চাই প্রতিযোগিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন

আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা ও মতবিনিময়ের জন্য সম্প্রতি বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসি থেকে প্রেরিত এক চিঠিতে মির্জা ফখরুল-সহ বিএনপির অন্যান্য নেতা ও সমমনা দলগুলোর নেতাদের নিয়ে আলোচনার আমন্ত্রণ জানানো হয়। অন্যদিকে ইসির চিঠি হাতে পেলেও আলোচনায় যাবে না বলে জানিয়েছে বিএনপি। দলটি বলছে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করা অনর্থক।

বিএনপিকে আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। কারণ দেশের অন্যতম বৃহত্তম দল বিএনপি কিংবা তাদের জোটকে বাদ দিয়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হলে তা প্রতিযোগিতমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা নিয়ে আমাদের মধ্যে ব্যাপক সংশয় রয়েছে। আরও সংশয় রয়েছে বিএনপির সঙ্গে প্রস্তাবিত আলোচনার সফলতা নিয়ে।

বর্তমান কমিশন গঠনের পর পরই অর্থাৎ গত বছরের জুলাইয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছিল ইসি। তখনও নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আলোচনার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিল বিএনপি। যদিও ইসি বলছে, এই দাবির বিষয়ে তাদের কিছু করার নেই এবং বিএনপির দাবি ও রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে ইসির কোনো বক্তব্যও নেই। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিল তাতে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের পরিবর্তে ‘ইচ্ছুক দলগুলোকে’ নিয়ে নির্বাচন আয়োজনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে কমিশন।

১ জানুয়ারি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ‘কোনো রাজনৈতিক দলকে ধরে-বেঁধে নির্বাচনে আনবে না কমিশন’ বলে মন্তব্য করেছিলেন নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান (ইত্তেফাক, ১ জানুয়ারি ২০২৩)। একইভাবে ২৩ মার্চ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ‘নির্বাচনের মাঠে কাউকে (রাজনৈতিক দল) আনা নির্বাচন কমিশনের কাজ না’ বলে মন্তব্য করেন নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা (যুগান্তর, ২৪ মার্চ ২০২৩)। কমিশনের এই অবস্থান ও কমিশনারদের বক্তব্য নিঃসন্দেহে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কমিশনের সদিচ্ছার নিদর্শন নয়।

আমাদের সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আর এ নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতমূলক তথা গ্রহণযোগ্য। বস্তুত, নির্বাচন মানেই প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন — বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পের মধ্য থেকে বেছে নেওয়া। যেখানে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পের মধ্য থেকে — যেমন, কমলা বনাম আপেলের মধ্য থেকে — বেছে নেওয়া সুযোগ থাকে না, তাকে নির্বাচন বলা যায় না। আর আমাদের সাংবিধানিক কাঠামোতে ‘নির্বাচন’ মানেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন। তাই সবার অংশগ্রহণে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে কমিশনের যে সাংবিধানিক ম্যান্ডেট রয়েছে তা তারা উপেক্ষা করতে পারে না। সুতরাং কমিশনের পক্ষ থেকে বলার কোনো সুযোগ নেই যে তারা শুধু ইচ্ছুক দলগুলো নিয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহী এবং কাউকে নির্বাচনে আনা তাদের দায়িত্ব নয়। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি সাবেক সিইসি মোহাম্মদ আবু হেনা বলেছিলেন, ‘নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হয়, তাহলে সে নির্বাচন অর্থহীন। আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে সবার আস্থা অর্জন করতে হবে। তাদের কাজের মাধ্যমে দেখাতে হবে যে তারা আন্তরিক।’

আমরা সবাই জানি, গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। আর সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত ও কার্যকর করে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। তবে নির্বাচন একটি প্রক্রিয়া — একদিনের বিষয় নয়। আর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু মানদ- রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মানদ-গুলো হলো: (১) যথাযথ আইনি কাঠামো, (২) ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ প্রক্রিয়ায় যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য ছিলেন তারা ভোটার হতে পেরেছেন; (৩) যারা প্রার্থী হতে চেয়েছেন তারা প্রার্থী হতে পেরেছেন; (৪) ভোটারদের সামনে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থী ছিল; (৫) নির্বাচনী এলাকার সীমানা কতগুলো মানদ-ের ভিত্তিতে সঠিকভাবে নিধারিত হয়েছে (৬) জেনে-শুনে-বুঝে সঠিকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য ছিল, (৭) যারা ভোট দিতে চেয়েছেন তাঁরা ভয়-ভীতর উর্ধে উঠে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পেরেছেন; (৮) অর্থ কিংবা সহিংসতার মাধ্যমে ভোটদের প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল, (৯) ভোট গননা সঠিকভাবে হয়েছে, (১০) নির্বাচনী বিরোধ দ্রুততার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে মীমাংসিত হয়েছে, সর্বোপরি (১১) ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া ছিল স্বচ্ছ, কারসাজিমুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য।

এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সবার অংশগ্রহণে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে নির্বাচনের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকে না, সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত হয় না, সর্বোপরি সেই নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না এবং দেশে দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি (ষষ্ঠ) ও ২০১৪ সালের ০৫ জানুয়ারির (দশম) একতরফা নির্বাচন। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জন করায় সেই নির্বাচনে ৪৯ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এত ভোট পড়ার হার ছিল মাত্র ২১ শতাংশ। নির্বাচনের পর ষষ্ঠ সংসদ মাত্র ১১ দিন স্থায়ী ছিল। তবে ঐ একতরফা ‘নির্বাচনের’ মাধ্যমে গঠিত সংসদ যে ভাল কাজটি করেছিল তা হলো সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল, ১৯৯৬-এর (সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা) অনুমোদন, যা ছিল প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে একটি ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’। আর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-সহ ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করায় ১৫৩ আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হন, ৯ কোটি ১৯ লাখ ভোটারের মধ্যে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান অবশিষ্ট ৪ কোটি ৩৯ লাখ এবং প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ছিল ৪০ শতাংশ, যার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এর বিপরীতে অর্থাৎ সব দলের অংশগ্রহণে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা যায়, তাহলে সে নির্বাচনে সবাই ভোট দিতে পারেন, নির্বাচনটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং সেই নির্বাচন গণতন্ত্রকে সংহত করে।

এটি সুস্পষ্ট যে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য কমিশনকে রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এ আস্থা অর্জন হলেই সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে এবং সবার জন্য সুযোগের সমতা বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হবে। নির্বাচন কমিশনের কর্তব্য হবে লোকদেখানো কৌশলী খেলায় অবতীর্ণ না হয়ে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দলগুলো যাতে একটি সমঝোতায় উপনীত হয় সে লক্ষ্যে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা। বিশেষত ক্ষমতাসীন দলকে বলা যে, বর্তমান সাংঠনিক কাঠামোতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, গত দুটি নির্বাচনের ন্যায়, বিতর্কিত হতে বাধ্য, যার ফলে কমিশনের পক্ষে তার সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট পূরণ করা সম্ভব হবে না। তাই ক্ষমতাসীন দলকেই, যারা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে ‘অস্ত্রে’ পরিণত করেছে — বিএনপি-সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সতিকারের সংলাপের আয়োজন করতে হবে, যাতে আরেকটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তোলা যায়। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে যা থাকতে পারে তা হলো: ১. নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে ঐকমত্য, ২. সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার, ৩. জাতীয় সংসদ, নির্বাচন কমিশন-সহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা, কার্যকারিতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অর্জন, ৪. আইনের শাসন নিশ্চিত ও মানবাধিকার সংরক্ষণ, ৫. রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ইত্যাদি। আর এসব বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত হতে পাওে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক স্বাক্ষরিত একটি ‘জাতীয় সনদে’।

আশা করি, কমিশন দায়িত্বশীল বক্তব্য দিবে, জনগণের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হবে, সর্বোপরি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রতিযোগিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে সংশ্লিষ্ট সবাই যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। একইসাথে ইভিএম ব্যবহারের অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।

০১ জুলাই ২০২৩

(বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে সংগ্রহ করুন নেসার আমিনের লেখা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ও ফলাফল’। ৯২৮ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। প্রচ্ছদ মূল্য: ৩,২০০ টাকা)

Leave a Reply

Your email address will not be published.