চীন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ছাড়িয়ে যেতে পারবে?

চীনের মত এশীয় রাষ্ট্রগুলোর উত্থানের সাক্ষী হয়ে থাকছে একবিংশ শতাব্দী। উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা অঞ্চলের শিল্প বিপ্লবে এগিয়ে থাকা এবং নিজস্ব সমস্যার কারণে এশিয়া পিছিয়ে ছিল – বিশ্ব অর্থনীতিতে ২০ শতাংশ মাত্র অবদান ছিল। পরে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশ দুনিয়ার অর্থনীতির অন্যতম শক্তি হয়ে ওঠে। আর অনেক দেরিতে শুরু হলেও গত ৩৫ বছরে বিশ্ব পুঁজির প্রতিযোগিতায় সামনে চলে এসেছে।

২০১০ সালে জাপানকে অতিক্রম করে দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে চীন। ২০১০ সালে জাপানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৪৭ ট্রিলিয়ন ডলার এবং চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৮০ ট্রিলিয়ন ডলার।  জাপানের রফতানি এবং ভোগ্যপণ্যের চাহিদাও কমেছে। অপরদিকে চীনের উৎপাদন ব্যাপক বেড়েছে।

চার দশক পর জাপান বিশ্ব অর্থনীতির দ্বিতীয় অবস্থান থেকে সরে পড়ল। তবে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চীনের মানুষের জীবনমান বাড়েনি। সেখানকার অধিকাংশ মানুষ এখনো গরীব। শহর থেকে শহরতলীতে বেশি মানুষ বাস করে। মাথাপিছু বিত্তের পরিমাণের দিক থেকে গড়ে জাপান অনেক এগিয়ে আছে চীনের থেকে।

অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার এখন চীনের পণ্যের দখলে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বিশ্বের সবচেয়ে জনসংখ্যাবহুল চীনের বাজারে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার কোটি ইউএস ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশ হচ্ছে চীন। তবে নিজের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা চালু রাখার জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধরে রাখার দরকার চীনের পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব না।

‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল’-আইএমএফ গত এপ্রিলে ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ প্রতিবেদনে বলেছে, আগামী ২০১৬ সালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ছুঁয়ে ফেলবে চীনের অর্থনীতি। আইএমএফ-এর পর্যব্বেণ অনুযায়ী, প্রকৃত অর্থে চীনের অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ছাড়িয়ে যাবে আজ থেকে পাঁচ বছর পর – ২০১৬ সালে। চলতি বছর চীনের অর্থনীতি ১১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার, ২০১৬ সালে সেটি হবে ১৯ ট্রিলিয়ন ডলার। একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ১৫ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারে। অথচ এই মানদণ্ডে দশ বছর আগেই মার্কিন অর্থনীতির আয়তন ছিল চীনের অর্থনীতির তিনগুণ। প্রতিদিন ব্যবধান কমতে কমতে মার্কিন অর্থনীতির অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে চীন।

অন্যদিকে বিনিয়োগ ব্যাংক ‘গোল্ডম্যান স্যাচ (Goldman Sachs)’ বলছে, ২০২৭ সালের মধ্যে চীন ছাড়িয়ে যাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে। এমনকি চীনের মোট জিডিপি (Gross Domestic Product) ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান হতে পারে। সমসাময়িককালে উদীয়মান রাষ্ট্রগুলো আমদানিকৃত প্রযুক্তি থেকে সুবিধা নিয়ে অর্থনীতির বিস্তৃতি ও গতি বাড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের প্রবৃদ্ধির হার সাধারণভাবে খুবই ধীরগতির। একইভাবে চীনের অর্থনীতিও স্বাভাবিকভাবে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনে মারাত্বক বাঁধার মুখে পড়ছে। সরকারি মালিকানার প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণগ্রস্ত অবস্থায় থাকা, অভ্যন্তরীণভাবে অভিবাসনের মাত্রা বেশি হওয়া, সামাজিক সুরক্ষার অপর্যাপ্ততা, দুর্নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিকতার অভাব; এসব মিলে চীনের মত দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে পারে।

তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে চীনের অর্থনীতি সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে, বিস্তারে ও গতিতে। সামনে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ; দেশটির অর্থনীতি ব্যাপকভাবে রফতানি ও বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল, এই কারণে ব্যাপক আকারে অভ্যন্তরীণ ভোগ বাড়ানো উৎসাহিত করা দরকার। ওদিকে দেশটির বর্তমান মুদ্রানীতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বেইজিংয়ের তীব্র বিতর্ক আছে। তাদের অভিযোগ- চীন তার রপ্তানি জোরদার করতে কৃত্রিমভাবে নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানের মান কমিয়ে রাখছে।

গত এক দশক ধরে দুনিয়ার নয়টি রপ্তানিকারক দেশের একেবারে সামনে অবস্থান করছে চীন। কিন্তু দেশটির রপ্তানি উদ্বৃত্তের ওপর গড়ে ওঠা অর্থনীতির আদলটি বিশ্ব বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে সাংর্ঘষিক হয়ে ওঠার আগেই সমন্বয় করা দরকার। এই দরকার চীন নিজেও উপলব্ধি করছে বলে মনে হচ্ছে। দেশটিতে চলমান ১২তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে- রপ্তানি নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানো। এই উদ্দেশ্য অর্জন করা কি সম্ভব এই পাঁচসালা পরিকল্পনায়? কিংবা পরের পাঁচ বছরে? চীনের বর্তমান সরকারকে সফল হতেই হবে এক্ষেত্রে। কারণ যেই সমাজতন্ত্রের নাম করে দেশটিতে কর্তৃত্ববাদী ও একদলীয় শাসন চালানো হচ্ছে, তার পেছনের ন্যায্যতা আকারে ‘সমাজতন্ত্র’ অনেক আগেই হাওয়ায় মিলিয়েছে। এই অবস্থায় বর্তমান শাসকবর্গের ক্ষমতায় থাকার একমাত্র অবলম্বন হল জাতীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করা এবং জাতীয়তাবাদী চেতনা সামনে নিয়ে আসা।
(জোসেফ নাই-এর লেখা অবলম্বনে)

রাজনৈতিক ডটকম, ১০ মে ২০১১

Leave a Reply

Your email address will not be published.