প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও অন্তর্বর্তীকালীন ফলাফল

শুরুর কথা: আলোচনাকে বোঝার জন্য শুরুতেই আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলনীতি নিয়ে কিছু কথা বলবো। আমরা জানি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো স্থায়ী শত্র“ বা মিত্র নেই, আন্তর্জাতিক রাজনীতি’র মূলনীতিই হলো– ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতা এবং ‘ব্যালেন্স অব পাওয়ার’! মানে, কোনো রাষ্ট্রই আসলে চায় না অন্য কোনো একটি রাষ্ট্র এতটা শক্তিশালী হোক, যে রাষ্ট্র আগামীতে সে দেশের জন্য হুমকির কারণ হবে। এই যে অপর রাষ্ট্র থেকে হুমকি সম্মুখীন হওয়া, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই কিন্তু রাষ্ট্রগুলো নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং অন্য রাষ্ট্রের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তোলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমরা সে চিত্রই দেখতে পাবো।

যাই হোক, আমরা এবার সরাসরি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আলোচনায় চলে আসি। বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেস-এপি’র মতে, গত বিংশ শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ আটটি ঘটনার একটি হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথমে ইউরোপ জুড়ে এ যুদ্ধ শুরু হয়। ১১ নভেম্বর ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলে এই যুদ্ধ। এ যুদ্ধকে গ্রেট ওয়ার বা ইউরোপিয়ান ওয়ারও বলা হয়।

এ যুদ্ধ শুরু হওয়ার একটি দীর্ঘ প্রেক্ষাপট বা পটভূমি রয়েছে। শুরু করবো উনবিংশ শতাব্দি থেকে। উনবিংশ শতাব্দিতে ব্রিটেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড, স্পেন ও পর্তুগাল তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি ও শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ করার জন্য দক্ষিণ এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকাতে তাদের সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটায়। যে কারণে ১৮৭০ সাল থেকে ১৯১৪ সালের সময়সীমাকে ‘অমব ড়ভ ওসঢ়বৎরধষরংস’ বলা হয়। এছাড়া এ সময় ইউরোপে ব্যাপক শিল্পায়ন হয়, শিল্পায়নের ফলে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিস্তার ঘটে। সে সময় উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতির অংশ হিসেবে জার্মানি নৌ-শক্তি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়। এতে ব্রিটেন শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এরফলে ব্রিটেন জার্মানির সাথে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং নিঃসঙ্গতা পরিহার করে ফ্রান্সের সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে ১৯০৭ সালে রাশিয়া-ফ্রান্স-ব্রিটেন মিলে ‘ট্রিপল আঁতাত’ গড়ে উঠে। এ জোটের বিপরীতে প্রিন্স বিসমার্কের নেতৃত্বে জার্মানি অস্ট্রিয়া ও ইতালি সাথে ত্রিশক্তির মৈত্রী গড়ে তোলে। আমরা একটু আগে ফ্রান্সের নেতৃত্বে যে ‘ট্রিপল আঁতাতে’র কথা বলেছিলাম তা ছিল তারই পাল্টা প্রতিক্রিয়া। এই দুই জোটের পরস্পর বিরোধী কর্মকাণ্ডই প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপট বা তৎকালীন ক্ষমতার চিত্র:
ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ১৮৭১ সাল থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত বড় কোনো যুদ্ধ হয়নি। তাই এ সময়কালকে শান্তিপূর্ণ যুগ বলা হয়। কিন্তু এ সময়ই বিভিন্ন রাষ্ট্র গোপনে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। যেমন, বিসমার্কের নেতৃত্বে জার্মানি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিসমার্কের পর ১৮৯৮ এ ক্ষমতায় এসেই উচ্চাকাঙ্খী সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলহামের মনে ইউরোপের বাইরেও সাম্রাজ্য স্থাপনের খায়েশ জাগে।

অপরদিকে রাশিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের এলাকায় নিজ প্রভাব বিস্তারের দিকে নজর দেন। অন্যদিকে ব্রিটেন ছিল শক্তিশালী নৌ-শক্তির অধিকারী। সে সময় অস্ট্রো-হাঙ্গেরী ও অটোমান সাম্রাজ্য দুটিও শক্তিশালী অবস্থানে ছিল। কিন্তু সেইসময় পতনের মুখে থাকায় তারা জার্মানির সাহায্যে হারানো ক্ষমতা ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখতে থাকে। অন্যদিকে ফ্রান্স তখন আফ্রিকায় তার উপনিবেশ থেকে প্রাপ্ত সম্পদের কারণে বেশ ভাল অবস্থায় ছিল। কিন্তু একটি শক্তিশালী জার্মানি মানেই তাদের ভয়াবহ ক্ষতিÑ ব্রিটেনের মত তারাও এটাও অনুধাবন করে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এবং ভৌগোলিক ও সামরিক শক্তি ব্যাপক থাকলেও ১৮২৩ সালের ‘মনরো ডকট্রিন’ অনুযায়ী তাদের নীতি ছিল যে কোনো ইউরোপিয়ান ঝামেলার বাইরে থাকা।

প্র্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮):
এই রকম একটি অবস্থায় ১৯১৪ সালের ২৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রানৎস ফার্ডিনান্ড এক সার্বিয়ান আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারে অস্ট্রিয়া কিছু শর্ত বেঁধে দেয়। কিন্তু সার্বিয়া সব শর্ত মানতে অস্বীকার করলে ওই বছরের ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ সময় জার্মান সম্রাট উইলহেইম অস্ট্রিয়াকে সম্পূর্ণ সমর্থন দেয়। অস্ট্রিয়া সার্বিয়া আক্রমণের পরপরই জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্স ও রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আগের একটি চুক্তি অনুযায়ী অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে জার্মানি নিরপেক্ষ বেলজিয়াম আক্রমণ করলে পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঘোষণা করে। যুদ্ধ শুরু হয় পুরো ইউরোপ জুড়ে। যুদ্ধের পূর্বে জার্মানির ধারণা ছিল যে, সার্বিয়ার বিরুদ্ধে একটি সংক্ষিপ্ত ও আঞ্চলিক যুদ্ধে বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তারা অস্ট্রিয়াকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সার্বিয়ায় হামলা করার অনুমুতি দিয়ে দেয়, যা ছিল বিরাট ভুল। তবে যুদ্ধের প্রথমদিকেই যোগ দেয়া রাশিয়া এবং ফ্রান্সকে ভালভাবেই মোকাবিলা করছিল জার্মানি। কিন্তু যুদ্ধে ব্রিটেনের যোগদান ছিল জার্মানির জন্য বিরাট হুমকি। অন্যদিকে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক (কম্যুনিস্ট) বিপ্লব হয়। অনেকটাই পরাজিত হয়ে রাশিয়া এ যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। ইতিমধ্যেই তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধে এবং শীতকালে রাশিয়ার অভ্যন্তরে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয় জার্মান সেনাবাহিনী। এ সময় ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে রসদ যোগান দেয়ার অভিযোগে জার্মান সাবমেরিন যখন সাতটি মার্কিন জাহাজ ডুবিয়ে দেয় তখন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়। এরপর সম্মিলিত আক্রমণের ফলে জার্মানির পরাজয় নিশ্চিত হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল:
১. যুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে পরাজিত জার্মানিকে ২৬৯ বিলিয়ন ‘গোল্ড মার্ক’ জরিমানা করা হয়, ১৮৭২’র যুদ্ধে জার্মান দখলকৃত ‘আলসাক-লরেন’ এলাকা ফ্রান্স নিয়ে নেয় এবং জার্মানিকে অস্ত্রহীন করে ফেলা হয়। অর্থাৎ ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানিকে কোনঠাসা করে ফেলা হয়, যা হিটলারের মাধ্যমে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দেয়। ২. এ যুদ্ধের পর চারটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। রোমান সাম্রাজ্য ১৯১৭ সালে, জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য ১৯১৮ সালে এবং অটোমান সাম্রাজ্য ১৯২২ সালে। এরমধ্যে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যকে একদম খণ্ড খণ্ড করে ফেলা হয়। ৩. অস্ট্রিয়া, চেক স্লোভাকিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুনিয়া এবং তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। ৪. অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য বেদখল করা হয় এবং তুরস্কের নানা অংশ দখল করার লক্ষ্যে ব্রিটেন-ফ্রান্স-ইতালি-গ্রিস তুর্কী ভুখণ্ডে ঢুকে যায় (যদিও কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্ক নিজেদের ভূমি রক্ষা করতে সক্ষম হয়)। ৫. ১৯২২ সালে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিস্টরা ইতালির ক্ষমতায় আরোহন করে।

আরেকটি বড় ফলাফল হলো- মনরো ডকট্রিন থেকে সরে এসে যুদ্ধের শেষ দিকে যোগ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মুল নায়কের আসনে বসে যায়। যুদ্ধের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের নেতৃত্ব শুরু হয় দুনিয়ায় নতুন ধরনের রাজনীতি। আর উইলসন ছিলেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গণতন্ত্র ও লিবেরালিজমের প্রবক্তা ও বাস্তবায়নের অন্যতম নায়ক। যুদ্ধ পরবর্তীকালীন বিশ্বনেতারা সবাই এই মর্মে একমত হন যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুদ্ধ একটি অভিশাপ। তাই ভবিষ্যতে সরকারব্যবস্থায় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্বচ্ছতার নিশ্চিত করার জন্য গড়ে তোলা হয় ‘লীগ অব নেশন’। অর্থাৎ রাষ্ট্রগুলো ‘রিয়েলিজম’ বা বাস্তববাদের বদলে বিশ্বব্যাপী ‘লিবারেলিজম’ বা উদারতাবাদ গ্রহণে পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু মার্কিন নেতৃত্বে পুরো দুনিয়া বদলে দেবার স্বপ্ন দেখিয়ে ইউরোপ থেকে দেশে ফেরার পর মার্কিন সিনেট ভার্সাই চুক্তি অনুমোদন না করায় (ভার্সাই চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল ‘লীগ অব নেশন’ গঠন করা) উইলসনের সমস্ত পরিকল্পনা খারিজ করে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে ইউরোপিয়ান ঝামেলা থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, যা নতুন বিশ্বব্যবস্থা সফল করার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ববাসী ধারণা করেছিল যে, বিশ্ববাসীকে আর যুদ্ধের অভিশাপ বইতে হবে না। কিন্তু লীগ অব নেশনস-এর একটি কার্যকরী বিশ্বসংস্থা হয়ে উঠতে না পারা, ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানিকে কোনঠাসা করে ফেলা এবং জার্মানি ও ইতালিতে যথাক্রমে হিটলার ও মুসোলীনির নেতৃত্বে ফ্যাসিজমের উত্থান আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করে। আজ এ পর্যন্ত। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

২০ এপ্রিল ২০১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published.