জাতি গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা

১৯২১ সালের ১ জুলাই পূর্ববঙ্গের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৮৮ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বৃটিশ উপনিবেশ নিয়ন্ত্রিত সমাজে স্বাধীন, স্বাবলম্বী জাতিসত্তা বিনির্মাণের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৯১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় পূর্ববঙ্গের বিশেষত মুসলিম সমাজের মধ্যে যেক’টি দাবি খুব আলোচিত হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। ১৯১২ সালে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় এলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ৩১ জানুয়ারি ভাইসরয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতে মিলিত হন। তাঁরা পূর্ববঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা ও দাবি উপস্থাপন করেন। লর্ড হার্ডিঞ্জ এতে ইতিবাচক সাড়া দেন। ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক সরকারি ঘোষণায় ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি স্বীকৃত হয়।

১৯১২ সালের ২৭ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিস্তারিত প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য ১৩ সদস্য বিশিষ্ট নাথান কমিটি গঠন করা হয়। দীর্ঘ মতবিনিময়, আলাপ, আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের পর এ কমিশন ঢাকায় একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করে। ১৯২০ সালে ভারতীয় আইনসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট পাস করা হয়। এর ফলে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইনগত ভিত্তি স্থাপিত হয়। ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর পি. জে হার্টজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

ঢাকা শহরের রমনা এলাকার ৬০০ একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ১৯২১ সালের ১ জুলাই থেকে ৩টি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৪৭ জন শিক্ষার্থী এবং ৩টি আবাসিক হল নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান তার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। ছাত্র-শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রমের ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড অভিধায় ভূষিত হয়। তৎকালীন পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হওয়ায় ঔপনিবেশিক মানসিকতামুক্ত নতুন শ্রেণি সৃষ্টির পথ প্রশস্ত হয়। শিক্ষাকে কেবল বুদ্ধিবৃত্তির বাহন হিসেবে নয়, সমাজ ও মানুষের সামগ্রিক কল্যাণের লক্ষ্যে শিক্ষার প্রয়োগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে ওঠে। সমাজের সীমিত সংখ্যক মানুষের শিক্ষার সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল না। বিশ্বজ্ঞানের সঙ্গে ব্যক্তিমনের সমন্বয় ঘটানোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়।

প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা এবং রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান ও চর্চার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা-চেতনার গভীরে শেকড় সঞ্চার করেই বিকশিত হয়েছে আমাদের জাতিসত্তা ও স্বাধিকার চেতনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁদের কীর্তি ও খ্যাতি ধ্র“বপদের মতো আজো উচ্চারিত হয় তাদের কয়েকজন হলেনÑ সত্যেন বসু, হরপ্রাসাদ শাস্ত্রী, রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, জোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা এবং অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে জনগণের অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামের উৎস ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গা ঘেঁষে যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানÑসেখানেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পঞ্চাশের দশকে ঔপনিবেশিক শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পূর্ব বাংলার জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে সেখানকার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে এক তাৎপর্যময় ঘটনা। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের বৃহত্তর রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতি দানের জন্য যে মরণপণ সংগ্রাম সূচিত হয় তার সঙ্গে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সুগভীর সম্পর্ক। একইভাবে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল অসামান্য।

১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তান সরকার এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানলে ছাত্র-জনতা দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনসহ ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন পরিণত হয় জাতীয় আন্দোলনে। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। অভূতপূর্ব এ আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নিলে স্বৈরশাসনের অবসান হয়।

পূর্ব বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ২ মার্চ প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কার্যাবলী পরিচালিত হতো সার্জেন্ট জহুরুল হক হল থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড সত্ত্বেও তারা দমে না গিয়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দান করেন। ছিনিয়ে আনেন বাংলার স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য।

এরপর ১৯৮২ ও ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলন ও জাতীয় বিভিন্ন দুর্যোগকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় জাতির নির্দেশকের ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাস এক এবং অভিন্ন। নদীর সঙ্গে নগরের যেমন সম্পর্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক তেমনি। নদী না থাকলে যেমন ঢাকা নগরী গড়ে উঠতো না, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না হলে বাংলাদেশ নামক সমাজ ও রাষ্ট্রের এতো উন্নতি হতো কিনা সন্দেহ।

যায় যায় দিন, ১৫ অক্টোবর, ২০০৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *