গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় বিভিন্ন রকমের সরকার পদ্ধতি বিদ্যমান রয়েছে। তবে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য দুটি সরকার ব্যবস্থা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি এবং সংসদীয় পদ্ধতি। সংসদীয় পদ্ধতিতে আবার দুটি ভিন্ন নির্বাচন পদ্ধতি রয়েছে। একটি হলো সহজ ভোটাধিক্য পদ্ধতি, অর্থাৎ ভোট প্রাপ্তির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ধারণের নির্বাচন, যাকে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (এফপিটিপি) পদ্ধতির নির্বাচন বলা হয়। আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটিকে ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ভিত্তিক নির্বাচন বলা হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ‘একক নির্বাচনী আসন’ ও সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করছে। যদিও বিভিন্ন মহল দেশে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণের দাবি করে আসছে। কারণ গণতন্ত্রচর্চায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি একটি কার্যকর পন্থা। এ পদ্ধতিতে ভোটের অনুপাতে দেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দল ও শ্রেণীর প্রতিনিধিদের জাতীয় সংসদে আসার সুযোগ তৈরি হয়, যা সংসদকে আরো কার্যকর ও সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে প্রতিটি সংসদীয় বা নির্বাচনী এলাকায় ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংসদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো গঠিত হয়। শুনতে সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার মনে হলেও আদতে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে, এমনকি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলেও ‘সংখ্যালঘিষ্ঠের’ সরকারই গঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সপ্তম ও নবম সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৩৭ দশমিক ৪৪ ও ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ ভোটপ্রাপ্ত হয়ে যথাক্রমে ১৪৬ ও ২৩০টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। উল্লিখিত দুটি নির্বাচনে বিএনপি ৩৩ দশমিক ৬০ ও ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে যথাক্রমে ১১৬ ও ৩০টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটপ্রাপ্তির ব্যবধান ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৮৪ ও ১৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। কিন্তু আসনপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এ ব্যবধান গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১০ ও ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশে।
১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শতকরা ভোটপ্রাপ্তির ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন করা হলে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা হতো যথাক্রমে ৯০, ১১২, ১২০ ও ১৪৪। অন্যদিকে বিএনপির আসন সংখ্যা হতো যথাক্রমে ৯২, ১০১, ১২৩ ও ৯৭।
১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১১ দশমিক ৯২, ১৬ দশমিক ৪০, ৭ দশমিক ২৫ ও ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এ চার সাধারণ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ভোটপ্রাপ্তির হার ছিল ১২ দশমিক ১৩, ৮ দশমিক ৬১, ৪ দশমিক ২৮ ও ৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। এ চার সাধারণ নির্বাচনে শতকরা ভোটপ্রাপ্তির আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন করা হলে জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা দাঁড়াত যথাক্রমে ৩৫, ৪৯, ২২ ও ২১। অন্যদিকে জামায়াতের আসন সংখ্যা দাঁড়াত যথাক্রমে ৩৬, ২৬, ১৩ ও ১৪।
২০২০ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম মেয়র হয়েছেন মোট ভোটারের মাত্র ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশের সমর্থন নিয়ে। অর্থাৎ আতিকুল ইসলাম মোট ভোটারের ৮৫ শতাংশ ভোটারের সমর্থন ছাড়াই মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাইয়ে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত মোট ভোটারের মাত্র ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। (বাংলা ট্রিবিউন, ১৭ জুলাই ২০২৩)
যেহেতু বাংলাদেশে বিদ্যমান এফপিটিপি নির্বাচনী ব্যবস্থায় ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেতে হবে তার কোনো সীমা নেই, সেহেতু ১০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন নিয়েও যে কেউ নির্বাচিত হতে পারেন। একই সঙ্গে এ নির্বাচনকে সাংবিধানিক বা আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করারও সুযোগ নেই। যে কারণে আতিকুল ইসলামকে ৮৫ শতাংশ এবং মোহাম্মদ এ আরাফাতকে ৯২ শতাংশ মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন এমনটি বলার সুযোগ নেই।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। এর ফলে ভোটাররা কোনো প্রার্থীকে অপছন্দ হলে ‘না’ ভোট দিতে পারতেন। কিন্তু ওই নির্বাচনের পর গঠিত সরকার বিধানটি বাতিল করে। অর্থাৎ এখন আর ‘না’ ভোটের বিধান নেই। ‘না’ ভোটের বিধান থাকলে বোঝা যেত প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে কত শতাংশের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। এ সংখ্যা বাড়তে থাকলে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলগুলো অধিকতর সতর্ক হতো।
বাংলাদেশে বিদ্যমান এফপিটিপি পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের একটা বড় দুর্বলতা হলো এ পদ্ধতিতে সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়া। এ পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীই বিজয়ী হন এবং বাকিরা সবাই গৌণ। ফলে যেকোনো পন্থায় বিজয়ী হওয়ার জন্য চেষ্টা করেন প্রার্থীরা। এ কারণেই দেশের রাজনীতিও দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনে মানুষের ভাবনায় শুধুই নৌকা আর ধানের শীষ। যখন বিশেষ দল বা ব্যক্তির জয়ই মুখ্য হয়, তখন সমাজের পিছিয়ে পড়া বা প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় না।
এ পদ্ধতিতে কোনো দলের তাদের সামগ্রিক ভোটের সংখ্যা বা পপুলার ভোট পরাজিত দলের চেয়ে কম হলেও বেশি আসনে জয়ী হওয়ায় বা ইলেক্ট্রোরাল কলেজের ভোট বেশি পাওয়ায় তারা সরকার গঠন করতে পারে।
‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতির এসব সমস্যার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (Proportional Representation) পদ্ধতি চালু রয়েছে। এ পদ্ধতিতে ব্যক্তি নয়, বরং দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। সারা দেশের গণনায় একটি দল যে সংখ্যক ভোট পায়, আনুপাতিক হারে সংসদে সে সেই পরিমাণ আসন পায়। এ পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোটই মূল্যায়ন করা হয় এবং যে দল কম ভোট পায়, সংসদে তাদেরও প্রতিনিধিত্ব থাকে। আমাদের সংসদে এখন সংরক্ষিত নারী আসনের বণ্টনও এ আনুপাতিক হারে হয়। অর্থাৎ মূল নির্বাচনে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো যে আসন পায়, সে অনুপাতে ৫০ জন সংরক্ষিত আসনের এমপি নির্বাচিত হন। অথচ মূল নির্বাচন হয় অন্য পদ্ধতিতে।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে প্রতিটি দলই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি প্রার্থী তালিকা নির্বাচন কমিশনে দেয় এবং তালিকাটি গোপন রাখা হয়। প্রতিটি দল যে পরিমাণ ভোট পায় সেই আলোকে ওই তালিকা থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিনিধি পায়। যেমন বিদ্যমান ৩০০ আসনের সংসদ নির্বাচনে যদি কোনো দল ১ শতাংশ ভোট পায়, তাহলে আনুপাতিক হারে তারা সংসদে তিনটি আসন পাবে। এরপর প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার গঠনের জন্য মোট প্রাপ্ত ভোটের ৫১ শতাংশ যে দল পাবে তারা সরকার গঠন করবে। কোনো দল এককভাবে ৫১ শতাংশ না পেলে একাধিক দল মিলে জোট গঠন করেও সরকার গঠন করতে পারে। অর্থাৎ এ পদ্ধতিতে ভোটাররা ভোট দেন দলকে, কোনো ব্যক্তিকে নয়।
আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে যেকোনো মূল্যে বিজয়ী হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা কমে আসবে। ব্যক্তির বদলে মানুষ যখন দলকে ভোট দেবে, তখন স্থানীয় পর্যায়ে দ্বন্দ্ব ও হানাহানি বন্ধ হবে এবং দল দায়বদ্ধ হবে। যে দল ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাবে, তারা যেমন সংসদে থাকবে, তেমনি ১০ শতাংশ ভোট পেলে সেই দলেরও প্রতিনিধিত্ব থাকবে। অর্থাৎ সংসদ হয়ে উঠবে সর্বদলীয়।
আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির কার্যকারিতা বিবেচনায় নিয়ে নেপালসহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রে এ পদ্ধতিতে বর্তমানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মনে করা হয়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আনুপাতিক পদ্ধতির কতটুকু প্রয়োগ করা যাবে তা নিয়ে সংশয় থাকলেও গণতন্ত্রকে কার্যকর করা, সংসদে সব দল ও মতের প্রতিনিধির অভিগমন নিশ্চিত করে সংসদকেও কার্যকর করে তোলার জন্য বাংলাদেশেও আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচন ভোটিং পদ্ধতির প্রচলন করা দরকার। আর বিষয়টিকে কার্যকর রূপ দিতে হলে সংবিধানের ৬৫ (২) ও (৩) নং অনুচ্ছেদ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ যৎসামান্য সংশোধনী আনয়ন করতে হবে। আশা করা যায়, রাজনীতিকে সব মতের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকরণ এবং উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজনীতিবিদরা এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন।
সূত্র: বণিক বার্তা, অক্টোবর ২০, ২০২৩
লিংক: https://bonikbarta.net/print-news/358163