বর্তমানে ছাত্ররাজনীতিতে ‘আদর্শের অনুপস্থিতি’ দেখে বেদনাহত রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতির পর্যবেক্ষণ, দেশের ছাত্ররাজনীতি এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ নির্ভর’ হয়ে পড়েছে। প্রসঙ্গত, ১৩ জানুয়ারি ২০১৫ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯তম সমাবর্তনে এসে তিনি তাঁর এ অনুভূতির কথা জানান। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি না জানালেও অনেকেই মনে করেন, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আইন করে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা দরকার। আবার কেউ বলছেন, ছাত্ররাজনীতিকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ না করে বরং লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা ছিল গৌরবদীপ্ত। দেশে ছাত্ররাজনীতির সূচনা হয় প্রগতিশীল দর্শন তথা জীননের মননশীল বাস্তবায়নে অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা পালন কাজ করার জন্য। এবং ছাত্ররাজনীতি সে ভূমিকা পালনও করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়– বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান সৃষ্টি, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন এবং ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের স্বপক্ষে সংগ্রাম, সর্বোপরি ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের অসাধারণ ভূমিকা কথা। বিশেষ করে স্বাধীনতাকালীন সময়ে ছাত্র সংগ্রামের পরিষদের ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মত। স্বাধীনতা পরবর্র্তী সময়েও ছাত্রদের অধিকার আদায় ছাড়াও ছাত্রনেতারা শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত রাখেন। সময়ের ধারাবাহিকতায় গৌরবোজ্জল ঐতিহ্যের অংশীদার ছাত্ররাজনীতি হয়ে পড়ে বিতর্কিত।
মূলত ছাত্ররাজনীতির চরিত্রে বড় ধরনের নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে ১৯৭৬ সালে প্রধান সামরিক শাসক বিচারপতি এএসএম সায়েম কর্তৃক ঘোষিত পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশন, ১৯৭৬’র মাধ্যমে। এ রেগুলেশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় অঙ্গ সংগঠন অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে এ রেগুলেশনের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ, ১৯৭৮ জারি করেন। এর মাধ্যমেও রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের আইনি বৈধতা দেয়া হয়, যার ফল শুভ হয়নি। এর ফলে কোনো কোনো ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির সঙ্গে নিন্দনীয়ভাবে জড়িত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক ভূমিকার কারণে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধিত) অধ্যাদেশ ২০০৮-এ নিবন্ধিত দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন রাখা বেআইনি ঘোষণা করা হয়। অধ্যাদেশের ৯০বি ধারায় বলা হয়Ñ ‘যদি কোনো রাজনৈতিক দল… কমিশনের অধীনে নিবন্ধিত হতে চায়, তাহলে তার গঠনতন্ত্রে নিম্নের সুস্পষ্ট বিধান থাকতে হবেÑ যেমন… ৯০বি (১) (খ) (ররর) কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক অথবা ছাত্র অথবা আর্থিক, বাণিজ্যিক অথবা শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তা অথবা শ্রমিকদের অথবা অন্য কোনো পেশার সদস্যদের নিয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ রাখবার; তবে শর্ত থাকে যে, কোনো কিছুই তাদেরকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সংগঠিত হবার অথবা সংগঠন, সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদি গঠন করবার এবং সকল প্রকার গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চা করবার এবং ব্যক্তি হিসেবে, বিদ্যমান আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে, কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হবার ক্ষেত্রে বাধা হবে না।’
কিন্তু দেখা গেছে, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো উপরোক্ত আইনটির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে তাদের ছাত্র সংগঠনকে টিকিয়ে রেখেছে। এক্ষেত্রে দলগুলো কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোকে অঙ্গসংগঠনের পরিবর্তে সহযোগী সংগঠন বলে আখ্যায়িত করছে, যদিও আইন অনুযায়ী উভয় ধরনের সংগঠনই বেআইনি। আর আমাদের নির্বাচন কমিশনও এর বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।
স্বাধীনতা পূর্ব ছাত্র সংগঠনগুলো ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগী সংগঠন। কিন্তু বর্তমানে এগুলো মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ সংগঠন রূপে কাজ করছে। সংক্ষেপে বলা যায়, বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি মূলত রাজনৈতিক দলের ছোট একটি অংশ। এগুলো মূলত বিশেষ গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে দলীয় কার্যক্রম। এসব কার্যক্রম থেকে লাভবান হয় রাজনৈতিক দল ও তথাকথিত ছাত্রনেতারা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে এটি একটি মৌলিক পরিবর্তন। কোনো একটি রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠন ও অঙ্গ সংগঠন হওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে, যে কারণে ছাত্ররাজনীতিতে এখন সব ক্ষমতার উৎস রাজনৈতিক নেতারা, ছাত্ররা নয়। এ লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির ফলে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে মাঝে মধ্যেই দেখা দেয় সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য, যার নেতিবাচক প্রভাবে দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছাত্ররাজনীতির এই অবক্ষয়ের ফলে বহু প্রতিভা অকালে ঝরে পড়েছে এবং সেশনজটের কবলে পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে বহু ছাত্র-ছাত্রীর জীবনের মূল্যবান সময়। উদাহরণস্বরূপ, ২১ নভেম্বর, ২০১৪ যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘সিলেটে ২৬ বছরে ছাত্র রাজনীতির বলি ৪৬ জন।’
সংবিধান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনুযায়ী, ছাত্ররা রাজনীতি করার অধিকার রাখে। কিন্তু ছাত্রদের এই রাজনীতি হওয়া দরকার গঠনমূলক। শিক্ষা ও শিক্ষার্থী বিষয়ক সর্বপ্রকার উপাদানসমূহ তথা ছাত্রদের অধিকার আদায় হবে তাদের ইস্যু ও এজেন্ডা। তাদের জন্য ছাত্র সংসদ বা ইউনিয়ন থাকবে, তবে তা হবে তাদের জন্য প্রযোজ্য ও গ্রহণযোগ্য নীতির ভেতরে। সুস্থ প্রতিযোগিতাকেন্দ্রিক ও কল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডনির্ভর বিজয় ও শ্রেষ্ঠত্ব্ অর্জনই হবে ছাত্ররাজনীতির ইশতেহার।
শিক্ষাঙ্গন হলো মানুষ গড়ার আঙ্গিনা। তাই এই আঙ্গিনায় উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা আবশ্যক, যাতে ছাত্ররা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি একটি বড় বাধা। তাই আমাদের অনুধাবন করা দরকার যে, যতদিন লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি থাকবে, ততদিন ছাত্র সংসদকেন্দ্রিক সুস্থধারার ছাত্ররাজনীতি গড়ে উঠবে না, বাধাগ্রস্ত হবে শিক্ষার্থীদের প্রতিভা বিকশিত হওয়ার পরিবেশ। শিক্ষাঙ্গনে শান্তি আসবে না এবং আসবে না শিক্ষার মানে উন্নতি। তাই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির পরিবর্তে সত্যিকারের কল্যাণমুখী ছাত্ররাজনীতির বিকাশ ঘটনো আবশ্যক। তবে এটিও মনে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি ঐতিহাসিক রূপ ছাত্ররাজনীতি। একে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হলে এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আরও অসার ও বিকৃত হয়ে ওঠতে পারে।
সংবিধান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনুযায়ী, ছাত্ররা রাজনীতি করার অধিকার রাখে। কিন্তু ছাত্রদের এই রাজনীতি হওয়া দরকার গঠনমূলক। শিক্ষা ও শিক্ষার্থী বিষয়ক সর্বপ্রকার উপাদানসমূহ তথা ছাত্রদের অধিকার আদায় হবে তাদের ইস্যু ও এজেন্ডা। তাদের জন্য ছাত্র সংসদ বা ইউনিয়ন থাকবে, তবে তা হবে তাদের জন্য প্রযোজ্য ও গ্রহণযোগ্য নীতির ভেতরে। সুস্থ প্রতিযোগিতাকেন্দ্রিক ও কল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডনির্ভর বিজয় ও শ্রেষ্ঠত্ব্ অর্জনই হবে ছাত্ররাজনীতির ইশতেহার।
শিক্ষাঙ্গন হলো মানুষ গড়ার আঙ্গিনা। তাই এই আঙ্গিনায় উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা আবশ্যক, যাতে ছাত্ররা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি একটি বড় বাধা। তাই আমাদের অনুধাবন করা দরকার যে, যতদিন লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি থাকবে, ততদিন ছাত্র সংসদকেন্দ্রিক সুস্থধারার ছাত্ররাজনীতি গড়ে উঠবে না, বাধাগ্রস্ত হবে শিক্ষার্থীদের প্রতিভা বিকশিত হওয়ার পরিবেশ। শিক্ষাঙ্গনে শান্তি আসবে না এবং আসবে না শিক্ষার মানে উন্নতি। তাই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির পরিবর্তে সত্যিকারের কল্যাণমুখী ছাত্ররাজনীতির বিকাশ ঘটনো আবশ্যক। তবে এটিও মনে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি ঐতিহাসিক রূপ ছাত্ররাজনীতি। একে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হলে এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আরও অসার ও বিকৃত হয়ে ওঠতে পারে।
প্রকাশকাল: ১০ জানুয়ারি ২০১০ (বর্তমান নিবন্ধের আংশিক যায় যায় দিন এ প্রকাশিত)