্রাসাদ। লন্ডনে তখন আশ্রয় নিয়েছে বেলজিয়াম, চেকোশ্লাভাকিয়া-সহ ৮টি নির্বাসিত সরকার। এ রকম একটি অবস্থায় ১৯৪১ সালের ১২ জুন শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে স্বাক্ষরিত হয় লন্ডন ঘোষণা। এ ঘোষণাকে জাতিসংঘ গঠনের প্রাথমিক পদক্ষেপরূপে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এরপর ১৯৪১-এর আগস্ট মাসে অক্ষশক্তি হিটলারের নেতৃত্বে বিপুল পরাক্রমে এগিয়ে চলেছে, হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেছে-এই পরিস্থিতির মধ্যে আটলান্তিক মহাসাগরের একটি জাহাজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য মিলিত হন। মানবজাতির এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনার জন্য তাঁরা ৮টি নীতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ঐ ৮টি নীতিই পরবর্তীকালে জাতিসংঘের মেরুদণ্ডরূপে বিবেচিত হয়েছিল।১৯৪৩ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মস্কো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন ঘোষণা করে যে, জাতিসংঘ গঠন এবং শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য তাঁদের যৌথ প্রয়াস অব্যাহত থাকবে। মস্কো সম্মেলনের পরবর্তী পদক্ষেপ হলো ১৯৪৩-এর নভেম্বর মাসে তেহরানে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী স্তালিনের বৈঠক। এই বৈঠকে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গঠনের সম্ভাব্যতা ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয় এবং এর নানা দিক বিচার-বিশ্লেষণ করেন। জাতিসংঘ গঠনের ক্ষেত্রে আরেকটি অগ্রণী পদক্ষেপ ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে ব্রেটন উডস-এ অনুষ্ঠিত ৪৪টি রাষ্ট্রের সম্মেলন। ঐ সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিবৃন্দ এই ধারণা ব্যক্ত করেন যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও আর্থিক অরাজক অবস্থার অবসান ছাড়া বিশ্বশান্তি স্থায়ী হতে পারে না। এই বিষয়ে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য (বিশেষ করে ইউরোপের) আইবিআরডি (পরে যার নাম হয় বিশ্বব্যাংক) এবং আন্তর্জাতিক অর্থ-তহবিল (আইএমএফ) গঠিত হয়। এরপর ১৯৪৫ সালে অনুষ্ঠিত ইয়াল্টা সম্মেলনে রুজভেল্ট, চার্চিল এবং স্ট্যালিন পরাজিত জার্মানির ভূখণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, জার্মান বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত ইউরোপে শান্তি ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা, পূর্ব ইউরোপ এবং দূরপ্রাচ্যের সমস্যার সমাধান সম্পর্কে আলোচনা করেন। সর্বশেষ ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সানফ্রান্সিসকো সম্মেলনের মাধ্যমেই জাতিসংঘ একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা (বিস্তারিত):
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির চূড়ান্ত পতনের পরে স্ট্যালিন ও ফ্রান্সের দাবি ছিল যে, জার্মানিকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা হবে এবং এর সকল ভারী শিল্প বন্ধ করে দেয়া হবে, যাতে আগামীতে জার্মানি কোনদিন আর যুদ্ধ লাগাতে না পারে। কিন্তু রুজভেল্ট ও চার্চিলের ছিল ভিন্নমত। কারণ তাদের ভয় ছিল জার্মানি যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাহলে কন্টিনেন্টাল ইউরোপে (ইউরোপ মহাদেশের মূল ভূমি) রাশিয়া বেশি ছাড় পেয়ে প্রবেশ করবে, যা তাদের কাম্য নয়। পরে নেয়া এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের অর্ধেকটা রাশিয়াকে দেয়া হয় এবং জার্মানিকে চার ভাগে ভাগাভাগি করে নেয়া হয়। প্রথমে ফ্রান্সের ভাগ ছিল না, পরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নিজেদের ভাগ থেকে ফ্রান্সকে কিছু অংশ দেয়।যুদ্ধের পরেই নীতি-নির্ধারকদের মাথায় চলে আসে আগামীর ভাবনা। মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারক-বাহক যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই পুরো ইউরোপকে নিজেদের বাজার হিসেবে চাইছিল। অপরদিকে সোভিয়েরত ইউনিয়ন তাদের স্বপ্ন কম্যুনিজমে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন ছিল ইউরোপের দেশগুলোকে। মার্কিন সরকার তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে সমাজতন্ত্রের প্রসার রোধ করার জন্য ‘কন্টেইনমেন্ট পলিসি’ গ্রহণ করে। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল– সোভিয়েত সীমান্তে পুঁজিবাদী দেশগুলো দ্বারা বৃত্ত রচনা করা। এই লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে কম্যুনিজম প্রসারের জন্য অন্যতম উর্বর ভূমি গ্রীস এবং তুরস্কের জন্য ‘ট্রুম্যান ডকট্রিন’ নামের এক অর্থ-সাহায্যের পরিকল্পনা গ্রহণ করে মার্কিন সরকার। যার মাধ্যমে গ্রীস এবং তুরস্ককে ৪০০ মিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্য দেয়া হয়। ট্রুম্যানের এই বিশাল আর্থিক সাহায্যের কারণে দুটি দেশই তথাকথিত মুক্তবিশ্বের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। এবং এই ট্রুম্যান ডকট্রিনের ফলে সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ প্রথম প্রকাশ্যে এসে যায়। এরপর ১৯৪৮ সালে মার্কিন সরকার নিয়ে আসে আরও বড় পরিকল্পনা (১৩ বিলিয়ন ডলারের), যা ‘মার্শাল প্ল্যান’ নামে পরচিতি। এটি নির্দিষ্ট কোনো দেশের জন্য নয়, বরং ছিল সামগ্রিকভাবে ‘ক্ষুধা, দারিদ্র, বিশৃংখলা’ মোকাবিলার উদ্দেশ্যে। সোভিয়তে নিয়ন্ত্রণে থাকা র্পূব ইউরোপ এবং সোভয়িতেও এই পরিকল্পনার বাইরে ছিল না। কিন্তু স্ট্যালিন এই পরিকল্পনা নাকচ করে দেন। কারণ এর একটি শর্ত ছিল যে, অভ্যন্তরীণ সকল অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশ করতে হবে। স্ট্যালিন সোভিয়েত রাশিয়ার ভেতরের দুর্বল আর্থিক দৈন্যতা প্রকাশে রাজী হলেন না এবং পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশগুলোকেও এতে অংশ নিতে বিরত রাখলেন। কিন্তু মার্শাল প্ল্যানের দ্বারা ফ্রান্স-সহ সকল পশ্চিম ইউরোপিয়ান দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে চলে আসে। এরপর মার্কিন ও সোভিয়েতের দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ র্জামানিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার পরিবর্তে ১৯৪৯ সালে পশ্চিম ও র্পূব জার্মানি নামে দুটো রাষ্ট্রের জন্ম হয়।ট্রুম্যান ও মার্শাল প্ল্যান দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের অর্থনীতির লাগাম ধরে আর্থিকভাবে ইউরোপকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করে। এরপর তারা পরিকল্পনা নেয় সামরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। ১৯৪৯ সালে ১১টি দেশ নিয়ে গঠন করা হয় সামরিক জোট ন্যাটো। গ্রীস, তুর্কী এবং পশ্চিম জার্মানিও পরে এ জোটে যোগ দেয়। ন্যাটোর মূলনীতি হচ্ছে- একের উপর হামলা সকলের উপর হামলা বলে গণ্য হবে। ন্যাটো গঠনের প্রতিক্রিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন র্পূব ইউরোপের দেশগুলোকে নিয়ে আরেকটি সামরিক জোট গঠন করে, যার নাম ‘ওয়ার স প্যাক্ট’। এর জোটের লক্ষ্য ছিল- ন্যাটোর পক্ষ থেকে আসার যেকোনো হামলা প্রতিরোধ করা। এসব পদক্ষেপের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ আরও স্পষ্ট হয়ে যায়।
আমরা অনেকেই জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৪৫) পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের মধ্যে চলে স্নায়ুযুদ্ধ। এই পুরো সময়টাকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি, যথা- ১. সরাসরি বিরোধিতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান (১৯৪৫-১৯৬২) ২. দাঁতাত বা আপেক্ষিক শান্তিপূর্ণ সময় (১৯৬৩-১৯৭৮) ৩. উত্তেজনাপূর্ণ সময় এবং স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি (১৯৭৯-১৯৯১)।
একনজরে ১৯৫০-২০১৬ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনা: আমরা আমাদের আলোচনাকে একটি যৌক্তিক ও সম্পূর্ণ রূপ দেয়ার জন্য একনজরে ১৯৫০-২০১৬ পর্যন্ত সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এখানে আলোচনা করে নিবো— ১. পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন (১৯৫৪) এবং ১৯৫৮ সালে স্বৈরশাসক আউয়ুব খানের পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল; ২. বিপ্লবের মাধ্যমে কিউবায় ফিদেল কাস্ট্রোর ক্ষমতা গ্রহণ (১৯৫৯); ৩. কিউবার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কচ্ছেদ (১৯৬১) এবং কিউবান মিসাইল সংকটকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে যায় (১৯৬২); ৪. চীন-ভারত যুদ্ধ (১৯৬২); ৫. পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ (১৯৬৫); ৬. ভিয়েতনাম যুদ্ধ (১৯৬৩-১৯৭৫); ৭. আরব-ইসরাইল যুদ্ধ (১৯৬৭ ও ১৯৭৩); ৭. যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরস্পরকে স্বীকৃতি প্রদান এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন (১৯৭৯); ৮. সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে গর্বাচেভের ক্ষমতা গ্রহণ (১৯৮৫) এবং সেখানে বহুদলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন (১৯৮৯); ৯. ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখল (১৯৯০) এবং কুয়েতকে মুক্ত করার জন্য উপ-সাগরীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয় (১৯৯১); ১০. আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে নতুন করে ১৫টি প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা ঘোষণা (১৯৯১); ১১. দুই জার্মানির পুনঃএকত্রিকরণ (১৯৯০); ১২. ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরিওতে প্রথম ধরিত্রী সম্মেলন (১৯৯২); ১৩. বসনিয়ায় ন্যাটোর হস্তক্ষেপ (১৯৯৬); ১৪. বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে জাতিসংঘের উদ্যোগে কিয়োটো চুক্তি স্বাক্ষর (১৯৯৭); ১৫. হংকং চীনের কাছে প্রত্যাবর্তন (১৯৯৭); ১৬. পূর্ব তিমুরে স্বাধীনতার পক্ষে গণভোট (১৯৯৯); ১৭. ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কারগিল যুদ্ধ (১৯৯৯); ১৮. ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন ইন্তিফাদা (১৯৮৭-১৯৯৩); ১৯. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) গ্রহণ (২০০০); ২০. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে সন্ত্রাসী বিমান হামলা এবং এরপর আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা (২০০১); ২১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাকে হামলা (২০০৩); ২২. পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামার ক্ষমতায় আরোহন (২০০৯); ২৩. জাপানকে টপকে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অর্থনীতিতে পরিণত হয় চীন (২০১০); ২৪. তিউনিসিয়া থেকে আরব বসন্ত শুরু (২০১০), যা পরবর্তীতে লিবিয়া, মিশর, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে; ২৫. লিবিয়াতে মুয়াম্মার গাদ্দাফীর পতন (২০১১) এবং মিশরে নির্বাচিত মুরসি সরকারকে হটিয়ে জেনারেল সিসির ক্ষমতা দখল (২০১৩); ২৬. ক্রিমিয়া সংকট (২০১৪); ২৭. জাতিসংঘের হিসাবে, পাঁচ বছর ধরে (২০১১-২০১৬) চলমান গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারায় চার লাখ মানুষ; ২৮. সিরিয়া ও ইরাকে আইএসআই (ইসলামিক স্টেট) এর উত্থান।শেষকথা: ৯০’র দশকের শুরুতে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয় এবং বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক মেরুকরণ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। স্নায়ুযুদ্ধের পর ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা নামের একজন পণ্ডিত ব্যক্তি ‘End of History’ নামে একটি তত্ত্ব পেশ করেন। এ তত্ত্বে তিনি উল্লেখ করেন, স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শকে মোকাবিলা করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল। কিন্তু এখন কেউ নেই। তাই বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শই প্রতিফলিত হবে। র্অথাৎ আগামী শতাব্দি হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু তা হয়নি। ২০০১ সালেই আক্রান্ত হয় দেশটি। এরপর অতিমাত্রায় যুদ্ধের দিকে ঝুঁকে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যা দেশটির অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে। বিপরীতে অর্থনৈতিকভাবে চীন এবং পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার পুনরুত্থান এবং একটি সংঘটিত শক্তি হিসেবে ইউরোপিয় ইউনিয়নের উপস্থিতি প্রমাণ করে বর্তমান বিশ্ব আর এক মেরুর বিশ্ব নয়, বরং বহু মেরুর বিশ্ব।
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০১৬