এক.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে অর্থাৎ আগামী ১০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাচ্ছেন। সফরে শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং কতগুলো চুক্তিতে সই করবেন। এগুলো হলো- বিদ্যুৎ চুক্তি, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মোটরযান চলাচল বিষয়ে চুক্তি, অপরাধ দমন বিষয়ক পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি, সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের বিনিময় বিষয়ক চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সংঘটিত অপরাধ ও অবৈধ মাদক পাচার বন্ধ বিষয়ক দ্বি-পক্ষীয় চুক্তি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে এ পর্যন্ত চূড়ান্ত যে তিনটি চুক্তির কথা আমরা জানতে পেরেছি, তাতে বাংলাদেশের পাবার কী আছে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য যৌক্তিক পথ বের না করে উল্টো তা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে আমাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ কেন ভারতের বঞ্চনা ও নিপীড়নের দ্বারা সৃষ্ট জাতিগত ক্ষোভ ও প্রতিরোধ প্রচেষ্টাকে একই চোখে একটি ‘সন্ত্রাসী’ তৎপরতা হিসেবে দেখে তাকে নিজের জন্য বিপদ বাড়ানোর ব্যবস্থা করবে? ভারত যেখানে রাজনীতিক সমাধান বের করতে পারছে না সেখানে কেন আমরা এর মধ্যে একটি পক্ষ হতে যাব? মনে রাখতে হবে, আমাদেরকেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ইস্যুকে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের পথ বের করতে হয়েছে। ভারতের কাছে বিদ্রোহীদের হস্তান্তর দাবি বা নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে সন্ত্রাস দমনের কায়দায় সমাধান হয়নি। সেটা কার্যকরও হতো না। ভারতের দমন নীতি বাস্তবায়নের সহযোগী হয়ে বাংলাদেশও কোনোভাবেই বিপদজ্জনক ভারসাম্যহীনতায় প্রবেশ করতে পারে না। এতে শেষ পর্যন্ত কেউই লাভবান হবে না।
দুই.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহুল আলোচিত ভারত সফরে সবকিছু ছাপিয়ে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন এবং বিদ্যুৎ বিনিময়ই এখন বাংলাদেশের জন্য প্রধান ইস্যু। যেভাবেই হোক, আসন্ন সফরে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে একটি চুক্তির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ঢাকা। পররাষ্ট্র ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তিস্তার ব্যাপারে একটি নাটকীয় অগ্রগতি আশা করা হচ্ছে আসন্ন সফরে। শীর্ষ রাজনৈতিক পর্যায়ে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে একটি সমঝোতা হতে পারে। দীর্ঘ ২৭ বছর পর তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
তিস্তার পানি বণ্টন বিষয় নিয়ে আলোচনা, ইতিবাচক অগ্রগতি এবং একটি চুক্তি হবে, এমনটিই বাংলাদেশ আশা করছে। আর তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি যেন ফারাক্কার পানি বণ্টন চুক্তির মত না হয়, সেটাও বাংলাদেশ আশা করে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে ভারতের কাছে আবেদন করে আসছে। গত চারদলীয় জোট সরকারের সময় যৌথ নদী কমিশন-জেআরসি’র মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। কিন্তু ভারত ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। ভারত তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উজানে ভারত তিস্তা নদীতে ১৯৯০ সালে গজল ডোবায় বাঁধ দেয়। এরপর আরও দুটি বাঁধ সম্পন্ন করেছে এবং ৪নং বাঁধের কাজ চলছে। ভারত উজানে বাঁধ দিয়ে তিস্তার পানি সরিয়ে নিচ্ছে। অপরদিকে বাংলাদেশ পানি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিস্তা সেচ প্রকল্প এরই মধ্যে অকেজো হয়ে গেছে।
তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তাব গতমাসে ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। খসড়া প্রস্তাবে তিস্তার পানি সমান ভাগাভাগির প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ এলাকা ভারতের অংশ বেশি হলেও ভাটির দেশ হিসেবে পানির প্রয়োজন ভারতের চেয়ে আমাদেরই বেশি। এজন্য বাংলাদেশের খসড়া প্রস্তাবে তিস্তার পানি সমান ভাগাভাগির কথা বলা হয়েছে। আমরা যে তিস্তা নদীর পানি পাওয়ার অধিকার রাখি, ভারত এটিই মানতে রাজি নয়। তাদের এটি বোঝাতে হবে যে, তিস্তা নদীর পানি পাওয়ার অধিকার রাখি এবং এ নদীর পানি ছাড়া আমাদের উত্তরাঞ্চলের জীববৈচিত্র টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হবে।
উত্তরাঞ্চলে বন্যার প্রকোপ কমানো এবং তিস্তার পানি ব্যবহার করে সেচ সুবিধা বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ১৯৭৯ সালে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৯০ সালে ব্যারেজের নির্মাণ কাজ শেখ হওয়ার পর ১৯৯৩ সাল থেকে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়। দুই পর্যায়ে তিস্তা ব্যারেজে মোট সাড়ে সাত লাখ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে। বর্তমানে তিস্তা ব্যারেজের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে। বাংলাদেশ তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ শুরু করলে ভারতও এর উজানে গজালডোবা ব্যারেজ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার করে নেয়, আবার বর্ষা মৌসুমে যখন পানির প্রবাহ বাড়ে তখন গজালডোবা ব্যারেজের সবগুলো গেট খুলে দেয়। ফলে তিস্তা অববাহিকায় দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় তিস্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ-ভারত মন্ত্রী পর্যায়ে তিস্তার পানি বণ্টনে শতাংশভিত্তিক একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী তিস্তার পানির শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ, ৩৯ ভাগ ভারত এবং বাকি ২৫ ভাগ সংরক্ষিত থাকার কথা বলা হয়। কিন্তু তিস্তার পানিপ্রবাহের পরিমাণ কত এবং কোন জায়গায় পানি ভাগাভাগি হবে, সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে। পানি বিশেষজ্ঞরা জানান, ১৯৫২ সাল থেকে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দু দেশের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। তিস্তার উজানে এবং ভাটিতে দুটি বাঁধ থাকলেও উজানের দেশ বলে এবং শক্তিশালী অবকাঠামো থাকার কারণে ভারত ইচ্ছা করলে নদীর সব পানি নিয়ে নিতে পারে। এজন্য তিস্তার উজানে জলাধার নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু, তিস্তার প্রবাহ বাড়ানো এবং শুকনো মৌসুমে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ যাতে তিস্তা থেকে পর্যাপ্ত পানি পায়, সে ব্যাপারে চুক্তিতে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশের নদীগুলোর প্রধান উৎস হলো হিমালয় পর্বতমালা। বাংলাদেশের বুকে বয়ে চলেছে প্রায় ৭১০টি নদ-নদী, যার মধ্যে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী। এই ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ৫৪টি নদী ভারতের সঙ্গে এবং ৩টি মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকাগুলোর সর্বনিম্নে অবস্থিত। বৃহৎ এ অঞ্চলের মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এলাকা বাংলাদেশে পড়েছে। তিস্তার মতো ভারত থেকে বাংলাদেশে আগত ৫৪টি যৌথ নদী নিয়ে একই রকম সমস্যা রয়েছে। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ চালু, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প এবং সাম্প্রতিক সময়ে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত এ সমস্যাকে জটিলতর করে তোলে। তবে তিস্তা চুক্তির মধ্য দিয়ে প্রতিবেশী দু দেশের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ও বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ হবে বলে আশাবাদী বিশ্লেষকরা।
সবকিছু মাথায় রেখেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাচ্ছেন। ভয় হয় আরেকটি ফারাক্কা বা তিন বিঘা করিডোর প্রশ্ন জন্ম না হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দয়া করে এমন কিছু করবেন না যাতে পদ্মায় আরেকটি চর জাগে। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে শেখ হাসিনা নিজে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার সঙ্গে ফারাক্কায় গঙ্গার পানি বণ্টন সম্বন্ধে যে চুক্তি করেছিলেন সে চুক্তি মোতাবেক গঙ্গার পানি বাংলাদেশ কোনো বছরই পায়নি।
তিন.
প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের সময় বিদ্যুৎ বিনিময় সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সই হবে। ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিনিময় সংক্রান্ত প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। এ প্রস্তাবে ভারত থেকে সম্মত দামে বিদ্যুৎ আমদানি ও রফতানি এবং যৌথ অর্থায়নে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। চুক্তির স্মারকে আরও বলা হয়েছে, ত্রিপুরায় নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ভারত সন্ধ্যায় বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দেবে। আর বাংলাদেশ ওই বিদ্যুৎ দিনের বেলায় ভারতকে দেবে।
একটি বিষয় লক্ষণীয়, ভারত থেকে তো বাংলাদেশ শুধু বিদ্যুৎ আমদানি করার কথাই বলছে না, ভারতকেও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ দেবে। তাহলে কি আমরা ধরে নিচ্ছি, বিদ্যুৎ কেনা বাংলাদেশের জন্য তখনই সম্ভব হবে যদি বাংলাদেশ বিনিময়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎ বেচতে রাজি হয়। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশ শুধুই ঠকে যেতে পারে। তারা আমাদের কাছে সামান্য বিদ্যুৎ বেচে শেষ পর্যন্ত আমাদের গ্রিড লাইন ব্যবহার করে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে কানেক্টিভিটি নিতে চায়। ভারতের অনেক শহর রয়েছে যেখানে নিয়মিত বিদ্যুৎ নেই। এর ওপর ভারতে শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটছে। ভারতে উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের পাওয়ার ট্যারিফ বেশি। এ অবস্থায় ভারত আমাদের দেশের মূল্যে কোন যুক্তিতে বিদ্যুৎ বিক্রি করবে তা স্পষ্ট নয়।
ভারত বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রয় করে শুধু বেশি দামই আদায় করবে না, তার সঙ্গে অনেক বেশি ফায়দা তুলে নেবে। ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, মনিপুরে ২০২০ সালের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যাচ্ছে। আঞ্চলিকভাবে এই বিদ্যুতের ১০ থেকে ২০ শতাংশের বেশি চাহিদা উত্তর-পূর্ব ভারতে নেই। ভারত এই অঞ্চলে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় শিল্পোন্নত রাজ্যগুলোতে নিতে চাচ্ছে। ভারতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও বেশি। এ কারণে তার নিজস্ব বিদ্যুৎ চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে। কিন্তু উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ পশ্চিমাঞ্চলে সরবরাহ করতে হলে যে ট্রান্সমিশন লাইন এবং সংযোগ প্লান্ট করতে হবে সেটা বাংলাদেশের মধ্য দিয়েই করতে হবে। সঙ্কীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরে সেটা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ যদি ভারতকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করে তাহলে সেটি হবে ভারতকে কার্যত বিদ্যুৎ করিডোর দেয়া। এই বিদ্যুৎ করিডোর পেলে ভারতের জন্য কত বড় পাওয়া হবে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। ভারতকে এই সুযোগটি দেয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কোনো প্রকার ভাড়া দাবি করছে কি? এটি আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিষয়। এর পাশাপাশি কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন- বাংলাদেশ যদি কখনও বর্তমানে অনুসৃত দিল্লিমুখী পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন ঘটায় তাহলে ভারতের আচরণ কী হবে? সেক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ বঞ্চিত করে জিম্মি করে ফেলতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা। অতীতে ভারত বাংলাদেশের প্রতি যে ধরনের আচরণ করেছে তার ভিত্তিতে এরকম আশঙ্কা করা অমূলক নয়।
এদিকে ভারতের সঙ্গে আসন্ন বিদ্যুৎ বিনিময় চুক্তির বিভিন্ন দিক ও ভারত কর্তৃক অতীতে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তি লঙ্ঘনের উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের ন্যাশনাল গ্রিডকে ভারত ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যেই এগুচ্ছে।
সাবেক একজন বিদ্যুৎ সচিব আ.ন.হ আখতার হোসেন ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বলেন, ‘ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের সমঝোতা চুক্তি হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আমাদের অতীত চুক্তির রেকর্ডগুলো ভালো নয়। বিভিন্ন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যত চুক্তি হয়েছে তার সবই ভারত ভঙ্গ করেছে। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করার ব্যাপারে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। ভারতের সীমান্ত এলাকা বহরমপুর, জলপাইগুড়ি ও বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, জলপাইগুড়ি এলাকা নির্ধারণ করে ভারতের সঙ্গে চুক্তি হলে আমরা নেপাল ও ভুটান থেকেও বিদ্যুৎ আমদানির সুযোগ পাব। এজন্য বাংলাদেশকে চুক্তি করতে হলে ওই বিষয়টিও উল্লেখ করতে হবে। কিন্তু জলপাইগুড়ি বাদ দিয়ে ভারত বরাবরই বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা দিয়ে বিদ্যুৎ রফতানির ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।’ তিনি বলেন, ‘ভারত আগামী ২০২০ সালের মধ্যে তাদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে হাইড্রোলিক পাওয়ার প্লান্টসহ বিভিন্ন প্লান্টের মাধ্যমে কম খরচে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। উৎপাদিত বিদ্যুতের ২০ ভাগও তাদের ওইসব অঞ্চলে চাহিদা নেই। ফলে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ তারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তাদের পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে নিতে আগ্রহী। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিনিময় চুক্তির উদ্দেশ্য যদি এটাই হয় তাহলে ভারত বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করবে। এ থেকে বাংলাদেশ কোনো সুবিধা পাবে না। এটি একটি আইওয়াশ ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিনিময়ের ব্যাপারটি যত সহজ সরল মনে হয় তত সহজ সরল নয়।’
বাংলাদেশের মানুষ আশা করে, দিল্লিতে ভারতীয় নেতাদের পাশে বসে, তাদের সঙ্গে কথা বলে শেখ হাসিনা কৃতার্থ হয়ে যাবেন না, বাংলাদেশের মানুষ কী চায়, তাদের স্বার্থ কোথায় নিহিত, সেসব কথা তিনি সেখানে বলে আসবেন। প্রধানমন্ত্রীকে একজন দায়িত্বশীল প্রধানমন্ত্রীর মতো কথা বলতে হবে। অর্থাৎ সার্বভৌম রাষ্টের ১৫ কোটি মানুষের মুখপাত্র হয়ে প্রকৃত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দেশের স্বার্থে অবদান রাখতে পারলেই প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে স্বাগত জানাবে জনগণ। ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার’ নিয়েও তারা তখন গর্ববোধ করবে।
চিন্তা, ৬ জানুয়ারি ২০১০