তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে লাভবান হতে পারে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ এবং তুরস্কের মধ্যে গভীর এবং সময়োত্তীর্ণ পরীক্ষিত বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক বিরাজমান। বাংলাদেশের মানুষ আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্ককে যথেষ্ট সম্মানের সাথে স্মরণ রেখেছে এবং সম্মান দেখিয়েছে। তাঁর স্মরণে ফেনীর দাগনভূঁইয়ায় ১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘আতাতুর্ক মডেল হাই স্কুল’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮২ ও ১৯৯৮ সালে যথাক্রমে ঢাকায় ও চট্টগ্রামে ‘মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক’ এর নামে দুটি সড়কের নামকরণ করে। অন্যদিকে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে দুটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কামাল আতাতুর্ক এর কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘আমার কামাল পাশা’ নামে একটি কবিতা রচনা করেন।

১৯৭৪ সালে প্রথম বাংলাদেশ এবং তুরস্কের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তুরস্ক ১৯৭৬ সালে ঢাকায় তার দূতাবাস স্থাপন করে এবং ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সে দেশের রাজধানী আঙ্কারায় তার দূতাবাস স্থাপন করে। দু দেশের মধ্যকার ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণে তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় নেই। ১৯৯৭ সালে ইস্তাম্বুলে গঠিত ডি-৮ জোটের সদস্য হিসেবে তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশ ও অভিন্ন চেতনা ও উন্নয়ন কৌশলের অংশীদার। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে তুর্কী প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেল বাংলাদেশ সফরে আসেন। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে তুরস্ক যান। এসব সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর
এ বছরের (২০১০) ফেব্র“য়ারিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল দু দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। এ সফরের মধ্য দিয়ে দু দেশের সম্পর্ক আরও সংহত, ফলপ্রসূ ও ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তুর্কী প্রেসিডেন্ট একটি বড় প্রতিনিধিদল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার এ সফরের মূল লক্ষ্য ছিল দু দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়ন। সফরে এসে বাংলাদেশে ১০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য সহায়তার ঘোষণা দেন তুর্কী প্রেসিডেন্ট, যা বাংলাদেশের প্রতি ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্কেরই প্রমাণ। উল্লেখ্য, গত বছরের নভেম্বরে ওআইসির এক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান তুর্কী প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালে তিনি তা গ্রহণ করেন। এ সফর ছিল তারই ধারাবাহিকতা। তুরস্ক সরকারি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে যে কতটা গুরুত্ব দেয়, তা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে অনেকটা প্রমাণিত হয়।

দু দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিসমুহ:
দু দেশের মধ্যে ইতোমধ্যে বেশকিছু চুক্তি ও এগ্রিমেন্ট সাধিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু চুক্তির বর্ণনা নিচে দেয়া হলো-
ক. ২৭ জুলাই ১৯৭৬           বাণিজ্য চুক্তি
খ. ৯ মার্চ ১৯৭৯               অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা চুক্তি
গ. ৯ মার্চ ১৯৮১                সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি
ঘ. ১২ নভেম্বর ১৯৮৭          পারস্পরিক বিনিয়োগ বিষয়ক চুক্তি
ঙ. ১৪ মে ১৯৯৩               প্রযুক্তিগত সহায়তা চুক্তি
চ. ২৫ মার্চ ১৯৯৭              সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি
ছ. ২৫ মার্চ ১৯৯৭              বেসামরিক বিমান পরিবহন চুক্তি
জ. ১৭ জুলাই ১৯৯৭           কারিগরি ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা
ঝ. ৩১ অক্টোবর ১৯৯৯         দ্বৈতকর পরিহার সংক্রান্ত চুক্তি
ঞ. ১ এপ্রিল ২০০২           সামরিক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান বিষয়ক সহযোগিতা চুক্তি।

যদিও তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক একটি অবিচলিত গতিতে উন্নত হয়েছে, তবে এ সম্পর্কের পূর্ণ সম্ভাবনা এখনও কাজে লাগানো যায়নি। দু দেশের সম্পর্ক বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরও উন্নত করা দরকার। প্রসঙ্গত, তুরস্ক এবং বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের অর্থনীতিবিদগণ ৯০’র দশকে সম্পাদিত যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন (ঔঊঈ) কাঠামোর অধীনে বছরে দু বার মিলিত হয়। যদিও দু দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ভলিউম সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উর্দ্ধগামী প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে, তবে এটি এখনো লক্ষ্যমাত্রার নিচে অবস্থান করছে। তুরস্কে তৈরি পোশাক রফতানির কারণে বাণিজ্য ভারসাম্য বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান করছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, গত মে মাস পর্যন্ত তুরস্কে পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৭০ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরে রফতানির পরিমাণ ছিল ৩১ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য:
বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের বাণিজ্যের পরিমাণ গত ১০ বছরে ৪০ ধাপ অগ্রসর হয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধির গতি অব্যাহত রয়েছে। ২০১০ সালে দু দেশের মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৬৫৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার। আর এটা এখন প্রথমবারের মত ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ২০০৬ সাল থেকে বাণিজ্য ভারসাম্য বাংলাদেশের পক্ষে রয়েছে, যা ২০১০ সালে ৬৫৮ মিলিয়ন ডলার পৌঁছেছে।

আশা করা হচ্ছে যে, তুর্কি বিনিয়োগের কারণে বাংলাদেশে তুরস্কের বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে তুরস্কে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণ করার কারণে তুর্কি আমদানিকারকদের  বাংলাদেশ সম্পর্কে সম্ভাব্য ভাল ধারণা প্রদান করবে।

দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা:
দু দেশের মধ্যকার দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার লক্ষ্যে যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন (ঔঊঈ) এর তৃতীয় সভা ২০০৯ সালের ১৮-১৯ নভেম্বর তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় অনুষ্ঠিত হয়।

দু দেশের মধ্যকার পর্যটন:
২০০৮, ২০০৯, ও ২০১০ সালে যথাক্রমে ২.৯৫০, ৩.৫৯৯, এবং ২.১৯০ মিলিয়ন বাংলাদেশি নাগরিক তুরস্ক ভ্রমণ করেন।

বিমান চলাচল:
তুর্কি এয়ারলাইনসের বিমান গত ২৬ ডিসেম্বর ২০১০ সাল থেকে ইস্তাম্বুল থেকে করাচি হয়ে ঢাকায় চলাচল শুরু করেছে। ঢাকা-ইস্তাম্বুল তুর্কী বিমান ফ্লাইট চালু হওয়ায় দু দেশের যোগাযোগ আরও সহজ ও সুগম হবে। এটা বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণে বিশেষ অবদান রাখবে।

বাণিজ্যের প্রধান পণ্যসমুহ:
বাংলাদেশ তুরস্কে প্রধানত রফতানি করে পাট, পাটজাত পণ্য, তৈরি পোশাক, কৃত্রিম আঁশ এবং জুতা ইত্যাদি।  আর তুরস্ক বাংলাদেশে প্রধানত রফতানি করে যন্ত্রপাতি এবং যানবাহন, লোহা এবং ইস্পাত ও রাসায়নিক দ্রব্য, ডাল, লোহা, মার্বেল, এ্যালমুনিয়াম এবং গ্লাস।

বাংলাদেশে তুর্কি বিনিয়োগ:
তুর্কি উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে আটটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে, তারমধ্যে দুটিতে সম্পূর্ণ তুর্কি মালিকানা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে তুর্কি বিনিয়োগের মোট পরিমাণ ৪ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যেখানে ৩ হাজার ৮শত এরও অধিক মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের দু দিনব্যাপী বাংলাদেশ সফরে তুরস্ক বাংলাদেশের সঙ্গে তার বর্তমান বাণিজ্যকে ৬০ কোটি ডলার থেকে বছরে ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার কথা বলেছে। পারস্পরিক স্বার্থে এই সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও অর্থবহ ও ফলপ্রসূ হতে থাকবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি তুর্কি কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে। কিছু তুর্কি কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের লিয়াজোঁ অফিস খুলছে। যৌথ উদ্যোগে বহু কারখানা এবং ক্রমবর্ধমানভাবে বাংলাদেশে তুরস্কের নতুন কোম্পানি গড়ে উঠছে। দশটিরও বেশি তুর্কি কোম্পানি বাংলাদেশে বিভিন্ন খাত যেমন তৈরি পোশাক, কার্পেট এবং শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

পরিশেষে এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থলে অবস্থিত তুরস্ক ‘রুগ্নদেশের’ অপবাদ ঘুচিয়ে অনেক আগেই উন্নয়নশীল দেশের শীর্ষ তালিকায় উন্নীত হয়েছে। তাই এ দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেনদেনের ক্ষেত্রগুলো অনুসন্ধান করে তার সদ্ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের রেল ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে তুরস্কের প্রযুক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা বাংলাদেশের রেল ব্যবস্থার উন্নতি ঘটতে পারে। নদী ড্রেজিং ও নির্মাণ শিল্পেও তুরস্ক ইউরোপীয় মানের জ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে। উভয় দেশেই উভয়ের জন্য বড় ধরনের বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলোর উদ্ভাবন ও ব্যবহারে দু দেশকেই সচেতন ও আগ্রহী হতে হবে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন, পরিবহন, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে তুরস্ক বাংলাদেশকে অর্থবহ সহায়তা দিতে পারে। এছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, ওআইসিকে শক্তিশালীকরণসহ মুসলিম দেশ হিসেবে একে অপরকে সহযোগিতা দু দেশকেই সমৃদ্ধ করতে পারে।

রাজনৈতিক ডটকম, ১২ মার্চ ২০১০

Leave a Reply

Your email address will not be published.